দুঃসাহসী সারোয়ারে তটস্থ ছিল যারা!

অপরাধ এইমাত্র জাতীয়

নিজস্ব প্রতিবেদক : নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম। বিসিএস ২৭তম ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডার। ২০০৮ সালের নভেম্বরে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন সারোয়ার। ২০১৪ সালের ১ জুন সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান তিনি। সে অনুযায়ী এ পদে প্রায় সাত বছরসহ মোট ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রশাসন ক্যাডার হিসেবে কর্মরত তিনি। নানা সাহসী অভিযানের কারণে বিভিন্ন সময় প্রশংসা কুড়িয়েছেন দুঃসাহসী এই প্রশাসনের ক্যাডার।
সারোয়ার আলমের কিছু দুঃসাহসিক অভিযানের ইতিহাস :
ইরফান সেলিমের বাড়িতে অভিযান : ২০২০ সালের অক্টোবরে মদ্যপান ও ওয়াকিটকি ব্যবহার করায় সংসদ সদস্য (এমপি) হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমের বাসায় অভিযান চালায় র‌্যাব। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম এর নেতৃত্বে ইরফান সেলিমের চকবাজারের বাসায় মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি, পুলিশ, র‌্যাব এবং একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য, অবৈধ অস্ত্র ও ওয়াকিটকি উদ্ধার করে।
ক্যাসিনো অভিযান : ২০১৯ সালে সারোয়ার আলম এর নেতৃত্বে রাজধানীর ফকিরাপুলে ‘ইয়ংমেনস’ নামে একটি অবৈধ ক্যাসিনোতে অভিযান চালায় র‌্যাব। সে অভিযানে অবৈধ ক্যাসিনো থেকে ১৪২ জনকে আটক করেছে র‌্যাব। এছাড়াও বিপুল পরিমাণ অর্থ ও জুয়া খেলার সামগ্রী উদ্ধার করা হয়। যা সে সময়ের বহুল আলোচিত অভিযান ছিল। তারই সূত্র ধরে গ্রেফতার করা হয় ক্যাসিনো সম্রাট নামে খ্যাত ইসমাইল হোসেন চৌধুরীকে।
জি কে শামীমের অফিসে অভিযান : একই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর নিকেতনে যুবলীগ নেতা কিবরিয়া শামীম (জি কে শামীম) এর অফিসে অভিযানে যায় র‌্যাব। সেখানেও ছিলেন সারোয়ার আলম। অভিযানে জি কে শামীমের কার্যালয়ে তল্লাশি চালিয়ে অবৈধভাবে উপার্জিত নগদ এক কোটি ৮০ লাখ টাকা, ২০০ কোটি টাকার এফডিআর, বিদেশি ডলার, মদ ও অস্ত্র উদ্ধার করেন তিনি।
শাহেদ ও রিজেন্ট হাসপাতাল : ভুয়া করোনার সার্টিফিকেট প্রদানের দায়ে অভিযান চালিয়ে সিলগালা করা হয় রিজেন্ট হাসপাতালকে এবং মূল হোতা শাহেদকে পরে গ্রেফতার করা হয়। রিজেন্ট হাসপাতাল যে দীর্ঘদিন থেকে লাইসেন্সবিহীনভাবে হাসপাতাল চালিয়ে আসছিল তাও বেরিয়ে আসে সারোয়ার আলমের সেই আলোচিত অভিযানে।
পথচারীদের জরিমানা : ২০১৫ সাল থেকে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন করছেন আলম। তবে প্রথম আলোচনায় আসেন ২০১৪ সালে পথচারীদের সচেতন করা ও নিয়ম অমান্যে জরিমানার মধ্যে দিয়ে। ফার্মগেটের ওভারব্রিজ বাদ দিয়ে সরাসরি যারা রাস্তা পার হচ্ছিলেন, তাদের নামমাত্র জরিমানা করে সচেতন করেছিলেন তিনি।
ভেজালবিরোধী ও নকল পণ্যের বিরুদ্ধে অভিযান : ২০১৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার হাতিরপুলে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কোম্পানির পণ্য নকল করে বাংলাদেশে উৎপাদনের কারখানায় হানা দেন সারোয়ার আলম। হাতেনাতে ধরে সিলভান ট্রেডিং কোম্পানি ও টোটাল ফার্মাকে ৪০ লাখ টাকা জরিমানা এবং দুজনকে জেল দেন তিনি। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি তিনি ভেজালবিরোধী ও নকল পণ্যের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে সবার নজর কাড়েন।
নামীদামী হাসপাতালে অভিযান : ২০১৮ ও ২০১৯ সালজুড়ে বড় বড় হাসপাতালে অভিযান চালান সারোয়ার আলম। অভিযানে মেয়াদোত্তীর্ণ রিএজেন্ট ব্যবহার ও অনুমোদনহীন ওষুধ বিক্রির অভিযোগে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালকে ২০ লাখ টাকা, অ্যাপোলো হাসপাতালকে পাঁচ লাখ ও পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করেন তিনি।
