সড়কে চরম ভোগান্তি

এইমাত্র জাতীয়

বিশেষ প্রতিবেদক : রাজবাড়ী দৌলতদিয়া ফেরি ঘাট দিয়ে ঢাকায় ফিরছেন সহস্রাধিক যাত্রী। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় ঘাটে সকাল থেকেই যাত্রী ও ছোট গাড়ির চাপ ছিল অনেক বেশি । তবে ফেরি চলাচল স্বাভাবিক থাকায় দীর্ঘ অপেক্ষা ছাড়াই নদী পার হওয়া গেছে।
এদিকে, দূরপল্লার গণপরিবহন বন্ধ থাকায় সড়কে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন যাত্রীরা। অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে গাদাগাদি করে দৌলতদিয়া ঘাটে আসছেন মাইক্রোবাস, মাহেন্দ্রা, অটোরিকশা, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন মাধ্যমে। তবে ভোগান্তি ছাড়াই নদী পার হচ্ছেন তারা।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) দৌলতদিয়া ঘাট ব্যবস্থাপক ফিরোজ খান জানান, এ রুটে বর্তমানে ছোট বড় ১৬টি ফেরি চলাচল করছে। স্বাভাবিকভাবে ফেরি চলাচল করায় যাত্রী ও যানবাহনগুলো দীর্ঘ অপেক্ষা ছাড়া নদী পার হচ্ছে। তবে দৌলতদিয়া প্রান্তে ঢাকামুখী যাত্রী ও ছোট গাড়ির কিছুটা চাপ রয়েছে।
এ দিকে ঈদ যাত্রায় যাত্রীদের ভোগান্তি নিয়ে সারাদেশ থেকে প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর থেকে জানা গেছে, নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রংপুরের মডার্ন মোড় থেকে রকি পরিবহন নামের একটি যাত্রীবাহী কোচ বুধবার রাতে রওনা হয় ঢাকার পথে। সন্ধ্যা ৬টায় রওনা দিয়ে ৪২ সিটের এই গাড়িটি বগুড়া পর্যন্ত আসতেই সময় লাগলো সাড়ে তিন ঘণ্টা। তখন বাসে যাত্রী সংখ্যা ৫২ হয়ে গেছে। সিট ছাড়া যাত্রীরা বসেছেন আলাদা করে পেতে দেয়া বেঞ্চে। যদিও পরিবহন মালিক-শ্রমিক একত্রে বসে অবৈধ চাঁদাবাজি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অবৈধ চাঁদা না ওঠানোর জন্য সবাইকে নির্দেশনা দিয়েছি। আমাদের সংগঠনের কেউ কোথাও চাঁদা তুলছে না। বাইরের কেউ তুলে থাকলে তার দায় আমরা নেব না এমনটাই জানিয়েছিলেন পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতারা।
বগুড়ার মাটিডালি আসার পর গাড়ির হেলপার তার পকেট থেকে একটি ডার্বি সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন। তাতে থাকা মাত্র একটি সিগারেট পকেটে ঢুকিয়ে প্যাকেটের সাদা র‌্যাপিং কাগজটি সোজা করে তাতে ৫০০ টাকার একটি নোট মুড়লেন। এরপর ছুড়ে মারলেন সামনে অন্ধকারে দাঁড়ানো একজনকে লক্ষ্য করে। টর্চলাইট হাতে লোকটি দুবার আলো জ্বাললেন (এটা একটি সিগন্যাল)। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হাইওয়ে পুলিশের তিনজন কনস্টেবল রকি পরিবহনের পাশ থেকে সরে গেলেন। এরপর বন্ধ হলো গাড়ির ইঞ্জিন। হেলপার উঁচু গলায় প্যাসেঞ্জার ডাকা শুরু করলো, ‘সিট ফাঁকা, ডাইরেক্ট ঢাকা’।
আশপাশে ঘুরে দেখা গেল, শুধু মাটিডালি এলাকাতেই টর্চলাইট হাতে এভাবে চাঁদা তোলার কাজ করছেন ৮-১০ জন। সেখানে কর্তব্যরত হাইওয়ে পুলিশের সঙ্গে বোঝাপড়া দেখা যায় তাদের। বাস-ট্রাক এলেই পুলিশ হাত তুলে থামার সংকেত দিচ্ছে। আর ড্রাইভারের চোখে টর্চের আলো ফেলে সংকেত দিচ্ছে চাঁদা আদায়কারীরা। কৌশলে কাগজে মোড়ানো এ টাকা এক যায়গায় নেয়া হচ্ছে না। কখনো উত্তরে, কখনো দক্ষিণে, কখনো পূর্ব পাশে ঘুরপাক খাচ্ছে চাঁদা আদায়কারীরা। অনেকটা চক্রাকারে। শতশত গাড়ির মাঝে তাদের এই পদ্ধতি ধরা অনেকটাই কঠিন ব্যাপার। একই পদ্ধতিতে চাঁদা তোলা হচ্ছে চারমাথা কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের আশেপাশের এলাকায়ও।
