সালমা জেবুননেসা : বিভিন্ন ব্রেইন স্টাডিতে দেখা গেছে, প্রশংসা ও আর্থিক পুরস্কারের প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়া একই রকম হয়। প্রশংসা শুনতে আমাদের ভালো লাগে।
বিশেষ ধরনের কিছু প্রশংসার ফলাফলও খুব কাজের হয়।
বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও প্রশংসার প্রভাব আছে। তবে বিবেচনার সাথে প্রশংসা করতে হবে, যাতে তা বাচ্চাদেরকে নেতিবাচক ভাবে উদ্বুদ্ধ না করে। তাহলে ঠিক কীভাবে বাচ্চাদের প্রশংসা করবেন?
বাচ্চাদেরও সমর্থন ও উৎসাহের প্রয়োজন আছে
প্রশংসা ছাড়া আরো অনেক ভাবেই বাবা-মায়েরা বাচ্চাদের প্রতি তাদের সমর্থন, স্বীকৃতি, উৎসাহ ও ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারেন।
বাবা-মায়ের এই সমর্থন তারা যে কোনো সময়েই পাবে সেটা বাচ্চাদের জানা খুবই দরকার। রাগ, হতাশা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে তা সহায়ক হবে।
আপনার পরিবার প্রশংসাকে যেভাবেই দেখুক না কেন, পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে উষ্ণতা ও সমর্থন প্রকাশে এর তুলনা হয় না। আর শুধুমাত্র সাফল্যেই না, আপনার সন্তানের ব্যর্থতায়ও তাকে উৎসাহ দিয়ে তার পাশে থাকুন।
মিথ্যা প্রশংসা থেকে বিরত থাকুন
বাচ্চারা ভাবতে পারে আমরা তাদেরকে করুণা করছি। মিথ্যা প্রশংসার কারণে তারা মনে করতে পারে আমরা তাদের আবেগ-অনুভূতি বুঝতে পারছি না।
খুব ছোট বাচ্চারা সাধারণত এসব বোঝে না। কিন্তু যারা একটু বড় হয়েছে, আমাদের কাজকর্ম খেয়াল করে, তারা প্রশংসার মিথ্যাটুকু ধরতে পারে। বেশির ভাগ বাচ্চার ক্ষেত্রেই ৪ থেকে ৫ বছর বয়সেই এই পরিবর্তন দেখা দেয়।
সবচাইতে ভালো’ ধরনের অতিরঞ্জিত প্রশংসার ব্যাপারে সতর্ক থাকুন
“তুমি পারফেক্ট! এই কাজটা তোমার মতো করে আর কেউ করতে পারবে না!”―এ ধরনের অতিরঞ্জিত প্রশংসার ফলাফল সাধারণত ভালো হয় না, তা যত আন্তরিকভাবেই করা হোক না কেন।
এতে উচ্চাশা তৈরি হয়। তখন তাদের সামনে নতুন কোন বাঁধা আসলে তারা পিছপা হয়, কারণ তারা ব্যর্থ হওয়ার ঝুঁকি নিতে চায় না। অতিরঞ্জিত প্রশংসার কারণে ব্যর্থতাকে তারা ভয় পায়। ব্যর্থতা থেকে যে শিক্ষা নেয়া যায় সেটা তারা আর মানতে পারে না।
বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গেছে, যে বাচ্চাদের আত্মবিশ্বাস কম তারা এই সমস্যায় বেশি ভোগে। গবেষকরা ১২০ জন স্কুল ছাত্রকে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে উদ্বেগজনক ফলাফল পেয়েছেন। যেসব বাবা-মায়েরা সন্তানের অতিরঞ্জিত প্রশংসা করে, তাদের সন্তানদের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিক হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
সহজ কিছু অর্জন করলে প্রশংসা করা থেকে বিরত থাকুন
বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাচ্চারা সবকিছুর অর্থ বুঝতে শেখে। ঠিক কোন বয়স থেকে বাচ্চারা বুঝতে শেখে তা বলা কঠিন, কারণ তা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে।
যেসব পরিবারে প্রশংসা করা খুবই সাধারণ, সেখানে বাচ্চারা অনেক অল্প বয়স থেকেই জানে কোন প্রশংসাটি যথার্থ আর কোনটি অদরকারি। অদরকারি প্রশংসা তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করে না।
বিশেষ প্রতিভার জন্য প্রশংসা করা থেকে বিরত থাকুন
প্রতিভা জিনিসটা সবসময় বিশেষ সুবিধা দেয়। যাদের তা থাকে না, তারা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। বিশেষ কোনো ক্ষমতা বা দক্ষতার জন্য বাচ্চাদের প্রশংসা করলে তারা সতর্ক হয়ে ওঠে। তখন সব ধরনের ঝুঁকি এড়িয়ে চলে। কঠোর পরিশ্রম ছাড়া কেবল ট্যালেন্ট দিয়ে সবকিছু করা সম্ভব না সেটা তারা বুঝতে পারে না। ফলে ব্যর্থতার পেছনে প্রতিভার অভাবকেই দায়ী করে তারা।
কোনো ভুল করলে তাদের মনোবল একেবরে ভেঙে পড়ে। ভুল থেকে শিক্ষা নিতেও তারা অনীহা প্রকাশ করে।
তাই বিশেষ প্রতিভার জন্য বাচ্চাদের প্রশংসা না করাই ভালো। যেসব বিষয় তাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে, যেসব বিষয় তারা চাইলেই পরিবর্তন করতে পারবে, সেসব বিষয়েই প্রশংসা করুন।
অতিরিক্ত প্রশংসা করবেন না
বাচ্চাদের পছন্দের কাজে উৎসাহিত করতে তাদের প্রশংসা করা খুবই কার্যকর উপায়। তবে অতিরিক্ত প্রশংসা না করাই ভালো। বাচ্চারা নিজের পছন্দের কোনো কাজ করার সময় প্রতিবারই যদি আপনি তার প্রশংসা করেন, তাহলে সেই কাজে তাদের আগ্রহ কমে আসতে পারে।
অন্য বাচ্চাদের সাথে তুলনা করে প্রশংসা করা থেকে বিরত থাকুন
সমবয়সী বন্ধুদের চেয়ে ভালো করার জন্য বাচ্চাদের প্রশংসা করাকে আপাতদৃষ্টিতে ভালো মনে হতে পারে। তাছাড়া অনেক রিসার্চেও দেখা গেছে, অন্যের সাথে তুলনা করে প্রশংসা করলে বাচ্চাদের কাজের আগ্রহ ও আনন্দ বৃদ্ধি পায়।
তবে অন্যের সাথে তুলনা করে প্রশংসা করার ক্ষেত্রে দুইটা সমস্যা হয়।
প্রথমটা হলো, যতদিন বাচ্চারা অন্যের আগে কোনো কাজ করবে বা অন্য সবার চেয়ে ভালো করবে, ততদিনই এই ধরনের প্রশংসা তাকে উৎসাহ দিবে।
দ্বিতীয় সমস্যা হলো, এই ধরনের প্রশংসার ফলে বাচ্চারা প্রতিযোগিতাকে বেশি গুরুত্ব দেয়, কোনো কিছু ভালোভাবে শেখার চেয়ে।
অন্যের চেয়ে এগিয়ে থাকাকে বেশি গুরুত্ব দিলে বাচ্চারা কোনো কাজের জন্য সহজাত উৎসাহ অনুভব করে না। তারা অন্যের চেয়ে ভালো সেটা যে কাজে প্রমাণ করা যায় শুধু তাতেই তারা আগ্রহ পায়। তাছাড়া তারা প্রতিযোগিতায় এতটাই ডুবে যায় যে তারা কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না, নতুন কিছু শেখার সুযোগ কাজে লাগায় না। নতুন কিছু একটা করে ব্যর্থতার ঝুঁকি নিতে অনীহা প্রকাশ করে।।