ক্রমেই বাড়ছে জ্বরের প্রকোপ

অন্যান্য এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন জীবনী ঢাকা রাজধানী স্বাস্থ্য

ডেঙ্গু ভাইরাসের ধরন বদল


বিজ্ঞাপন

মহসীন আহমেদ স্বপন : রাজধানীসহ সারা দেশেই এখন ডেঙ্গু আতঙ্ক। ভাইরাসের ধরন বদলে গিয়ে ক্রমেই বাড়ছে ডেঙ্গু জ¦রের প্রকোপ। গত সাত দিনে শতাধিক নারী, পুরুষ ও শিশু ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তবে প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ২৩ জন। সে হিসাবে প্রতি ঘণ্টায় একজন করে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৫৬ জন ডেঙ্গু রোগী। চলতি জুন মাসের প্রথম ১১ দিনেই ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা মোট ১৫৮ জন। বুধবার বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার ও স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্তব্যরত চিকিৎসক সাখাওয়াত হোসেন এসব তথ্য জানান।
একাধিক সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, রাজধানীতে হঠাৎ করে ডেঙ্গু ও ভাইরাস জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাইরাস জ্বর সাধারণত দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। তিন দিনের মধ্যে জ্বর ভালো না হলে তারা রোগীকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কিনা তা জানতে রক্ত পরীক্ষা করতে পরামর্শ দিচ্ছেন। রক্ত পরীক্ষায় অনেকেরই ডেঙ্গু জ্বর ধরা পড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেয়া তথ্য মতে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে বুধবার পর্যন্ত মোট ৪২০ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মোট আক্রান্তদের মধ্যে জানুয়ারিতে ৩৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১১৮, মার্চে ১২, এপ্রিলে ৪৪, মে মাসে ১৩৯ এবং চলতি মাসের ১২ তারিখ পর্যন্ত ১৫৮ জন আক্রান্ত হন। ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের মধ্যে দু’জন এপ্রিল মাসে মৃত্যুবরণ করেন।
জানা গেছে, গত ২৫ এপ্রিল রাজধানীর বিআরবি হাসপাতালে ৫৩ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা ভর্তি হন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৯ এপ্রিল তিনি মারা যান। এ ছাড়া আজগর আলী হাসপাতালে গত ২৮ এপ্রিল ভর্তি হয়ে ৩২ বছর বয়সী এক যুবক একই দিন মারা যান।
রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তিকৃত ৫৬ জন ডেঙ্গু রোগের মধ্যে মিটফোর্ডে ৩জন, বিজিবিতে ২ জন, সেন্ট্রাল হাসপাতালে ১৩ জন, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল কাকরাইলে ১৫ জন, স্কয়ার হাসপাতালে ৬ জন, সালাউদ্দিন হাসপাতালে ৩ জন, আজগর আলী হাসপাতালে ২ জন, খিদমাহ হাসপাতালে ২ জন, ইবনে সিনায় ২ জন ও বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজে ১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
যারা দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে তাদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও। বছরের শুরুতে ডেঙ্গুর প্রকোপ কম থাকলেও জুন মাস থেকে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। জুন মাস থেকেই রোগীর মৃত্যু শুরু হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তদের দেহে এই রোগের ভাইরাসের চারটি স্ট্রেন বা প্রকার পাওয়া যায়। অর্থাৎ এডিস মশা থেকে চার ধরনের ভাইরাস মানুষের শরীরে আসতে পারে। স্ট্রেন এক-দুই-তিন ও চার। ২০০০ সালে স্ট্রেন-৩-এর প্রাদুর্ভাব বেশি ছিল। তাই মৃত্যুও বেশি ছিল। এ বছরও সেই স্ট্রেন-৩-এর প্রাদুর্ভাব বেশি পাওয়া যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেন, বিষয়টি আমাদেরও ভাবিয়ে তুলেছে। যেসব শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে তারা খুবই গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে এসেছিল। এডিস মশার ভাইরাস চার ধরনের, যাকে সেরোটাইপ বলা হয়। তবে কোন সেরোটাইপে কে আক্রান্ত হলো, কোন সেরোটাইপের জটিলতা কেমন তা নিয়ে খুব বেশি গবেষণা না থাকায় ভাইরাসের ধরন কেন বদলে যাচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক
