নিজস্ব প্রতিবেদক : পাঁচ থেকে সাত জনের গ্রুপ। সবার পরনে হাফপ্যান্ট কিংবা থ্রি-কোয়ার্টার। গায়ে টি-শার্ট। মুখে মুখোশ। হাতে ধারালো অস্ত্র। গভীর রাতে দেয়াল টপকে, গ্রিল কেটে ঢুকছে টার্গেট করা বাসায়। অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে লুট করে নিয়ে যাচ্ছে স্বর্ণালঙ্কারসহ নগদ টাকা। গত দুই মাসে ঢাকার দক্ষিণাঞ্চল দোহার, কেরাণীগঞ্জ ও নবাবগঞ্জে অন্তত এমন এক ডজন ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, একটি গ্রুপই সব ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে। গ্রুপটিকে এখনও সনাক্ত করা যায়নি।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার বলেন, ডাকাতির ঘটনাগুলো তদন্তে তিনজন অতিরিক্ত এসপিসহ এএসপি ও তদন্ত কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। আশা করছি দ্রুত অপরাধীরা ধরা পড়বে।
এ ছাড়া ডাকাতি প্রতিরোধে থানা পুলিশের টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
গত ৯ মার্চ রাতে নবাবগঞ্জ থানারে সুরাইন এলাকায় রোকনউদ্দিন ও কামরুজ্জামানের বাসায় ডাকাতির ঘটনা ঘটে। রোকনউদ্দিনের বাড়ি থেকে ডাকাতরা ৯ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও ২০ হাজার টাকা এবং কামরুজ্জামানের বাড়ি থেকে তিন ভরি স্বর্ণালল্কার, ২৫ ভরি রুপার গয়না ও নগদ ২৫ হাজার টাকা নিয়ে যায়। দুটি ঘটনা উল্লেখ করে নবাবগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ডাকাতির শিকার ব্যক্তিরা জানিয়েছেন হাফপ্যান্ট ও টি-শার্ট পরা ডাকাত দলের সদস্যরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে দুই বাসায় ঢুকেছিল।
৪মার্চ কেরাণীগঞ্জের দক্ষিণ রামেরকান্দা এলাকার যুবলীগ নেতা শেখ সাহাবুদ্দিনের বাসায়ও ডাকাতি হয়। ডাকাতরা নিচতলার গ্রিল কেটে প্রায় ৩০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও ১২ লাখ টাকা নিয়ে যায়। এ ঘটনায় কেরাণীগঞ্জ মডেল থানায় শেখ সাহাবুদ্দিনের ছেলে আশিক আনাম শুভ বাদি হয়ে মামলা দায়ের করেছেন।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আশিক আনাম শুভ জানান, নিচতলার ডাইনিং রুমের পাশের জানালার গ্রিল কেটে ৮জন ডাকাত বাসায় ঢোকে। ওদের তিনজন নিচে আর পাঁচজন দোতলায় গিয়ে প্রথমে তার বোনের রুমে ঢোকে। তারপর বাবা-মার রুমে যায়। পরে তাকেও ও পাশের রুমে থাকা খালাকে ডেকে তোলে। অস্ত্রের মুখে সবার হাত-পা বেঁধে ডাকাতরা স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ টাকা নিয়ে যায়।
শুভ আরও বলেন, ‘ডাকাত দলের যে পাঁচজন দোতলায় উঠেছিল, তাদের বয়স ২২ থেকে ২৫বছরের মধ্যে। সবার পরনে হাফপ্যান্ট। তিনজনের মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক ও হাতে গ¬াভস ছিল। বাকি দুজন কাপড় দিয়ে মুখ বেঁধে রেখেছিল। কথাবার্তায় সবাইকে স্মার্ট ও শিক্ষিত মনে হয়েছে।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কেরাণীগঞ্জ মডেল থানার পরিদর্শক (ইন্টেলিজেন্স) আব্দুল্লাহ শেখ বলেন, তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে আসামিদের সনাক্ত করার চেষ্টা করছি।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দোহারের পূর্ব লোটোখোলা জয়পাড়ায় ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ডাকাতরা একটি বাসা থেকে ২০/২২ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা নিয়ে যায়। এ ঘটনায় আজিজুল ম্যানেজার নামে এক ব্যক্তি দোহার থানায় মামলা দায়ের করেছেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন জানান, ডাকাতরা হাফপ্যান্ট ও টি-শার্ট পরে গ্রিল কেটে বাসায় ঢুকেছিল।
দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ জানান, তার থানাধীন আইঞ্চা ও আব্দুল্লাহপুর এলাকায় ডিসেম্বর ও ফেব্রুয়ারিতে দুটি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া অন্যান্য ডাকাতির ঘটনার সঙ্গে দুটি ঘটনার মিল রয়েছে।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দোহার, কেরাণীগঞ্জ ও নবাবগঞ্জে সম্প্রতি যেসব ডাকাতি হচ্ছে তা একই গ্রুপ ঘটাচ্ছে বলে তারা মনে করছেন। ধারণা করা হচ্ছে, ডাকাতরা দিনে বাসা-বাড়ি রেকি করে রাতে ডাকাতি করছে।
ডাকাতদের সনাক্ত করতে জেলা পুলিশ সুপার একটি বিশেষ টিম গঠন করে দিয়েছেন। রাজধানী ঢাকা ও আশেপাশের জেলাগুলোতে ডাকাতির ঘটনায় কেউ গ্রেফতার হলে তাদের কাছ থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স-এর তথ্য বলছে, গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে সারা দেশে ৮১টি ডাকাতির ঘটনায় মামলা হয়েছে। মোট মামলার ৩৭ দশমিক ৮০ ভাগ ঢাকা রেঞ্জ ও প্রায় ২৪ ভাগ চট্টগ্রাম রেঞ্জে হয়েছে। মোট ডাকাতির ৬০ দশমিক ২৪ ভাগ হয়েছে রাত ১২টা থেকে ভোরের মধ্যে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও জোনাল টিম একসঙ্গে ৬টি ডাকাতির ঘটনার রহস্য উন্মোচন ও আসামিদের গ্রেফতার করেছে। এসব ঘটনায় পেশাদার ডাকাত চক্রের সঙ্গে জঙ্গিদের সম্পৃক্ত থাকার তথ্যও পেয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ডাকাতির ঘটনায় প্রতিরোধের কৌশল হিসেবে সকল ঘটনায় মামলা রুজু করতে হবে। চিহ্নিত ডাকাতদের মডাস অপারেন্ডি (কর্মপ্রক্রিয়া) সনাক্ত করে কমিউনিটি ও বিট পুলিশিংয়ের সদস্য এবং চৌকিদারদের জানিয়ে রাখতে হবে। সার্কেল অফিসে রক্ষিত কার্ড ইনডেক্স ও ভিসিএনবি’র অতীত ঘটনাবলী পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নিতে হবে। সিডিএমএস পর্যালোচনা করে ডাকাতদের তালিকা তৈরি করতে হবে।
নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, সাজা ভোগকারী ডাকাত ও জামিনপ্রাপ্তদের নজরদারিতে রাখতে হবে। অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি যেন জামিন না পায় সেজন্য পিপির সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। ডাকাতি প্রতিরোধে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। প্রযুক্তি নির্ভর নজরদারিও বাড়াতে হবে। বাসা-বাড়ি, রাস্তায় সিসি ক্যামেরা চালু করতে হবে।
আসামি গ্রেফতার হলে যথাযথ জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে সিন্ডিকেট বা গ্যাং চিহ্নিত করতে হবে। পিসিপিআর যাচাই করার জন্য ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে সিডিএমএস, আফিস, পিবিআই-এর ডাটাবেজে যাচাই করতে হবে। পাশাপাশি, ডাকাতি মামলার চার্জশিটভুক্ত কিন্তু বিচারে খালাসপ্রাপ্ত সকল আসামির একটি হিস্ট্রি শিটও (অতীতের কর্মকা-) খোলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।