ভাড়া ডাকাতির মহোৎসব

এইমাত্র জাতীয়

* নাড়ীর টানে বাড়ীর পানে ছুটছে মানুষ
*ফেরি-লঞ্চে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত
*শিমুলিয়ায় উপচেপড়া ভিড়

বিশেষ প্রতিবেদক : বড্ড আবেগী এক জাতি আমরা। পৃথিবীর কোথাও ঈদের সময় এমন অবস্থা হয় কিনা আমাদের জানা নেই। হয়তো এই পৃথিবীতে বিরল এক অবস্থা। আর কেউ জানে না এই অবস্থার কথা, আর কেউ দেখেনি এই পরিস্থিতি। মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শুধু টিকেট কাটে না, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়িও যায়। মানুষ নাড়ির টান আসলেই বড্ড কঠিন এক টান। পরিবারের মায়া আর ভালোবাসা অনেক জোরালো। এই ভালোবাসা হয়তো পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের মানুষ বোঝেই না। ঈদকে সামনে রেখে ঢাকা ছাড়ছে মানুষ। শেষের দিনগুলোতে ভিড় বাড়ার শঙ্কায় মানুষ বাড়ি ফিরতে চাইলেও শনিবার সকালে যারা বের হয়েছেন, তারা যানজটে নাকাল হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
এ দিকে করোনার সংকটে কর্মহীন ও আয়-রোজগার কমে যাওয়া ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য বন্ধ করা, সকল শ্রেণীর গণপরিবহনে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে অনুসরণের জন্য পরিবহন মালিক, শ্রমিক ও মনিটরিংরের দায়িত্বরত সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে জোর দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
গত ১৫ ও ১৬ জুলাই থেকে শুরু হওয়া গণপরিবহনে ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের যাতায়াত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ শেষে শনিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রকাশকালে সংগঠনের পক্ষ থেকে এ দাবি জানানো হয়।
সংগঠনের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির ঊর্ধ্বগতিতে ‘করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে জাতীয় কমিটির’ সদস্যরা যখন দেশে কারফিউ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ঠিক তখনই সরকার মানুষের জীবন-জীবিকা ও ঈদ অর্থনীতির কথা বিবেচনা করে ১৪ জুলাই মধ্য রাত থেকে ২৩ জুলাই সকাল ৬টা পর্যন্ত মাত্র আট দিনের জন্য বিধিনিষেধ শিথিল করে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে অনুসরণের শর্তে ৬০ ভাগ বর্ধিত ভাড়া আদায় সাপেক্ষে সকল শ্রেণীর গণপরিবহন চালু করে।
এতে যাত্রী, চালক, কন্ডাক্টর ও সহকারী সকলের বাধ্যতামূলক মাস্ক পরিধান করা। অর্ধেক আসনে যাত্রী নিয়ে সকল শ্রেণীর গণপরিবহন চলাচল করা। গণপরিবহন চালুর আগে এবং শেষ গন্তব্যে পৌঁছানোর পর জীবাণুনাশক ছিটিয়ে জীবাণুমুক্ত করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়। রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন জেলার গণপরিবহন পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এ সকল শর্তাবলীর মধ্যে শুধুমাত্র মাস্ক পরিধানের বিষয়টি অধিকাংশ পরিবহনে অনুসরণ করলেও অন্যান্য শর্তাবলী মানা হচ্ছে না।
বেশিরভাগ পরিবহনে আসনভর্তি করে যাত্রী বোঝাইয়ের পাশাপাশি অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য চালাচ্ছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, সরকার গণপরিবহনের ৬০ ভাগ বর্ধিত ভাড়া আদায়ের নির্দেশনা দিলেও কোন কোন গনপরিবহনে ৩০০ থেকে ৫০০ শতাংশ পর্যন্ত বর্ধিত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