অধ্যাপক ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, ডেঙ্গুর ভাইরাসের ধরন পাল্টেছে। আর আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালে আনতেও অনেক দেরি হয়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, যে টাইপের এডিস মশায় কামড়ানোর ফলে কারও একবার ডেঙ্গু হয় সেই একই টাইপের ভাইরাস থেকে একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হবেন না। তবে এডিস মশার বাকি তিনটি টাইপের ভাইরাস থেকে তিনি আবারো আক্রান্ত হতে পারেন।
প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ডেঙ্গু একবার হলে আর হবে না এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। বরং দ্বিতীয়বার হলে তার মাত্রা বেশি হয়। সে ক্ষেত্রে রোগটি জটিল হতে পারে। তবে একই টাইপের ভাইরাস থেকে সাধারণত দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু হয় না।
ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্ক নয় : ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত জ্বর। এ ভাইরাস এডিস মশার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে জন থেকে জনে। ডেঙ্গু আবারও আতঙ্ক নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। রাজধানীসহ সারা দেশে ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুসহ সব বয়সের মানুষ। তবে শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানা গেছে। অনেক শিশুর ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুও হয়েছে। ডেঙ্গুতে শিশু-নারীসহ কয়েকজনের মৃত্যুর খবর পত্রিকায় এসেছে। তবে এজন্য আতঙ্কিত না হয়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে তার দ্রুত ও সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
ভাইরাসজনিত অন্য রোগের মতোই ডেঙ্গু জ্বরের সরাসরি কোনো প্রতিষেধক নেই, নেই কোনো টিকা। ডেঙ্গুর মতো চিকুনগুনিয়ার ভাইরাসও এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। গত বছর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ডেঙ্গুর পাশাপাশি চিকুনগুনিয়া ভাইরাসেরও প্রকোপ দেখা দিয়েছিল। চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের হঠাৎ করে অনেক জ্বর এবং গায়ে প্রচুর ব্যথা দেখা দেয়।
মশক নিধন কার্যক্রমের স্থবিরতা, গাইডলাইনের অভাব এবং মানুষের অসচেতনতাই ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির জন্য প্রধানত দায়ী বলে বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা। মাঝেমধ্যে বৃষ্টিতে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার লার্ভার খুব বেশি মাত্রায় প্রজনন সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে এডিস মশার বিস্তার ঘটে। এডিস মশার সংখ্যা যত বৃদ্ধি পাবে, ডেঙ্গু আক্রান্ত লোকের হারও ততো বাড়বে। ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে খুঁজে খুঁজে মশার উৎস ধ্বংস করতে হবে। মশার উৎস কমলে ডেঙ্গুর ঝুঁকিও অনেকাংশে কমে যাবে।
ক্লাসিক্যাল ও হেমোরেজিক নামে দু’ধরনের ডেঙ্গু জ্বর রয়েছে। এর মধ্যে হেমোরেজিক জ্বর বেশি ভয়াবহ। এ জ্বরের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পেতে এডিস মশা যাতে কামড়াতে না পারে তার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। রাজধানীসহ দেশের সবখানে মশা নিধন ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। এডিস মশা স্বচ্ছ ও পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশার ডিম পাড়ার উপযোগী স্থানগুলোতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং পরিষ্কার রাখতে হবে।
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনকে এডিস মশা নিধন এবং এডিসের বংশ বিস্তার রোধের কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করতে হবে। ডেঙ্গুর প্রাথমিক লক্ষণগুলো সম্পর্কে মানুষকে জানাতে হবে। ডেঙ্গু হলে করণীয় সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করে রাজধানী ও জেলা-উপজেলা সদরের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ ও চিকিৎসায় বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবেই সম্ভব ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা।
নগরবাসীর দাবি ও প্রত্যাশা, যত দ্রুত সম্ভব এডিস মশার বিস্তার রোধ ও মশা ধ্বংস করে, আক্রান্তদের সঠিক চিকিৎসা সেবা প্রদান করে ডেঙ্গু আতঙ্ক থেকে জনগণকে রক্ষা করা হবে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *