সম্ভাবনাময় ঔষধ শিল্পের দুষ্টু ক্ষত গুলো চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে শিল্পের উন্নয়ন ঘটাতে হবে

এইমাত্র স্বাস্থ্য

আমিনুর রহমান বাদশা : সম্ভবনাময় ঔষধ শিল্পের দুষ্টু ক্ষত গুলো চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যাবস্থা গ্রহণ করে শিল্পের উন্নয়ন ঘটাতে হবে ওষুধ রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান দিন দিন আরো উজ্জ্বল হচ্ছে। স্বাধীনতার পর যেখানে দেশের চাহিদার ৭০ শতাংশ ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি হতো এখন সেখানে দেশের চাহিদার ৯৮ শতাংশ মিটিয়ে বিশ্বের ১৬০টি দেশে বাংলাদেশের প্রস্তুত ওধুষ রপ্তানি হচ্ছে।


বিজ্ঞাপন

দেশের অভ্যন্তরেই বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে এ দেশের ওষুধের। আর দেশের বাইরে রপ্তানি করে বছরে আয় হচ্ছে ৬৫০ কোটি টাকারও বেশি। রপ্তানি প্রবৃদ্ধির হারও ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ওষুধ রপ্তানি খাতটিকে ইতিমধ্যে দারুণ সম্ভাবনাময় একটি খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে।


বিজ্ঞাপন

প্রতি বছরই বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানির পরিমাণ বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে জাপানসহ উন্নত বিশ্বের শতাধিক দেশে যাচ্ছে বাংলাদেশে প্রস্তুত বিভিন্ন ধরনের ওষুধ। গত বছরে বাংলাদেশের ওষুধের রপ্তানি প্রায় দ্বিগুনে পৌঁছেছে।

বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির তথ্য অনুযায়ী দেশের ২ শতাধিক প্রতিষ্ঠান ওষুধ উত্পাদন করছে। এসব কোম্পানি সম্মিলিতভাবে প্রায় ৫ হাজার ব্র্যান্ডের ৮ হাজারের বেশি ওষুধ উৎপাদন করছে। যার মধ্যে বড় ১০টি কোম্পানি দেশের চাহিদা ৮০ শতাংশ মিটিয়ে থাকে। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, জাপান, ফ্রান্স, সুইডেন, ইতালি, কানাডা, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, তুরস্ক, সৌদি আরব, ইরান, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, মরক্কো, আলজেরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে। দেশের উন্নতমানের ৭০টির বেশি কোম্পানি ৩৫০টি গ্রুপের ওষুধ রপ্তানি করে। পৃথিবীর অনেক দেশের ওষুধের চেয়ে বাংলাদেশের ওষুধের মান অনেক ভালো। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ এমনকি ইউরোপের অনেক দেশের চেয়ে আমাদের ওষুধের মান ভালো।

মালয়েশিয়া কিংবা সিঙ্গাপুর আমাদের চেয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নত দেশ হিসেবে বিবেচিত হলেও তাদের বিদেশ থেকে ওষুধ আমদানি করতে হয়। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হয় তাদের। আমাদের অর্থনীতি দিনে দিনে ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের অগ্রযাত্রার মূল কারণ আমাদের ওষুধ নীতির যথার্থ বাস্তবায়ন। ১৯৮২ সালে এ দেশে যে ওষুধনীতি করা হয়, তার সুফল এখন পাওয়া যাচ্ছে; যার কারণে এখানকার ওষুধশিল্প শুধু সামনেই অগ্রসর হয়নি বরং এ দেশের মানুষকে কম দামে ওষুধ কিনে খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
নতুন ওষুধ নীতিমালায় অনেক কিছুই সংযোজন হচ্ছে। যে কারণে আরো বেগবান হবে আমাদের ওষুধশিল্প, আরো এগিয়ে যাবে সামনের দিকে। এখন আমাদের এখানে ভালো ভালো উদ্যোক্তা ব্যবসায়ী, গ্রুপ ওষুধশিল্পে আসছে। অনেক নতুন উদ্যোক্তরা আসছেন ওষুধশিল্পে। আমাদের ওষুধশিল্পে অনেক দক্ষ, অভিজ্ঞ, মেধাবী লোকজন প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে।

মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি এই শিল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এত সাফল্যের পরও সম্ভাবনাময় এ শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে ওষুধ উত্পাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন যে সুবিধা পাচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হলে সেই সুবিধা আর থাকবে না। তখন বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের অবস্থা কী হবে, কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাবে। এরই মধ্যে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশ করেছে। উত্তরণকালীন বিভিন্ন বিষয়ে প্রস্তুতি চলছে বাংলাদেশের। বাজার-সুবিধা, কম সুদে ঋণসহ নানা বিষয়ে আলোচনা শুরু হলেও ওষুধ শিল্পের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি মহলে তেমন কোনো আলোচনা হয় না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে এলডিসি হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কপিরাইট আইন বা ‘মেধাস্বত্ব ছাড়ের’ সুবিধা ভোগ করছে বাংলাদেশ, যার মেয়াদ ২০৩৩ সাল পর্যন্ত দেওয়া আছে। এই সুবিধার আওতায় ওষুধ উৎপাদনে বিদেশি পেটেন্ট ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশকে কোনো রয়্যালিটি বা কোনো ধরনের ফি দিতে হয় না। যে কারণে অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ সস্তায় ওষুধ উৎপাদন করতে পারছে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ‘বাণিজ্য-সংক্রান্ত মেধাস্বত্ব’ (ট্রিপস) আইনে বাংলাদেশকে পেটেন্ট করার অধিকার দেওয়া রয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পাঁচ বছর পর ২০২৬ সালে যখন বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাবে, তখন এ সুবিধা আর থাকবে না। এতে করে বাংলাদেশের ওষুধশিল্প বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কেননা ওষুধ উৎপাদনে বিদেশি পেটেন্ট ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে রয়্যালটি বা ফি দিতে হবে। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে ওষুধের। যার প্রভাব পড়তে পারে ওষুধের দামের ওপর। কিছু ওষুধের দাম এমন অবস্থায় যেতে পারে যে, সব মানুষের পক্ষে সব ওষুধ কেনা সম্ভব না-ও হতে পারে, এমন আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একটি ওষুধ উদ্ভাবন বা ফর্মুলা আবিষ্কারের জন্য সার্বিক গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বিপুল অর্থ ও সময় প্রয়োজন। অপরদিকে ঔষধ সেক্টরের দুষ্টু ক্ষত গুলো চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যাবস্থা গ্রহণ করে শিল্পের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। বিশেষ করে ওমিপ্রাজল, ইসমিপ্রাজল,প্যান্টাপ্রাজল, র‍্যাবিপ্রাজল সহ বিভিন্ন প্রকার এন্টিবায়োটিক এর গুনগত মান নিশ্চিত করতে হবে শতভাগ অন্যথায় বহির্বিশ্বের বাজারে দেশীয় ঔষধ প্রতিযোগিতায় টেকা কষ্ট সাধ্য হয়ে দাড়াবে।

এ ক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে প্রযুক্তিগতভাবে সক্ষমতা বাড়ানো সহ ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরিকে ঢেলে সাজাতে হবে। কারন, একই স্থানে ১২/১৩ বছর থাকার কারনে ঔষধ কোম্পানির মালিকের সাথে বিশেষ সখ্যতা থাকায় ঔষধের নমুনা পরিক্ষার রিপোর্টে পপক্ষপাতিত্ব করার অভিযোগ ও আছে। যেহেতু টেকনিক্যাল, এনালিস্ট এর বিকল্প ব্যাবস্থা না থাকায় ঔষধ শিল্পের উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাড়াচ্ছে কতিপয় অবৈধ সুবিধাভোগী কর্মকর্তারা।

এ বিষয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমানকে আরো কৌশলগত পন্থা অবলম্বন করতে হবে বলে ঔষধ শিল্পের সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।