পোড়া লাশের অপেক্ষায় স্বজনরা

এইমাত্র জাতীয়

ডিএনএ পরীক্ষার স্যাম্পুল দিতে স্বজনদের মর্গে ভীড়


বিজ্ঞাপন

 

বিশেষ প্রতিবেদক : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে কারখানার অগ্নিকান্ডে পুড়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য স্বজনদের নমুনা সংগ্রহ করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
এদিকে ঢামেক মর্গের মরচ্যুয়ারিতে অগ্নিকান্ডে নিহত সকল লাশ রাখার জায়গা সংকুলাণ না হওয়ায় ১৫টি লাশ আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের এ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। আর ২৫টি লাশ রাখা হয়েছে ঢামেক মর্গে এবং হাসপাতালের জরুরী বিভাগের মর্গে রাখা হয়েছে ৮টি লাশ। এসব লাশের ডিএনএ পরীক্ষার জন্য শনিবার বিকাল পর্যন্ত ৩৮ জনের লাশ সনাক্ত করতে ৫২ জন স্বজনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ডিএনএ পরীক্ষক মো. মাসুদ রাব্বি সকালের সময়কে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। আর ডিএনএ পরীক্ষার জন্য স্বজনদের নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) মর্গে।
অপরদিকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড লিমিটেডের জুস কারখানায় অগ্নিকান্ডের ঘটনায় গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবুল হাসেমসহ আটজনকে গ্রেফতার করেছে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ।
ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান গণমাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে আবুল হাসেমের চার ছেলে হাসিব বিন হাসেম, তারেক ইব্রাহীম, তাওসীব ইব্রাহীম ও তানজীম ইব্রাহীমও রয়েছেন। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহান শাহ আজাদ, হাসেম ফুড লিমিটেডের ডিজিএম মামুনুর রশিদ ও এডমিন প্রধান সালাউদ্দিন রয়েছে। রূপগঞ্জের ভুলতা ফাঁড়ির ইন্সপেক্টর নাজিম উদ্দিন বাদী হয়ে আটজনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় গ্রেফতারকৃদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করে পুলিশ। শুনানী শেষে গ্রেফতারকৃত আট আসামির প্রত্যেকের চারদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। শনিবার বিকেলে শুনানি শেষে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফাহমিদা খানমের আদালত এ আদেশ দেন।

