খাবারের ফ্লেভার ঘোষণায় পাউডার ভায়াগ্রার উপাদান আমদানি

অপরাধ

বেলাল হোসেন চৌধুরী : বেনাপোলে প্রথমবারের মতো অবৈধভাবে ভারত থেকে আমদানিকৃত ২০০ কেজি পাউডার ভায়াগ্রার চালান উদঘাটন ও আটক। দুটো ল্যাব পরীক্ষায় ভায়াগ্রা প্রমাণিত! বিশ্ব কাস্টমস সংস্থা WCO – World Customs Organisation এর ১৮২ সদস্য দেশকে মাদক, বিস্ফোরক ও এ ধরনের ক্ষতিকর পণ্য চোরাচালানের বিষয়ে দীর্ঘদিন সর্তকবার্তা দিলেও বাংলাদেশেই প্রথম উদঘাটিত হলো।


বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের এ অর্জন অভূতপূর্ব, কৃতিত্বপূর্ণ ও মর্যাদার। বিশ্বব্যাপী মানবসমাজের নীরব ঘাতক ভায়াগ্রার পণ্য উদঘাটনে বেনাপোল কাস্টম হাউসের বিরল প্রাপ্তি ও গৌরবের। একইভাবে এমন চোরাচালান প্রতিহতকরণ বেনাপোল স্থলবন্দর ও বেনাপোলবাসীর জন্য কৃতিত্বের।

সচরাচর উদঘাটিত পণ্য, স্বর্ণ, রৌপ্য, মুদ্রা, ফেন্সিডিল নিষিদ্ধ পণ্য আগে ধরা পড়েছিল। WCO’র নির্দেশনায় দীর্ঘ নজরদারির পর প্রত্যাশিত ফলাফল!

কাস্টম হাউসের আধুনিক কেমিক্যাল ল্যাবেরও একটি বড় সাফল্য। গোপন সংবাদ থাকায় গত অক্টোবর থেকে চালানভিত্তিক নিবিড় নজরদারী চলে আসছে সকল কার্গোর ওপর।

গোপন সংবাদদাতা নিয়োগ, এ ধরনের পণ্য, মাদকদ্রব্য, কেমিক্যালস, দাহ্য, বিস্ফোরক ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্য আমাদানি প্রতিহত করতে অর্থ দিয়ে নিয়োজিত করা হয় গোপন সংবাদদাতা। এ প্রক্রিয়ায় বৈধ আমদানির আড়ালে ধরা পড়লো Sildenafil citrate বা পাউডার ভায়াগ্রা (৯৮.৯৫% API)।

গোপন সংবাদ ও বাড়তি সতর্কতাঃ চালানটি ধরা পড়ার কিছুদিন আগে অসাধু একটি চক্রের অবাধে আমদানিযোগ্য পণ্যের আড়ালে অপঘোষণার মাধ্যমে ভারত থেকে বেনাপোল বন্দরে ভায়াগ্রা নিয়ে যাবে মর্মে বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনারের কাছে গোপন সংবাদ আসে। সে আলোকে সন্দেহজনক কতিপয় পণ্যচালান এ দপ্তরের সতর্ক নজরদারীতে রাখা হয়।

এ সন্দেহ তালিকার শীর্ষে ছিল ফ্লেভার ঘোষণায় আমদানিকৃত একটি পণ্যচালান। শুল্কায়নের স্বাভাবিক গতি বিঘ্ন না করে চালানটিতে কড়া নজরদারি অব্যাহত থাকে। বিস্তৃত জালে নিচের চালানটি অগ্রাধিকারে আসে।

চালানের বিবরণ, আমদানিকারক রেড গ্রীন ইন্টারন্যাশনাল, ১৫৩/৩ কাঁঠাল বাগান, ক্রিসেন্ট রোড, কলাবাগান, ঢাকা-১২০৫ (বিন নং : ০০১৪৮৬৪৩৭)
এলসি নং : ২৯৬৬১৯০১০০৩৬, তারিখ: ২ এপ্রিল ২০১৯
মেনিফেস্ট নং: ১৩৬১৩ বি-বি, তারিখ: ১০ এপ্রিল ২০১৯
বিল অব এন্ট্রি নং : সি-২৫৫৭৭, তারিখ: ১৩ এপ্রিল ২০১৯
ঘোষিত পণ্য : ফ্লেভার – ৫০০ কেজি।

প্রাপ্ত পণ্য গুলি যথাক্রমে, ফ্লেভার (৫০০ কেজি), সাদা পাউডার (২০০ কেজি), সিরিঞ্জ (১,৯৪,০০০ পিস) ,
ইমিটেশন জুয়েলারি (১১০.৭৭ কেজি), শাড়ি (৩০৩ পিস), ওড়না (১৪ পিস), কামিজ (১০ পিস), সালোয়ার (০৯ পিস), থ্রী-পিস (৩৮ পিস), শার্ট (১৯ পিস), প্যান্ট (১২২ পিস)।