এছাড়া একই অভিযোগে পান্থপথের বিআরবি হাসপাতাল, শমরিতা হাসপাতাল ও বাংলাদেশ স্পাইন হাসপাতালকে ১৮ লাখ টাকা জরিমানা করেন সারোয়ার আলম। নানা অনিয়মের অভিযোগে চট্টগ্রামের ম্যাক্স হাসপাতালকেও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেন তিনি।
২০২০ সালের ২৯ জুলাই উত্তরার ক্রিসেন্ট, আরএমসি ও লুবনা হাসপাতালে অভিযান চালান সারোয়ার আলম। টেস্ট না করেই মাইক্রো বায়োলজিক্যাল ও কালচার টেস্ট দেয়ার কারণে ১৭ লাখ, লুবনা হাসপাতালকে ২০ লাখ এবং আরএমসি হাসপাতালকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করেন তিনি।
২৫ জুলাই ধোলাইপাড়ে কিউর জেনারেল হাসপাতালে অপারেশন করার সময় এইচএসসি পাস দুই ভুয়া ডাক্তারকে আটক করেন তিনি।
কুকুর ও পশুর মেয়াদোত্তীর্ণ ভ্যাকসিন : ২০১৯ সালের ২৭ আগস্ট ফকিরাপুলের একটি ভবনে অভিযান চালিয়ে ২০১২ সালের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া জলাতঙ্ক, বার্ড ফ্লুর ভ্যাকসিন ২০১৯ সালে কুকুরের দেহে দেওয়ার অভিনব প্রতারণার চিত্র। সব যাচাই-বাছাই করে অ্যাডভান্স অ্যানিম্যাল সায়েন্স কোং লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানের ছয়জনকে জেল ও ৭৫ লাখ টাকা জরিমানা করেন তিনি। জব্দ করেন আরও ১০ কোটি টাকার মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ।
ভয়ংকর কিশোর গ্যাং : ঢাকায় যখন বিভিন্ন কিশোর অপরাধী ও গ্যাংয়ের হাতে হত্যাকা-, চুরি-ছিনতাই বেড়ে যায়, তখন তাদের শনাক্তে অভিযান চালান সারোয়ার আলম। গত বছরের ৩১ জুলাই রাজধানীর শ্যামলী, শিশুমেলা, কলেজ গেট এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২৯ কিশোরকে আটক করে ছয় মাসের জন্য কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠান তিনি।
পশুর হাটে হানা : ৯ আগস্ট গাবতলীর কোরবানির পশুর হাটে হানা দেন সারোয়ার আলম। হাতেনাতে ধরেন একজন পশু চিকিৎসককে। ওই চিকিৎসক গরু মোটাতাজাকরণ স্টেরয়েড ইনজেকশন দিচ্ছিলেন।
দুধে ভেজাল মিশ্রণ : ২০১৯ সালের ৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজারে বারো আউলিয়া ডেইরি মিল্ক অ্যান্ড ফুড লিমিটেডে অভিযান চালান সারোয়ার আলম। গিয়ে দেখেন, ১০০ লিটার দুধের সঙ্গে পানি, স্কিম মিল্ক পাউডার ও বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে ২ হাজার ৮০০ লিটার পাস্তুরিত দুধ তৈরি করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের পরিচালকসহ ১২ জনকে কারাদ- এবং ৫৮ লাখ টাকা জরিমানা করে ফ্যাক্টরি সিলগালা করেন তিনি।
ডেঙ্গু পরীক্ষায় অতিরিক্ত ফি জালিয়াতি : ডেঙ্গু পরীক্ষায় সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে বেশি নেওয়া এবং টেস্ট না করে প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট দেওয়ায় পল্টন ও ফকিরাপুল এলাকার চারটি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পাঁচজনকে জেল ও ১৮ লাখ টাকা জরিমানা করে প্রতিষ্ঠান দুটি সিলগালা করেন সারোয়ার আলম।
চাঁদাবাজ হাতি : ২০১৯ সালের মে মাসে কাওরান বাজারে একটি অভিযান চালানোর সময় হাতি দিয়ে মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদাবাজির চিত্র চোখে পড়ে সারোয়ার আলমের। তখনই দুই হাতি ও মাহুতকে থামার নির্দেশ দেন তিনি। তবে মাহুত না থেমে দৌড়াতে থাকেন, পেছনে দৌড়ান তিনিও। অবশেষে হাতিরঝিলে গিয়ে আটকান তাদের। দুজনকে ছয় মাসের কারাদ- দেন তিনি।
পুরান ঢাকার কেমিক্যাল কারখানা সরাতে অভিযান : ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ঘটে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা। ওই ঘটনার পর একের পর এক ক্ষতিকারক কেমিক্যাল কারখানা সরানোয় অভিযান চালান তিনি।