মাটিডালিতে চাঁদা আদায়কারী হালিম (ছদ্মনাম) জানান, তারা পরিবহন শ্রমিক। তবে এখন কাজ করছেন হাইওয়ে পুলিশের হয়ে। দিনে চাঁদা তোলেন নিজ সংগঠনের জন্য। পুলিশ তাকে শ’প্রতি দেয় ১০ টাকা। দুই ঘণ্টা পরপর কালেকশনের টাকা বুঝে নেন একজন সাদা পোশাকের কনস্টেবল। হালিম জানান, তার মতো আরও ১২ জন শুধু মাটিডালিতেই প্রতি রাতে কাজ করেন। দিনের বেলা তারা ছড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন স্থানে।
এ বিষয়ে হাইওয়ে পুলিশের এক সদস্য বলেন, মহাসড়কে আমাদের কোনো লোকজন চাঁদা তুলছে না। যারা রয়েছে এরা সন্ত্রাসী চাঁদাবাজ। তাদের ধরে ধরে কারাগারে পাঠানো হোক।
মাটিডালি থেকে শহর হয়ে ৯ কিলোমিটার দূরে বনানী মোড়ে এসেও দেখা গেলো চাঁদা তোলার দৃশ্য। বড় ট্রাক, ছোট ট্রাক, বাস, হায়েসসহ নানা ধরনের পরিবহনের সিরিয়াল। সেখানে চাঁদা আদায় করছেন অন্তত ১৫ জন। ভিন্ন জেলার গাড়ি থেকে নেয়া হচ্ছে এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা। কোনো কথা না বলে নীরবে চাঁদার টাকা দিয়ে যাত্রী নিয়ে ছুটে চলছে যানবাহনগুলো। তবে বনানীতে টাকা আদায়ের চিত্র আবার ভিন্ন। আদায়কারী যাত্রী সেজে উঠছে গাড়িতে। এরপর গাড়ির হেলপার কিংবা সুপারভাইজার গল্প করার ছলে তার পকেটে ভরে দিচ্ছেন চাঁদার টাকা। শেষে গাড়ি ছাড়ার এক মিনিট আগে নেমে যাচ্ছে চাঁদা আদায়কারী।
এখানকার চাঁদা আদায়কারী মনির (ছদ্মনাম) বলেন, ‘এই টাকা আমরা একা নেই না। নেতা, পুলিশ, শ্রমিক সবাই মিলে মিলেমিশে খাই। এ কারণে পুলিশের ঝামেলা নেই। আর মাঝে মাঝে ঝামেলা তৈরি হলে ১-২ ঘণ্টা চাঁদা তোলা বন্ধ রাখি।’ ১৮ মে দিনের বেলা বগুড়ার চারমাথা ও বনানী পয়েন্টে প্রকাশ্যেই যাত্রীবাহী বাস ও মাইক্রোবাস থেকে চাঁদা তুলতে দেখা যায়। প্রতিটি গাড়ি থেকে শুধু এই দুইটি পয়েন্টেই নেয়া হচ্ছে ৫০০ থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত। বিনিময়ে কোনো স্লিপ বা টোকেন দেয়া হচ্ছে না। আদায়কারীদের জিজ্ঞাসা করলে বলা হচ্ছে এটা সম্মিলিত চাঁদা। অর্থাৎ মালিক শ্রমিক পুলিশ সবাই মিলেই এই চাঁদা তুলছেন।
সড়ক-মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে গাড়ি থেকে অবৈধভাবে চাঁদা আদায়ের বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযান অব্যাহত রেখেছে। অনেকে গ্রেফতার হয়েছে। মামলাও হয়েছে। এখন নতুন করে কেউ চাঁদা আদায়ের জন্য পথে নামলে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে এদিকে, বগুড়া শহরের মতোই শেরপুর উপজেলা মহাসড়কে চাঁদা আদায় করছেন শ্রমিক নেতাদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজ চক্রের সদস্যরা। সেখানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে ‘কল্যাণ চাঁদা ও ‘যাত্রী সেবা’ এমন নাম ব্যবহার করে নীরবেই এই চাঁদাবাজির মহোৎসব চলছে।
