হলি আর্টিজানে হামলা উচ্চ আদালতে আটকে আছে বিচার

আইন ও আদালত এইমাত্র

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি ও রেস্টুরেন্টে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পাঁচ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। কিন্তু দীর্ঘ এই পাঁচ বছরেও শেষ হয়নি এ মামলার বিচার। ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনাল এই মামলায় ৭ আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন। এরপর আসামিরা সবাই জেল আপিল করে। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালের রায়ে খালাস পাওয়া একজনের বিরুদ্ধে আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এরপর প্রায় ১৯ মাস পেরিয়ে গেলেও বিচারিক কার্যক্রমের কোনও অগ্রগতি নেই। উচ্চ আদালতে গিয়ে এক প্রকার থমকে আছে হলি আর্টিজানে ভয়াবহ হামলা মামলা বিচার।


বিজ্ঞাপন

জানতে চাইলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এ কে এম আমীন উদ্দিন বলেন, ‘গুলশানের হলি আর্টিজান মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের পেপারবুক তৈরি হয়েছে। এটি এখন আদালতে উঠবে। এর পাশাপাশি কেউ যদি আপিল করে থাকে, সেটি ব্যক্তিগত আইনজীবী বা জেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমেই হোক না কেন, তা শুনানি হবে। শুনানি শেষে উচ্চ আদালত যে নির্দেশনা বা আদেশ দেবেন, তাই প্রতিপালন করা হবে।’

আদালত ও জেল সূত্রে জানা গেছে, গুলশান হামলা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে তিন জন— মামুনুর রশীদ রিপন, রাকিবুল ইসলাম রিগ্যান ও আসলাম হোসেন র‌্যাশ ২০১৯ সালের ৪ ডিসেম্বর জেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে উচ্চ আদালতে আপিল করে। এছাড়া বাকি চার আসামি— হাদিসুর রহমান সাগর, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব ওরফে রাজীব গান্ধী, আব্দুস সবুর খান ও শরিফুল ইসলাম খালিদ ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর খালাস চেয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করেছে। একই দিনে ডেথ রেফারেন্স অনুমোদনের জন্যেও নথিপত্র উচ্চ আদালতে পাঠানো হয়।

আদালত সূত্র জানায়, ট্রাইবুন্যালের রায়ে মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান নামে চার্জশিটভুক্ত যে আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে, রাষ্ট্রপক্ষ সেই রায় পুনর্বিবেচনার জন্য উচ্চ আদালতে আপিল করেছে। তবে গত ১৭ মাসে কোনও আপিলেরই শুনানি হয়নি। উচ্চ আদালতের একজন কর্মকর্তা জানান, এই আপিলের আবেদন শুনানির জন্য এখনও পর্যন্ত কোনও বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। জেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে যারা আপিল করেছে, তাদের জন্য আদালত সলিসিটর অফিসের মাধ্যমে একজন আইনজীবী নিয়োগ করে দেবে। তারপর এ বিষয়ে শুনানি হবে।

আদালতের ওই কর্মকর্তা জানান, তবে ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য ২০২০ সালের ১৬ আগস্ট আলোচিত এ মামলার পেপারবুক প্রস্তুত হয়ে হাইকোর্টে পৌঁছায়। এক হাজার ৯০০ পৃষ্ঠার এই পেপারবুক শুনানির জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। এখন শুধু শুনানির দিন নির্ধারণের অপেক্ষা। করোনা পরিস্থিতির কারণে এখনই মামলাটির শুনানি শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না।

কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক গিয়াস উদ্দিন বলেন, হলি আর্টিজান মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে রিগ্যান, রিপন ও আসলাম কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে রয়েছে। বাকিরা রাজশাহী ও চট্টগ্রাম কারাগারে রয়েছে।’

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাত পৌনে ৯টার দিকে গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের পাঁচ নম্বর প্লটের হোলি আর্টিজান বেকারি ও রেস্টুরেন্টে নারকীয় হামলায় চালায় জঙ্গিরা। জঙ্গিদের হামলায় দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২২ জন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ৯ জন ইতালির নাগরিক, ৭ জন জাপানি, একজন ভারতীয় নাগরিক, একজন বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিক। বাকি দুজন হলেন বাংলাদেশি নাগরিক। জঙ্গিরা নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর রাতভর ওই বেকারিতে বেশ কয়েকজন অতিথি ও বেকারির কর্মচারীদের জিম্মি করে রাখে। পরদিন সকালে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোর নেতৃত্বে পুলিশ ও র‌্যাবের যৌথ অভিযানে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালিত হয়। জিম্মি থাকা অন্তত ৩৫ জনকে উদ্ধার করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।