কৌশল, মূলত, বৈধ পণ্যের আড়ালে আমদানিযোগ্য পণ্য অপঘোষণা দিয়ে অপঘোষণার জরিমানা ও শুল্ককর পরিশোধের দোহাই দিয়ে কাস্টমস কর্মকতাদের বোকা বানিয়ে পাউডার ভায়াগ্রা পাচারের অপচেষ্টা করে।

পরীক্ষণ, গোপন সংবাদ পাওয়ার পর কাস্টম হাউসের চৌকষ কর্মকর্তাদের একটি দল দিয়ে চালানটির আমদানি দলিল ও কায়িক পরীক্ষায় প্রাপ্ত পণ্যতালিকা অনুপুঙ্খ পর্যালাচনা ও যাচাই করা হয়। রিপোর্ট নিয়ে কমিশনারের কক্ষে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে পর্যালাচনা করা হয়।

রাসায়নিক পরীক্ষা, পরীক্ষা প্রতিবেদন পাওয়ার পর গোপন সংবাদদাতা রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য তাগিদ দেন। তোলা হয় ফ্লেভার ও পাউডার জাতীয় পণ্যের প্রতিনিধিত্বশীল নমুনা।

রমন স্পেক্ট্রোমিটারে ঠেকে যায়, অধিক সতর্কতার জন্য কাস্টম হাউসের নিজস্ব অত্যাধুনিক ল্যাবে WCO থেকে বিনামূল্যে প্রদত্ত রমন স্পেক্ট্রোমিটার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়। সতর্ক পরীক্ষা শেষে ফ্লেভার সঠিক পাওয়া গেলেও ২০০ কেজি পাউডার পরীক্ষায় ভায়াগ্রা সনাক্ত হয়।

কুয়েটে পুন:পরীক্ষা, রিপোর্ট পূনরায় কমিশনারের কক্ষে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পর্যালোচনা করেন। অত্যন্ত স্পর্শকাতর পণ্য বিবেচনায় অধিকতর নিশ্চিত হওয়ার লক্ষ্যে আমদানিকারককে অভিযুক্ত না করে নমুনা খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) পাঠানোর জন্য সকলে মতামত দেন।

বিলম্বিত প্রতিবেদন, দীর্ঘ আড়াই মাস পর কুয়েট পরীক্ষা করে পণ্যটিকে সিলডেনাফিল সাইট্রেট (ভায়াগ্রার মূল উপাদান) হিসেবে রিপোর্ট দেয়। কুয়েটের প্রতিবেদন প্রাপ্তির পরেই অপঘোষণার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়।

ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিতকরণ, আমদানিকৃত ভায়াগ্রা আটকের বিষয় তৎক্ষণাৎ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, এনডিসি, সদস্য খন্দকার আমিনুর রহমান, সদস্য সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া অবহিত করা হয়। তাঁরা এমন ডিটেকশনের প্রশংসা করেন এবং ভবিষ্যতে আরো সতকর্তার সাথে কাজ করার নির্দেশনা দেন। সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা!

WCO ও বিশ্ব সংস্থাগুলোকে অবহিতকরণঃ গর্বের এ উদঘাটনের বিষয়টি World Customs Organization (WCO), Regional Intelligence Liasion Office (RILO), Customs Enforcement Network (CEN) সহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে অবহিত করা হবে। WCO সদস্য দেশসমূহকে এ পাচার ধরণ ও কৌশল সম্পর্কে জানাবে। প্রয়োজনে অধিকতর তদন্ত করবে।

দেশের অন্যান্য কাস্টমস পয়েন্টে সতর্কতা, বেনাপোল কাস্টম হাউসের সতর্কতার ফলে অসত্য ঘোষণায় আমদানিকৃত ভায়াগ্রার এ চালান আটক করা সম্ভব হয়েছে।

বেনাপোলে নজরদারীর কারণে এমন চালান আটক হওয়ায় ভবিষ্যতে এ চক্রটি এ ধরনের পণ্যচালান আমদানিতে বেনাপোল ব্যবহার নাকরে অন্যান্য কাস্টম হাউস ও কাস্টমস স্টেশন ব্যবহার করতে পারে। সে লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে পত্র দেয়া হবে।

মিডিয়ার মাধ্যমে সতর্ক ও প্রতিহতকরণ, দেশের সকল আমদানি স্টেশনে, বিশেষ নিবিড় সতর্কতা অবলম্বন করার জন্যে এনবিআরকে অনুরোধ করা হয়েছে।

এ ধরনের আমদানি প্রতিহত করার লক্ষ্যে দেশব্যাপী কাস্টমস কর্মকর্তা, বিমানবন্দর, স্থলবন্দর ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে এবং জনসাধারণকে ব্যাপকভাবে অবহিত করার লক্ষ্যে ইলেক্ট্রনিক, প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়ায় প্রচারের জন্য সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়।

দাবীদারবিহীন আমদানিকারক কোনো ঔষধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নয়।