শেরপুর উপজেলাস্থ টার্মিনালগুলো থেকে যাত্রী নিয়ে ঢাকাগামী প্রত্যেক বাস-ট্রাক, পিকআপ, মাইক্রোবাস ও প্রাইভেটকার থেকে চাঁদা নেয়া হচ্ছে। শ্রমিক ও মালিক সংগঠনের যৌথভাবে নিয়োগ দেওয়া ব্যক্তিরা ঢাকাগামী প্রত্যেক ট্রাক থেকে ৫০০-৬০০ টাকা, পিকআপ থেকে ৪০০-৫০০টাকা, বাস থেকে ৮০০-১০০০ টাকা, মাইক্রোবাস থেকে ৮০০-১০০০টাকা ও প্রাইভেটকার থেকে ৫০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করছেন।
সরাসরি চাঁদা হিসেবে এই টাকা নেয়ার কথা অস্বীকার করলেও শ্রমিকদের কল্যাণসহ সব মহলকে ম্যানেজ করতেই এই টাকা উত্তোলন করা হচ্ছে বলে স্বীকার করেন চাঁদা উত্তোলনের দায়িত্বে থাকা রাজু আহম্মেদ নামের স্থানীয় এক শ্রমিক নেতা।
চাঁদাবাজদের কাছে জিম্মি কুড়িগ্রামের পরিবহনও। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার শাপলা চত্বর, খলিলগঞ্জ স্কুল অ্যান্ড কলেজ গেট, জজকোর্ট মোড়, রেল গেট, ধরলা ব্রিজ, বীরপ্রতীক তারামন বিবি সড়ক মোড়, যাত্রাপুর, পাটেশ্বরী ও কাঁঠালবাড়ী বাজার এলাকায়ও চাঁদা তোলা হচ্ছে। রাজারহাট উপজেলার চওড়া বাজার, সেলিম নগর, রেলগেট, নাজিম খাঁ, চাঁদনী কর্নার, কলেজ মোড়, আদর্শ বাজার, সিংগের ডাবরী, বৈদ্যের বাজার ও রেলস্টেশনেও দিতে হচ্ছে চাঁদা।
পরিবহন মালিক, শ্রমিক ও চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কুড়িগ্রাম থেকে রংপুর, লালমনিরহাট, বগুড়া, রাজশাহী, দিনাজপুর, বরিশাল, ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং অভ্যন্তরীণ রুটে প্রায় পাঁচ হাজার যানবাহন চলে। এসব যানবাহন থেকে প্রকারভেদ অনুযায়ী চাঁদা তোলা হচ্ছে।
চাঁদা আদায় বন্ধে নানা উদ্যোগ-অভিযানও নিষ্ফল হয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিধিনিষেধ ও বাধা সত্ত্বেও বগুড়াসহ উত্তরবঙ্গের সড়ক-মহাসড়কে কৌশলে চাঁদাবাজি চলছেই। এটি বন্ধে পুলিশ ও পরিবহন সংগঠনগুলোর নানা উদ্যোগ এবং অভিযানও ফল দিচ্ছে না। বগুড়া থেকে ঢাকা পর্যন্ত যেতে বিভিন্ন পয়েন্টের অন্তত ১০টি স্থানে দিতে হচ্ছে এই চাঁদা। একইভাবে চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে বগুড়া থেকে দিনাজপুরগামী গাড়িগুলোও।
বাস, ট্রাক ও মাইক্রোবাস চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন সংগঠনের নামে-বেনামে চাঁদা তোলা হচ্ছে। তবে সড়ক-মহাসড়কে চাঁদা তোলার পয়েন্টগুলো বদল হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সেতু পার হওয়ার পর উত্তরবঙ্গের মহাসড়কের বিভিন্ন নতুন পয়েন্টে এখনো চাঁদা তোলা হচ্ছে। যদিও চাঁদাবাজির সময় পুলিশ একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে।তবে সড়ক পরিবহন সংগঠনের নেতারা দাবি করছেন, সড়ক-মহাসড়কে অবৈধ চাঁদাবাজি বন্ধ করতে সব সংগঠন একমত হয়েছে এবং চাঁদা না তুলতে সবাইকে নির্দেশনা দিয়েছে। যারা এখন চাঁদা তুলছে এরা পরিবহনের কেউ নয়। এরা বহিরাগত।
বঙ্গবন্ধ সেতু ঘিরেই একাধিক চক্র। বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাড়ে সয়দাবাদ-হাটিকুমরুল মহাসড়কের কড্ডা ট্রাফিক ফাঁড়ির পাশে পরিবহন নেতা ও তাদের লোকজন সক্রিয় রয়েছেন। হাইওয়ে, ট্রাফিক ও সেতু থানা পুলিশের সামনে ঢাকা ও উত্তরবঙ্গগামী শত শত বাসে দিনরাত প্রতিদিনই চাঁদাবাজি চলছে বলে জানান যানবাহন চালকরা।
