সড়কে চলন্ত বোমা

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন

মেয়াদহীন সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ঝরছে তাজা প্রাণ

 

মহসীন আহমেদ স্বপন : সড়কে সিএনজিচালিত বাহন যেন এক একটি চলন্ত বোমা। মেয়াদহীন সিলিন্ডার বিস্ফোরণে প্রায়ই ঘটছে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। ঝরছে তাজা প্রাণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তদারকি আর সিলিন্ডার রিটেস্টিং সেন্টারের অভাবে দিনকে দিন আরো প্রকট হচ্ছে এ সংকট। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে জনাকীর্ণ শহরগুলোতে ঘটতে পারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। সড়কে গাড়ি চলতে চলতে হঠাৎ বিস্ফোরণ। কিছু বুঝে উঠার আগেই নিভে যায় তাজা প্রাণ। নিমেষেই পুড়ে ছাই সব স্বপ্ন।
সূত্র বলছে, সড়কে চলন্ত সিলিন্ডারগুলোর প্রায় ৮০ ভাগই পুনঃপরীক্ষার বাইরে। ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো পেটের মধ্যে ফিটনেসবিহীন গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে দাবড়ে বেড়াচ্ছে রাজপথ-মহাসড়ক। সিএনজিচালিত বেশির ভাগ গাড়িই যেন একেকটি ‘চলন্ত বোমা’। বাসাবাড়ি, ছোট-বড় দোকান এবং বিভিন্ন কারখানায় অবাধে চলছে এসব মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার। যত্রতত্র গড়ে ওঠা কারখানাগুলোয় অসচেতন দরিদ্র শ্রমিকরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই নিরীহরাই বিস্ফোরণের শিকার হচ্ছেন। যারা বেঁচে যাচ্ছেন, তাদের অনেককেই পঙ্গুত্ববরণ করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি বিএরটিএর তথ্য বলছে, দেশে মোট নিবন্ধিত মোটরযানের সংখ্যা প্রায় ৪০লাখের উপরে। এর মধ্যে সিএনজিচালিত যান রয়েছে প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ।
সিএনজি নিরাপত্তার আন্তর্জাতিক মান নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি গ্যাস সিলিন্ডার পাঁচ বছর পরপর রি-টেস্টের বিধান থাকলেও তা করা হয়না। রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি-আরপিজিসিএলের হিসাব অনুযায়ী মেয়াদ অতিক্রম করা এমন গাড়ির সংখ্যা ৬ লাখেরও বেশি।
বিশেষজ্ঞদের মতে মানহীন সিলিন্ডারের ব্যবহার, নিয়মিত তদারকির অভাবেই প্রায়ই ঘটছে এমন ঘটনা।
বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ বলেন, বাল্বগুলো রয়েছে, সেগুলো সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা নয়। এবং সিএনজি কনভারসেশনগুলো যদি ভালো মানের না হয় এবং নি¤œমানের সিলিন্ডারে ব্যবহার করার ফলে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
এ ব্যাপারে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ঢাকা শহরের সিএনসিচালিত গাড়িগুলোর নিয়মিত তদারকি না থাকায় বড় দুর্ঘটনার একটা শঙ্কা রয়েছে। ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলোতেও মেয়াদহীন গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে। আর এই মেয়াদহীন গ্যাস সিলিন্ডার থেকে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তিনি বলেন, সিএনজিচালিত যানবাহনগুলোতে নিয়মিত তদারকির ব্যবস্থা করা দরকার। সেইসাথে তদারকি আর সিলিন্ডার রিটেস্টিং এর বিষয়ে নজর দিতে হবে।
বিস্ফোরক অধিদফতর বলছে, প্রতিটি গ্যাস সিলিন্ডারের আয়ু ১০-১৫বছর। এরপর এগুলো বাতিল করতে হয়। নির্ধারিত সময় পর সিলিন্ডারগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। ঝুঁকি নিয়েই মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির ভেতরে মেয়াদোত্তীর্ণ এসব সিলিন্ডার সড়কে দাবড়ে বেড়াচ্ছে। সূত্র বলছে, এসব অনিয়ম দেখার জন্য বিস্ফোরক অধিদফতরের নির্ধারিত পরিদর্শক রয়েছে। কিন্তু তারা দায়িত্ব পালন করছে না ঠিকভাবে, এসব নিয়ে নানা অভিযোগ আছে। ২০১৬ সালে বিস্ফোরক অধিদফতর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের ১১ হাজার গ্যাস সিলিন্ডার পরীক্ষা করে ৮ হাজারই ব্যবহারের অনুপযোগী পায়। পরে সেগুলো বাতিল করা হয়। অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, দেশে আবাসিক, শিল্প ও বাণিজ্যিকভাবে প্রায় ৯০লাখ এলপিজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) সিলিন্ডার আছে। গাড়িতে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার আছে প্রায় ৪লাখ। এসব সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষার পর্যাপ্ত সুবিধাও দেশে নেই। সারাদেশে মাত্র ১৫টি পুনঃপরীক্ষা কেন্দ্র রয়েছে।
তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ বলেন, মালিক, প্রশাসনের দায়িত্বহীনতার কারণেই একের পর এক অগ্নিকা- ঘটছে।
ঢাকাবাসী যে কতটা অগ্নিঝুঁকিতে আছে, এর বড় প্রমাণ হচ্ছে এই উদাহরণটি- সরকার নতুন করে গ্যাস সংযোগ না দেয়ায় এই ঢাকা শহরেরই এক বাড়ির মালিক নিজ উদ্যোগে ভবনের নিচ তলা থেকে পাইপে প্রতি ফ্ল্যাটে গ্যাস সরবরাহ করছেন। নিচ তলায় গ্যাস সিলিন্ডারগুলো জড়ো করে পাইপের মাধ্যমে প্রতি ফ্ল্যাটে গ্যাস সরবরাহ করছেন। যদি কোনো কারণে একটি সিলিন্ডারে বিস্ফোরণ ঘটে, তাহলে বাকি সিলিন্ডারগুলোয়ও বিস্ফোরণ ঘটার শঙ্কা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, গ্যাস নেয়ার সময় সিএনজি রিফিল স্টেশনগুলোতে সিলিন্ডারের প্রয়োজনীয় কাগজ দেখানোর বিধান থাকলে কমে আসবে রিটেস্ট না করানোর প্রবণতা।
বিআরটিএর ফিটনেস নেয়ার সময় সিলিন্ডার রিটেস্ট করানো বাধ্যতামূলক করারও পরামর্শ তাদের।


বিজ্ঞাপন