পর্যবেক্ষণকালে দেখা যায়, রাজধানীর অভ্যন্তরীণ রুটে মিরপুর-১০ থেকে নীলক্ষেত সরকার নির্ধারিত বাস ভাড়া ১৫টাকা। করোনা সংকটে ৬০ ভাগ বর্ধিত ভাড়ায় এই পথে ২৬টাকা ভাড়া আদায় করা হতো। গত দুইদিন এই পথে ৪০টাকা ভাড়া আদায় করা হয়েছে। একই পথে সিএনজি অটোরিকশায় স্বাভাবিক সময়ে ১৫০ থেকে ২০০টাকা ভাড়া আদায় করা হলেও গত দুইদিন যাবত ৩০০ থেকে ৫০০টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হয়েছে।
রাজধানীর গাবতলী মাজার রোড থেকে বাংলামটর পর্যন্ত সিটি সার্ভিসের ৮ নম্বর বাসে নিয়মিত ১৫ টাকা বাস ভাড়া আদায় করা হয়। ৬০ভাগ বর্ধিত ভাড়ায় ২৪টাকা আদায়ের কথা থাকলেও গত দুইদিন ধরে এই পথে ৩০টাকা হারেও ভাড়া আদায় করা হয়েছে। বিআরটিসি বাসে কাকলী থেকে বাংলামটর নিয়মিত ১২ টাকা ভাড়া আদায়ের স্থলে ৬০ভাগ বর্ধিত ভাড়ায় ২০টাকা আদায়ের কথা থাকলেও এই পথে ৩০টাকা ভাড়া আদায় হয়েছে এবং ফার্মগেট থেকে মতিঝিল, ফার্মগেট থেকে গুলিস্তান নিয়মিত ১০ টাকার ভাড়া আদায়ের স্থলে ৬০ ভাগ বর্ধিত ভাড়ায় ১৬ টাকা আদায়ের কথা হলেও এই পথে গত দুইদিনে ২০ টাকা ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে। মতিঝিল থেকে মিরপুর-১০, গুলিস্তান থেকে মিরপুর-১০ পর্যন্ত ২৫ টাকা নিয়মিত ভাড়া আদায়ের স্থলে এই রুটের অধিকাংশ বাসে ৬০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে। যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়া স্বাভাবিক সময়ে ৮০টাকার বাস ভাড়া গত দুইদিন ২০০ টাকা হারে আদায় হয়েছে।
এদিকে চট্টগ্রাম মহানগরীর অক্সিজেন মোড় থেকে নাজিরহাট পর্যন্ত স্বাভাবিক সময়ে ৩৫ টাকা বাস ভাড়া গত দুইদিনের বেলায় ৭০টাকা এবং সন্ধ্যার পর ১০০ টাকা পর্যন্ত আদায় হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগরীর শাহ আমানত সেতু থেকে পটিয়া স্বাভাবিক সময়ে ২৫ টাকার বাস ভাড়া গত দুইদিন দিনের বেলায় ৫০ টাকা সন্ধ্যার পর থেকে ১০০টাকা আদায় হয়েছে। এই পথে শাহ আমানত সেতু থেকে চকরিয়া স্বাভাবিক সময়ে ১০০টাকার বাস ভাড়া গত দুইদিন যাবত ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা হারে আদায় হয়েছে। এসব পথে দ্বিগুণ যাত্রী বোঝায় করে যাতায়াত করেছে প্রতিটি বাস-মিনিবাস।
এদিকে দূরপাল্লার রুট পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ঢাকা আশুলিয়া বাইপাইল মোড় থেকে রংপুর নিয়মিত পথে ৬০০টাকার বাস ভাড়া গত দুইদিন যাবত ২১০০টাকা হারে আদায় করতে দেখা গেছে। চট্টগ্রাম থেকে রংপুর ৮৫০টাকার বাস ভাড়া ২২০০ টাকা আদায় হয়েছে। চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট থেকে ভোলা-মজু চৌধুরী ঘাট ২২০ টাকা বাস ভাড়া গত দুইদিনে ৫০০ টাকা হারে আদায় হয়েছে।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম বাজার থেকে বিশ্বরোডের পদুয়ার বাজার নিয়মিত বাস ভাড়া ৫০টাকার স্থলে গত দুইদিন ১৫০ থেকে ২০০টাকা হারে আদায় করা হয়েছে। মিরসরাই থেকে মিঠাছড়া নিয়মিত ভাড়া ৫ টাকা ভাড়ার স্থলে ২০ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়েছে। মিরসরাইয়ের বারইয়ারহাট থেকে মিরসরাই নিয়মিত ভাড়া ২৫ টাকার স্থলে ৫০ টাকা বাস ভাড়া আদায় করা হয়েছে।
এ ছাড়াও রাজশাহী সদর হাসপাতাল থেকে নাটোরের বাগাতিপাড়া সরকার নির্ধারিত অ্যাম্বুলেস ভাড়া ৭২০ টাকার স্থলে ৫ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে।