এছাড়া বঙ্গবন্ধু সেতুর উভয় প্রান্ত থেকে সিরাজগঞ্জ কড্ডার মোড় হয়ে উত্তরাঞ্চলের প্রতি জেলাতেই ‘কল্যাণ চাঁদার’ নামে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের যৌথ চাঁদাবাজি চলছে। সেতুর পশ্চিম পাড়ে হাটিকুমরুল হাইওয়ে থানার অদূরে সিরাজগঞ্জ রোড, ভূঁইয়াগাঁতী, চান্দাইকোনা, ষোলমাইল, সলঙ্গা, মহিষলুটি, বোয়ালিয়া, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর ও বাঘাবাড়ীসহ নানা পয়েন্টে ‘কল্যাণ চাঁদা’ ছাড়াও চেইন মাস্টার, কলারবয় ও চুঙ্গী (যারা যাত্রীদের টেনে হেঁচড়ে নিয়ে আসে) শ্রমিকদের সাধারণ চাঁদা উত্তোলনও চালু রয়েছে। হাটিকুমরুল মহাসড়কের দক্ষিণ প্রান্তে ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গগামী বাসগুলোতে রফিকুল ইসলাম ও উত্তর প্রান্তে উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকাগামী বাসে চাঁদা তোলার জন্য মন্টু শেখ দায়িত্বে রয়েছেন। ৩২ জন করে উভয় প্রান্তে মোট ৬৪ জন চাঁদা উত্তোলনকারী, কলারবয়, চুঙ্গী ও চেন মাস্টার দায়িত্বে রয়েছেন। এখানে গোপনে প্রতিটি যানবাহন থেকে ১২০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে।
চাঁদা আদায়কারী রফিক (ছদ্মনাম) জানান, শতকরা ১০ টাকা উত্তোলনকারী বাদে বাকি টাকা বিভিন্ন ফান্ডে যায়। হাটিকুমরুল মোড়ে কল্যাণ চাঁদা উত্তোলন না হলেও সেখানে চেইন মাস্টার, চুঙ্গী ও কলারবয়দের চাঁদা তোলা হচ্ছে। এখানেও চারটি পয়েন্টে কমপক্ষে ৬০-৭০ জন পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করে থাকে।মনির নামের একজন বাসচালক জানান, ঢাকা থেকে রংপুরগামী একটি নন ব্র্যান্ডের যাত্রীবাহী বাসকে যাত্রাপথে সড়ক-মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে এক হাজার টাকা থেকে ১৮০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘বগুড়া ও রংপুর জোনের ভেতরে সবচেয়ে বেশি চাঁদা দিতে হয়। দেশের অন্যান্য সড়ক-মহাসড়কেও চাঁদা তোলা হয়, তবে তা উত্তরবঙ্গের মতো এতটা কৌশলী নয়। বগুড়া থেকে শুরু করে উত্তর দিকে চলতে থাকলে সড়ক-মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে চাঁদা নেয়ার জন্য সিন্ডিকেটের লোক বসে থাকে।’
ঢাকা-বগুড়া-রংপুর রুটে চলাচলকারী আবুল কাশেম নামের এক বাসচালক বলেন, ‘পুলিশের অভিযান শুরু হওয়ার পর চাঁদাবাজরা চাঁদাবাজির পয়েন্ট পরিবর্তন করেছে। আগের নির্দিষ্ট অবস্থানে না থেকে অন্য স্থানে চাঁদা আদায়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। আগে বাস থামিয়ে টাকা হাতে দিতে হতো। এখন টাকা কাগজে পেঁচিয়ে রাখা হয়। নির্দিষ্ট স্থান অতিক্রমের সময় ছুঁড়ে মারতে হয়। সিন্ডিকেটের লোকজন সঙ্গে সঙ্গে তা নিয়ে যায়। উত্তরবঙ্গ সড়কে চলাচলকারী প্রতিটি বাসকে দৈনিক গড়ে ১২০০ থেকে ১৮০০ টাকা, আবার কোথাও দুই হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয় বলে একাধিক চালক অভিযোগ করেছেন।