আরও যত উল্লেখযোগ্য অভিযান : ২০১৯ সালে সিন্ডিকেট করে সৌদি এয়ারলাইনসের টিকিট কিনে হজযাত্রীদের কাছে বেশি মূল্যে বিক্রির অভিযোগে অভিযান পরিচালনা করেন সারোয়ার আলম। মেয়াদোত্তীর্ণ কসমেটিকস বিক্রি করায় গুলশানের পারসোনা বিউটি পার্লার ও ফারজানা শাকিল বিউটি পার্লারকে ৩০ লাখ টাকা জরিমানা করেন তিনি।
একই বছরের ২৭ মে গরুর মাংসে রং ব্যবহার করায় নিউমার্কেট কাঁচাবাজারে অভিযানে গিয়ে জেল-জরিমানা করেন তিনি। বিজিবির সীমান্ত স্কয়ারের ফুডকোর্টে অভিযান চালান সারোয়ার আলম। জেল-জরিমানা করেন সংশ্লিষ্টদের।
নকল কসমেটিকসের বিরুদ্ধে চকবাজার, কেরানীগঞ্জ ও ডেমরা এলাকায় কমপক্ষে ১২টি অভিযান চালান সারোয়ার আলম। বাদামতলী ও কারওয়ান বাজারে একাধিক অভিযান চালান তিনি। এ সময় কেমিক্যাল দিয়ে কাঁচা আম হলুদ করে বিক্রি এবং মেয়াদোত্তীর্ণ খেজুর বিক্রির চিত্র উঠে আসে সবার সামনে।
দুষ্টের পালন আর শিষ্টের দমন : বিসিএস ২৭তম ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডার হিসেবে ২০০৮ সালের নভেম্বরে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন সারোয়ার আলম। ২০১৪ সালের ১ জুন সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান তিনি। সে অনুযায়ী এ পদে প্রায় সাত বছরসহ মোট ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রশাসন ক্যাডার হিসেবে কর্মরত আছেন তিনি, যা পদোন্নতির শর্ত পূরণ করে।
এদিকে, সহকারী সচিব থেকে উপসচিব হিসেবে ৩৫৮ জনকে পদোন্নতি দিয়েছে জনপ্রশানস মন্ত্রণালয়। পদোন্নতি পাননি সিনিয়র সহকারী সচিব শতাধিক সফল অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া আলোচিত র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারোয়ার আলম।
গত ৭ মার্চ প্রশাসনের সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে পদোন্নতি পেয়ে উপ-সচিব হয়েছেন ৩৫৮ জন কর্মকর্তা। দুটি প্রজ্ঞাপনে ৩৩৭ জনকে পদোন্নতি পেয়েছেন। বাকি ২১ জন কর্মকর্তা শিক্ষা ছুটিতে থাকায় তাদের নামে প্রজ্ঞাপন জারি না হলেও নিয়মানুযায়ী প্রত্যেকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়।
সারোয়ার আলম বিসিএস ২৭তম ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারে ২০০৮ সালের নভেম্বরে যোগ দেন। ২০১৪ সালের ১ জুন সিনিয়র সহকারী সচিব পদে পদোন্নতি পান। এ পদে ১২ বছরের বেশি সময় ধরে কর্মরত। যা পদোন্নতির শর্ত পূরণ করে। তার বিরুদ্ধে কোনো বিভাগীয় অভিযোগ নেই। এরপরও সারোয়ার আলমের পদোন্নতি না হওয়ায় অনেকে হতাশ প্রকাশ করেছেন।
বিসিএস ২৭তম ব্যাচের সারোয়ার আলমসহ প্রায় ৩০ কর্মকর্তা পদোন্নতি পাননি। এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ (এপিডি) অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আনিছুর রহমান মিঞা বলেন, যারা যোগ্য সকলেই পদোন্নতি পেয়েছেন। সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড সবকিছু বিশ্লেষণ করে যোগ্যদের পদোন্নতি দিয়েছে।
করোনাকালীন সময়েও তিনি তার কাজ থেকে পিছপা হননি। এবার সেই আলোচিত ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলমের আক্ষেপ ঝরল ফেসবুক স্ট্যাটাসে।
গত ৮ মার্চ রাত ১২টা ১০ মিনিটে নিজের ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে নিজের চাকরি জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন।
স্টাটাসে তিনি লেখেন, ‘চাকরি জীবনে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী অন্যায়, অনিয়মের বিরুদ্ধে লড়েছেন তাদের বেশির ভাগই চাকরি জীবনে পদে পদে বঞ্চিত ও নিগৃহীত হয়েছেন। এ দেশে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়াটাই অন্যায়!’
এর আগে গত বছরের রমজান মাসে বেশ কয়েকটি ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে নিয়মিত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন সারোয়ার। এসব আলোচনার মধ্যেই গত বছরের নভেম্বরের দিকে তাকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে বদলি করা হয়। বর্তমানে তিনি এখানেই কর্মরত আছেন।


বিজ্ঞাপন