শনিবার সকালে ঢামেক মর্গে দেখা যায়, নিহতদের লাশ শনাক্ত করতে সকাল থেকেই স্বজনেরা মর্গের সামনে ভিড় করেছেন। তবে নিহতদের লাশের জন্য ২১ থেকে ৩০ দিন পর্যন্ত লাশের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ফরেনসিক বিভাগ বলছে, অগ্নিকান্ডে নিহতদের লাশ খালি চোখে চেনার উপায় নেই, তাই শনাক্তে এখন ভরসা ডিএনএ টেস্ট করা। আর এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত লাশ পেতে নিহতদের স্বজনদের অপেক্ষা করতে হবে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে শনিবার বেলা ১২টা পর্যন্ত ডিএনএ শনাক্তে ২৫ লাশের জন্য ৩৫ জন স্বজনের স্যাম্পল সংগ্রহ করা হয়েছে। আর লাশ হস্তান্তরের যেহেতু সময় লাগবে, ততোদিন লাশগুলো মর্গে ফ্রিজিং করে রাখা হবে।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (ফরেনসিক) রোমানা আক্তার সকালের সময়কে জানিয়েছেন, নিহত শ্রমিকদের শনাক্তে তাদের স্বজনদের স্যাম্পল সংগ্রহ শুরু করা হয়েছে। এসব স্যাম্পলের প্রোফাইলিং করে নিহত শ্রমিকদের ডিএনএ’র সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে। এরপর যাদের সঙ্গে ডিএনএ ম্যাচ করবে তাদের কাছে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লাশ হস্তান্তর করা হবে। প্রোফাইলিংয়ের জন্য কোন ধরণের স্বজনদের নমুনা নেওয়া হচ্ছে তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্যাম্পল নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা বাবা-মাকে প্রথমে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। আর বাবা-মা না থাকলে ভাইবোন, সন্তানদের অগ্রাধিকার দিয়ে স্যাম্পল সংগ্রহ করা হচ্ছে।
অপরদিকে শনিবার সকাল থেকেই সেজান জুস কারখানা ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে নিহত শ্রমিকদের স্বজনদের ভিড় রয়েছে। কারখানা ও হাসপাতাল দৌড়াদৌড়িতে ক্লান্ত মানুষগুলো এবার লাশের অপেক্ষায় মর্গের সামনে সময় গুণছেন। সান্ত¡না হিসেবে নিহতের লাশটি সঙ্গে নিয়ে শেষবারের মতো বাড়ি ফিরতে চান তারা। তবে তাদের স্বজনদের লাশ কীভাবে পাওয়া যাবে, তা তারা জেনেছেন। তারপরও মর্গ ছেড়ে যেতে চাইছেন না। তারা মর্গের বাইরে অবস্থান করছেন।
এমনই একজন শ্রমিকের বাবা সুজন মিয়ার সঙ্গে কথা হয় ঢামেক মর্গে। তাদের বাড়ি কিশোরগঞ্জে। তার মেয়ে ফাতেমা রূপগঞ্জের কারখানায় চাকরি করতেন। অগ্নিকান্ডের পর থেকে তার মেয়ের খোঁজ পাচ্ছেন না তিনি। তিনি পরিবার নিয়ে রূপগঞ্জেই থাকতেন। অগ্নিকান্ডের পর হাসপাতাল, আর কারখানার সামনে দৌড়াদৌড়ি করছেন। তিনি এখন নিশ্চিত হয়েছেন, তার মেয়ে আর বেঁচে নেই। এখন মেয়ের লাশটা দাবি করেছেন। সুজন মিয়ার মতো অসংখ্য মানুষ তাদের স্বজন, সন্তান, বাবা ও মা খুঁজছেন এখনও।
এছাড়া ভোলার চরফ্যাশন থেকে ফজলুল হক তার একমাত্র সন্তান মো. হাসনাইনের মরদেহ শনাক্ত করতে ঢামেক মর্গে এসেছেন। তিনি জানান, আগুন লাগার পর থেকে তার ছেলে হাসনাইনের খোঁজ পাচ্ছেন না। তার ছেলের মোবাইলও ছিল না। তাদের এলাকার রাকিব নামে এক ছেলে হাসনাইনের সঙ্গে কারখানায় কাজ করতেন। রাকিবের ফোনেই তিনি ছেলের সঙ্গে কথা বলতেন। আগুন লাগার পর থেকে রাকিবও নিখোঁজ রয়েছে। হাসনাইন ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার দক্ষিণ আমিনাবাদ কবি মোজাম্মেল হক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। তার বাবা ফজলুল হক কৃষক। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে কাজ করতে পারছিলেন না। বাবার কষ্ট দেখে হাসনাইন নিজেই নারায়ণগঞ্জে কাজ করতে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। মর্গে হাসনাইনের খালা লাইজু বেগম জানান, হাসনাইনের বাবা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। তার পেটে টিউমার হয়েছে। কোনো কাজ করতে পারেন না। তার বড় দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। মা নাজমা বেগম গৃহিণী।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার বিকালে রূপগঞ্জের হাসেম ফুডস লিমিটেড কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। ওই আগুনের ঘটনায় প্রথম দিন তিনজনের মৃত্যু হয়। আহত হন অর্ধশত শ্রমিক। ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের ১৮টি ইউনিট ২০ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর শুক্রবার ওই ভবনের চারতলা থেকে ২৬ নারীসহ ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার করে। সব মিলিয়ে ৫২টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আগুনে লাশ পুড়ে যাওয়ায় পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। ফলে লাশগুলো উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ টেস্টের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।