সিএনজি-অটোরিকশারও নিস্তার নেই। চালকরা বলেন, পরিবহন নেতারা এবং পুলিশ যতই চাঁদা না দেয়ার কথা বলুক, তা আসলে কাগজে-কলমে। বাস্তবে চাঁদা না দিলে রাস্তায় গাড়ি চালানো যাবে না। এমনকি সিএনজিকেও প্রতিদিন বিভিন্ন খাতে গড়ে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক আব্দুল মান্নান বলেন, ‘প্রতিদিন সড়ক-মহাসড়কে সিএনজি নিয়ে বের হলেই মালিক সমিতির নিয়োগ দেয়া ব্যক্তিকে ১২০টাকা চাঁদা দিতে হয়। হাইওয়ে পুলিশসহ সব মহলকে ম্যানেজ করতেই নিয়মিত এই চাঁদার টাকা ব্যয় করা হয় বলে শুনেছি।’ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক হাসেম আলী বলেন, ‘আগে প্রতিদিন তাদের কাছ থেকে ৬০ টাকা করে চাঁদা নেয়া হতো। তবে এখন ৩০ টাকা করে নেয়া হচ্ছে।’
ট্রাক চালক মতিউর রহমান জানান, মালবাহী ট্রাকে যাত্রীবহন ঠিক না। কিন্তু মহামারি করোনার কারণে দূরপাল্লার অধিকাংশ বাস বন্ধ। পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে আসা লোকজন কর্মস্থলে যাচ্ছেন। পরিবহন সঙ্কটে যাত্রীদের চাপ থাকায় পরিবহন করছেন। টার্মিনাল থেকে যাত্রী ওঠানোর কারণে এবং শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য ‘কল্যাণ চাঁদা’ হিসেবে প্রতি ট্রাক থেকে ৬০০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে।
সড়কে চলাচলরত পণ্যবাহী ট্রাক থেকে প্রতিদিনই চাঁদা আদায় করে পুলিশ। বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. রুস্তম আলী খান এ তথ্য জানিয়ে বলেন, ‘এর প্রতিবাদ করলে হয়রানি আরও বেড়ে যায়। সড়ক-মহাসড়কে ট্রাক চলাচল করতে গিয়ে একেকটি স্পটে ৫০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। এই চাঁদা যেমন হাইওয়ে পুলিশ নেয়, তেমনি মালিক ও শ্রমিক সমিতির নামেও আদায় করা হয়। পণ্যবাহী ট্রাক ট্রাফিক জ্যামে পড়লে একটি গ্রুপ আছে যারা ভাঙচুরের হুমকি দিয়েও চাঁদাবাজি করে থাকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বগুড়া থেকে ঢাকায় আসতে একটি ট্রাককে অন্তত ১২ জায়গায় চাঁদা দিতে হয়। এগুলো নির্দিষ্ট চাঁদা। এর ওপর হঠাৎ চাঁদাও রয়েছে। গড়ে একটি ট্রাককে কমপক্ষে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা চাঁদা গুনতে হয়।’জেলা বাস-মিনিবাস, কোচ ও মাইক্রোবাস পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মতি বলেন, ‘মহাসড়কে কোনো চাঁদা আদায় করা হয় না। শুধু শ্রমিক ফেডারেশনের নির্ধারিত শ্রমিকদের জন্য কল্যাণ চাঁদা নেয়া হয়। এছাড়া কোনো চাঁদাবাজির সঙ্গে আমার সংগঠনের কোনো শ্রমিক নেতারা জড়িত নেই।’
বগুড়ার পুলিশ সুপার (এসপি) আলী আশরাফ ভূঞা বলেন, ‘সড়ক-মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে গাড়ি থেকে অবৈধভাবে চাঁদা আদায়ের বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযান অব্যাহত রেখেছে। অনেকে গ্রেফতার হয়েছে। মামলাও হয়েছে। এখন নতুন করে কেউ চাঁদা আদায়ের জন্য পথে নামলে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।’ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, ‘পরিবহন মালিক-শ্রমিক একত্রে বসে অবৈধ চাঁদাবাজি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অবৈধ চাঁদা না ওঠানোর জন্য সবাইকে নির্দেশনা দিয়েছি। আমাদের সংগঠনের কেউ কোথাও চাঁদা তুলছে না। বাইরের কেউ তুলে থাকলে তার দায় আমরা নেব না।’


বিজ্ঞাপন