অন্যদিকে নৌ-পথের বিভিন্ন রুটের লঞ্চ ও স্টিমারের পাশাপাশি খেয়াঘাটগুলোতে গত দুইদিন যাবত যাত্রী পারাপারে ভাড়া ডাকাতির মহোৎসব শুরু হয়েছে। যাত্রী প্রতি ২ টাকা ভাড়া আদায়ের স্থলে কোনও কোনও খেয়াঘাটে ১০ টাকা, কোথাও ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। বরগুনার বেতাগী-কচুয়া খেয়াঘাটে বিষখালী নদী পারাপারে ২ টাকার ভাড়ার স্থলে ১০০ টাকা ভাড়া আদায়ের চিত্র দেখা গেছে। এসব খেয়াঘাটগুলোতে গত দুইদিন যাবত যাত্রীদের কাছ থেকে মোটরবাইক পারাপারে ১০ টাকার পরিবর্তে ২০০ টাকা, বাইসাইকেল ১০ টাকার পরিবর্তে ৫০ টাকা। গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া পাঁচ টাকার পরিবর্তে ১০০ টাকা, আসবাবপত্র ১০ টাকার পরিবর্তে ৫০০ টাকা ও হালকা যানবাহনের ক্ষেত্রে সর্বনি¤œ ২০০ টাকা করে আদায় করা হয়েছে। ভোর ৫ থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত পারাপারের এক নিয়ম, কিন্তু সন্ধ্যা ৭টার পরেই ওই কোনও কোনও খেয়াঘাটে নদী পারাপারে রিজার্ভের কথা বলে যাত্রী প্রতি ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায়ের দৃশ্য দেখা গেছে।
এ ছাড়াও নৌ-পথে অধিকাংশ লঞ্চে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে গাদাগাদি করে যাত্রী বহন এবং অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে। এই অভিযোগে চাঁদপুর লঞ্চঘাটে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা এমভি ঈগল-৩ লঞ্চকে ৫ হাজার ও সোনার তরী লঞ্চকে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। সড়ক পথে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য বন্ধে বিআরটিএ ও জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে থাকলেও তাদের কার্যক্রমে এসব অনিয়ম বন্ধে তেমন কোনও প্রভাব পড়েনি।
সংগঠনের পর্যবেক্ষণে আরও দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন রুটে হিউম্যান হলার, অটো টেম্পো, অটো রিকশায় বিদ্যমান ভাড়ার চেয়ে কোথাও দ্বিগুণ আবার কোথাও তিনগুণ বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি বা অর্ধেক যাত্রী বহনের সরকারি নির্দেশনার দোহাই দিয়ে দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করলেও যাত্রী তোলার পর ভাড়া আদায় শেষে মাঝপথে গাদাগাদি করে যাত্রী তোলা হয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে দেশব্যাপী চলমান গণপরিবহনে যাত্রী, পরিবহন শ্রমিক, বচসা (গ্যাঞ্জাম), হাতাহাতি, মারামারি চলছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী করোনা সংকটে পতিত দেশের সাধারণ মানুষের ওপর গণপরিবহনগুলোর এহেন অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের জুলুম থেকে মুক্তি দিতে পরিবহন মালিক, শ্রমিক ও সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।
শিমুলিয়ায় যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় : ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে চলমান লকডাউন শিথিল হবার পর থেকে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটে যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। ফেরির চারটি পন্টুনে পণ্যবাহী ছোট বড় যানবাহনের সাথে যাত্রীচাপ রয়েছে।
শনিবার সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছোট-বড় যানবাহনে চড়ে যাত্রীরা ঘাটে উপস্থিত হয়ে ফেরি ও লঞ্চে করে পদ্মা পাড়ি দিচ্ছেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে চাপ আরো বাড়ছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডাব্লিউটিসি) শিমুলিয়া ঘাটের সহকারী উপ-মহাব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলাম জানান, নৌরুটে বর্তমানে ১৩টি ফেরি ও ৮৩টি লঞ্চ চলাচল করছে।
মাওয়া নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সিরাজুল কবির বলেন, ঘাট এলাকায় যাত্রী ও পণ্যবাহী পাঁচ শতাধিক যানবাহন পারাপারের জন্য অপেক্ষায় রয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব যানবাহন পারাপার করা হবে।


বিজ্ঞাপন