গাঁজার নির্যাসের কেক-এলএসডি বিক্রি করছে শিক্ষার্থীরা!
নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গাঁজার নির্জাস দিয়ে কেক তৈরী করে বাজারজাত করা হচ্ছে। এছাড়া ‘এলএসডি’ নামে নতুন ধরণের মাদক বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলের শিক্ষার্থীদের সেবন করার চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যার মামলার তদন্ত করতে গিয়ে নতুন ধরণের মাদক ও গাঁজার নির্যাস দিয়ে কেক তৈরী করে বাজারজাতের তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা।
জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন মেধাবী তরুণ শিক্ষার্থী গাঁজা পাতার নির্যাস দিয়ে কেক তৈরির প্রক্রিয়া আবিষ্কার করে। এরপর তারা ফেবসুক গ্রুপসহ অনলাইনে বিক্রি করছেন। আর একইসঙ্গে ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে সর্বনাশা মাদক লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাই-ইথ্যালামাইড বা এলএসডিও বিক্রি করে। (ইবঃঃবৎ নৎধৎিু ধহফ নবুড়ঁহফ) (আরও ভাল ব্রোয়ারি এবং রেয়ন্ড) নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ খুলে সেখানে গাঁজা পাতার নির্যাস দিয়ে কেক তৈরি করে মাদক হিসেবে বিক্রি করত তরুণদের একটি দল। এই গ্রুপে ১ হাজার সদস্য রয়েছে।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী শিক্ষার্থী প্রকাশ্যে ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা কেটে আত্মহত্যা করেন। এই ঘটনায় শাহবাগ থানায় মামলা হয়। উক্ত মামলাটির তদন্ত করছে ডিবি। তদন্তের ভিত্তিতে সন্দেহভাজন কয়েকজন তরুণকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়। আর আটককৃতদের বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে নতুন মাদক ব্যবসার চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়। সেই তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে তিনজনকে আটক করে। আর তাদের কাছ থেকে নতুন মাদক এলএসডির ২০০টি ব্লট উদ্ধার করে। এসব মাদক অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ কাগজের টুকরো বা (ব্লট) বলা হয়। আর প্রতিটি ব্লটের দাম ৩ থেকে ৪ হাজার টাকায় বিক্রি করছে। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- সাদমান সাকিব (রূপল), আসহাব ওয়াদুদ (তুর্য) ও আদিন আশরাফ।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গ্রেফতারকৃত সাদমান সাকিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর বহিষ্কৃত ছাত্র। বর্তমানে তিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ শেষবর্ষে পড়ছেন। তিনি মূলত বছরখানেক আগে টেলিগ্রাম অ্যাপের মাধ্যমে নেদারল্যান্ডস থেকে এই মাদক অর্ডার করেন। এরপর পে-পালে এর মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করে পার্সেলের মাধ্যমে এই মাদক দেশে আনেন তিনি। আর প্রতিটি ব্লট ৮০০-১০০০ টাকায় কেনেন।
তবে গ্রেফাতারকৃত সাদমানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় থেকে বহিষ্কার করা হয়নি বলে ডিবির কাছে স্বীকার করেছেন। তিনি এক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর তিনিই ঢাবি ছেড়ে এসেছেন। সাদমানসহ তিনবন্ধু ‘আপনার আব্বা’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ খুলে সেখান থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছে এলএসডি নাম মাদক বিক্রি করতেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এলএসডির ইতিহাস হচ্ছে, লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাই-ইথ্যালামাইড বা এলএসডি এক ধরণের তরল পদার্থ। যা ১৯৩৮ সালে সুইস রসায়নবিদ আলবার্ট হফম্যান প্যারাসাইটিক ফাঙ্গাস নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এলএসডি আবিষ্কার করেন। আবিষ্কারের প্রথমদিকে এলএসডি ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তবে ওষুধটি মস্তিষ্কের ক্ষতি করে বলে একে নিষিদ্ধ করা হয়। এলএসডি অত্যন্ত দামি একটি মাদক। সাধারণত ব্লটিং পেপারের ওপরে এই তরল মাদক ফেলে সেই কাগজ শুঁকে নেশা করে মাদকাসক্তরা। এলএসডি মাখা এক টুকরো ব্লটিং পেপারের দাম ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা।