গুলশানের এই ঘটনায় হলি আর্টিজানের দুই জন শেফ নিহত হন। এদের একজন সাইফুল ইসলাম চৌকিদারকে প্রথমে সন্দেহভাজন জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও পরে মামলার তদন্তে তার সঙ্গে জঙ্গিদের কোনও সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। এছাড়া জাকির হোসেন শাওন নামে আরেকজন বেকারি কর্মচারী হামলার পর পালিয়ে আসলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাকে হেফাজতে নেয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক সপ্তাহ পর ওই বছরেরই ৮ জুলাই মারা যান তিনি। শাওনের পরিবারের অভিযোগ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর পর তার শরীরে অসংখ্য জখমের চিহ্ন ছিল।

বিশ্বব্যাপী আলোচিত এই হামলার ঘটনায় সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডোর নেতৃত্বে পুলিশ ও র‌্যাবসহ যৌথ বাহিনীর অপারেশনে পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া গুলশান থানার মামলাটি তদন্ত করে ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট- সিটিটিসি। এই হামলায় মোট ২১ জনের সম্পৃক্ততা পায় তদন্ত সংস্থা সিটিটিসি। এর মধ্যে পাঁচ জঙ্গি ঘটনাস্থলেই মারা যায়। এছাড়া হামলার পরবর্তী পুলিশ ও র‌্যাবের বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয় আরও আট জন। জীবিত বাকি ৮ জনকে আসামি করে ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।

চার্জশিটভুক্ত আট আসামিরা হলো- জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র‌্যাশ, হাদিসুর রহমান সাগর, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, আব্দুস সবুর খান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ, মামুনুর রশিদ রিপন ও মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান। চার্জশিটভুক্ত আসামিদের মধ্যে মামুনুর রশিদ রিপন ও শরিফুল ইসলাম খালিদ ছাড়া বাকি ছয় জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এ মামলার চার্জশিট দেওয়ার সময় রিপন ও খালিদ পলাতক ছিল। পরে এলিট ফোর্স র‌্যাব ২০১৯ সালের ১৯ জানুয়ারি গাজীপুর থেকে মামুনুর রশীদ রিপন ও ২৫ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে শরীফুল ইসলাম খালিদকে গ্রেফতার করে।

মামলার চার্জশিটে বলা হয়েছে, আলোচিত গুলশান হামলায় জড়িত বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত কানাডিয়ান নাগরিক ও হামলার মূল পরিকল্পনকারী তামিম আহমেদ চৌধুরী, নব্য জেএমবির নুরুল ইসলাম মারজান, সরোয়ার জাহান, তানভীর কাদেরী, বাশারুজ্জামান চকলেট, মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম, মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান ও রায়হানুল কবির রায়হান বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছে। হামলার সময়ই কমান্ডো অভিযানে নিহত হয়েছিল পাঁচ জঙ্গি— রোহান ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বের, শফিকুল ইসলাম উজ্জল ও খায়রুল ইসলাম পায়েল।

আদালত সূত্র জানায়, আলোচিত এই হামলার মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়ার পর ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গঠন করে। ২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর এই মামলার প্রথম সাক্ষ্য নেওয়া হয় বাদী এসআই রিপনের। এরপর ধারাবাহিকভাবে মোট ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১৩ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। ২০১৯ সালের ২৭ অক্টোবর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিটিটিসির পরিদর্শক হুমায়ূন কবিরের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে আদালত ২৭ নভেম্বর রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণ করেন।

২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান আট আসামির মধ্যে সাত জনকে ৬(২)(অ) ধারায় মৃত্যুদণ্ড ও প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হলো— জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র‌্যাশ, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, আব্দুস সবুর খান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন। আদালতের রায়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অন্য ধারাতেও ভিন্ন ভিন্ন সাজার আদেশ দেওয়া হয়। তবে আদালত মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে সকল ধারা থেকেই খালাস দেন।