মাদকদ্রব্যের ল্যাব বিষেশজ্ঞ জানান, এই মাদক অনেক দামী। আমেরিকান ধনাঢ্য ব্যক্তিরা ব্যবহার করেন। বাংলাদেশে প্রথম ধরা পড়ে ২০১৯ সালের জুলাই মাসে। একজন সামরিক কর্মকর্তার ছেলেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তিনি ক্যানাডা থেকে এনেছিলেন। এ ঘটনায় কাফরুল থানায় ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই ২১ নম্বর মামলা দায়ের করা হয়েছিল। তিনি আরো জানান, সাধারণত এলএসডি নেওয়ার পর একজন মানুষ চোখ বন্ধ করেও দেখতে পায়। তার দেখা এসব দৃশ্য সবসময় বাইরের পৃথিবী বা স্মৃতি থেকে আসে না বরং তাদের কল্পনাশক্তি অনেক বেড়ে যায়। ‘এলএসডি’র প্রভাবে মস্তিষ্কের অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।
তিনি আরো জানান, এলএসডি নেওয়ার পর প্রকৃতি ও বাইরের জগতের সঙ্গে এমন এক সম্পর্ক অনুভূত হয় যাকে অনেকসময় ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক রূপ দেওয়া হয়ে থাকে। এই মাদকের প্রভাব কেটে গেলেও ওই রকম অনুভূতি থেকে যেতে পারে। আবার এই মাদক ব্যবহার করলে মানুষের স্মৃতির ভা-ার খুলে যায়। নেশার চূড়ান্ত পর্যায়ে কেউ কেউ মাতৃগর্ভের স্মৃতিও মনে করতে পারেন। তবে সেসব স্মৃতির ভার অধিকাংশ মানুষই সহ্য করতে পারেন না। ফলে মস্তিষ্ক বিকৃতির প্রবল সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া অধিকাংশ মাদকগ্রহণকারীই স্মৃতির চূড়ান্ত স্তরে প্রবেশের আগে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এলএসডি গ্রহণকারী অনেকেই এমন দাবি করেন। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, হ্যালুসিনেশনই এসব অনুভূতির মূল কারণ। ভারতের অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পর এই মাদকটি আলোচনায় আসে। তার বিরুদ্ধে এই মাদক নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) একেএম হাফিজ আক্তার এলএসডির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেন, এটি ব্যবহার করলে যে কারো মাথা ভার হয়ে যাবে। হেলোজেনিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। কেউ যদি গান শোনে তার সামনে গানের মিউজিকগুলো বিভিন্ন রংয়ের মতো ঘুরতে থাকবে। সেবনকারী অত্যন্ত হিংসাত্মক ও আক্রমণাত্মক আচরণ করে। একটি এলএসডি ব্লট সেবন করলে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত এর প্রতিক্রিয়া থাকে। অতিরিক্ত সেবনে ২০ ঘণ্টা পর্যন্তও প্রতিক্রিয়া হয়।
এগুলো দেখতে ডাক টিকিটের মতো। সেবনকারীরা ঠোঁটের নিচে এলএসডি রেখে দিত। এলএসডি নতুন মাদক, ব্যয়বহুল এবং অতিরিক্ত ক্ষতিকারক। বাংলাদেশে প্রথম আমরা এলএসডির সন্ধান পাই। এই ঘটনায় তিন তরুণকে গ্রেফতারের পর গাঁজার কেক তৈরি ও বিক্রির তথ্য পাওয়া গেছে। তবে এই কেক এখনো উদ্ধার করা যায়নি। এর সেবনকারী নিজেকে অনেক শক্তিশালী এবং সে উড়তে পারে ভাবে। তার অতীত স্মৃতি চলে আসে। এটি সেবনের পর তারা মনে করে তারা ট্রেনকেও ধাক্কা দিতে পারবে। যারা নেদারল্যান্ডস থেকে মাদকটি বাংলাদেশে পাঠিয়েছে তাদের শনাক্তে পুলিশ সদর দফতরের এনসিবি বিভাগে চিঠি দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি হাফিজুর রহমান নামে ঢাবি শিক্ষার্থী আত্মহত্যার ঘটনায় তদন্ত শুরু করে ডিবি। হাফিজের বন্ধুরা বলছেন, হাফিজ একটি নতুন ও অদ্ভুত ধরণের মাদকে আসক্ত ছিল। এরপরই এলএসডির বিষয়ে তথ্য পেয়ে অভিযান চালিয়ে নুতন মাদকের তথ্য পায় ডিবি।