নতুন মাদকে আসক্ত উচ্চবিত্তের সন্তানরা

অপরাধ

বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয় ও অপরাধ


বিজ্ঞাপন

আমিনুর রহমান বাদশা : বাংলাদেশে নতুন ধরনের মাদকের ব্যবহার বেড়েছে৷ আর নতুন ধরনের মাদকের ব্যবহারকারীদের অনেকেই উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান৷ মাদক চোরকারবারিরা মাদকের নতুন নতুন রুট তৈরি করছে৷
ইয়াবার ব্যবহার তো থামেইনি, উপরন্তু দেশের বাইরে থেকে নতুন নতুন ধরনের মাদক আসছে৷ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর গত ২২ আগস্ট ঢাকার বনানী ও উত্তরা এলাকায় কয়েকটি অভিযান চালিয়ে ক্রিস্টাল মেথ-আইস নামে এত ধরনের মাদক উদ্ধার করে৷গ্রেপ্তার করে ছয় জনকে৷ এরা সবাই উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান৷ এর আগে ১৮ আগস্ট ঢাকার মোহাম্মদপুর ও যাত্রাবাড়ি এলাকা থেকে আধা কেজি আইস এবং ৬৩ হাজার পিস ইয়াবাসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা বিভাগ৷

করোনার সময় শুধু এই আইস নয়, এলএসডি, ডিএমটি এবং ম্যাজিক মাশরুম নামের নতুন নতুন মাদকের ব্যবহার বেড়ে গেছে বলে জানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও পুলিশের গেয়েন্দা বিভাগ৷
র‌্যাব গত জুলাই মাসে ঢাকার হাতিরঝিল থেকে ম্যাজিক মাশরুমসহ দুইজনকে গ্রেপ্তার করে৷
গত জুন মাসে ধানমন্ডি ও লালমাটিয়া থেকে এলএসডি মাদকসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা বিভাগ৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়ের হাফিজুর রহমান নামে একজন ছাত্রের আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনা তদন্ত করতে গিয়েই এই মাদকের সন্ধান পায় তারা৷

‘‘এই নতুন ধরনের মাদকের বড় বাজার হচেছ অনলাইনে’’
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি কমিশনার মশিউর রহমান বলেন,‘‘আগে আমরা ফেনসিডিল, গাঁজা ও ইয়াবার ব্যবহার বেশি দেখেছি৷ এখন ইয়াবার সাথে নতুন নতুন মাদকের ব্যবহারও দেখতে পাচ্ছি৷ আর এই নতুন ধরনের মাদকের বড় বাজার হচেছ অনলাইনে৷ বাংলাদেশেও এই ধরনের মাদকের অনলাইন গ্রুপ আছে যোগাযোগ ও কেনা বেচার জন্য৷ তবে বাংলাদেশে এই মাদক ঢোকে কুরিয়ার সার্ভিস বা আকাশ পথে৷ কিন্তু আশঙ্কার কথা হলো পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আসা শুরু হলে তা আরো ছড়িয়ে পড়বে৷”

তিনি জানান, ‘‘এই নতুন ধরনের মাদকের দাম অনেক বেশি হওয়ায় এখনো এটা উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ৷ উচ্চপদস্থ একজন সরকারি কর্মকর্তার সন্তান যিনি ইউরোপের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন তিনি ঢাকায় এসে আইস মাদক চক্রে জড়িয়ে পড়েছেন৷ এরকম আরো অনেক ঘটনা আছে৷”
কোন মাদকের কারণে শরীরে কী ক্ষতি হয়?
ইয়াবা
বাংলাদেশে বর্তমানে মাদক হিসেবে এটিই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে৷ এর ফলে কিডনি, লিভার ও ফুসফস ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ সাময়িক যৌন উত্তেজনা বাড়লেও দীর্ঘমেয়াদে যৌন ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়৷ এছাড়া ইয়াবার কারণে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে৷

ফেনসিডিল
একসময় এটিই প্রধান মাদক ছিল৷ ইয়াবা আসার পর ফেনসিডিলের ব্যবহার কিছুটা কমেছে৷ এটি খাওয়ার কারণে ক্ষুধা নষ্ট হয়ে যায়৷ ফলে খাবার না খাওয়ায় শরীর পর্যাপ্ত পুষ্টি পায় না৷ এতে স্বাস্থ্য নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে৷ ইয়াবার মতো ফেনসিডিলও যৌন ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়৷ এছাড়া শরীরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গও ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷

গাঁজা
রক্তবাহী শিরার ক্ষতি করে, ফলে রক্ত পরিবহনে সমস্যা হয়৷ মস্তিষ্কের উপর প্রভাবের কারণে স্মৃতিশক্তির ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়৷ তাছাড়া মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে৷ পুরুষের ক্ষেত্রে টেস্টিকুলার ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে৷ অনেকের ধারণা গাঁজা খেলে সৃজনশীলতা বাড়ে৷ তবে এটি ভুল বলে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে৷ গাঁজা খেলে স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি হয়, চোখের দৃষ্টি কমে যায়৷

হেরোইন
যারা অধিক পরিমাণে হেরোইন সেবন করেন তারা নানারকম স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়েন৷ যেমন লিভার সমস্যা, ফুসফুসে সংক্রমণ, তীব্র কোষ্ঠকাঠিন্য, কিডনি রোগ, হার্ট ও ত্বকে সমস্যা, হেপাটাইটিস, নারীদের সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা, গর্ভপাত ইত্যাদি৷

আফিম
আফিম খেলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে, যা থেকে অবচেতন হয়ে পড়া এবং বেশি পরিমাণে খেলে মৃত্যুও হতে পারে৷ এছাড়া মুখ ও নাক শুকিয়ে যাওয়া, বমি বমি ভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি হতে পারে৷

অ্যালকোহল
জার্মানির সেন্ট্রাল ইন্সটিটিউট ফর মেন্টাল হেল্থ-এর ফাল্ক কিফার বলেন, অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে প্রতিবন্ধী ও অসুস্থ হয়ে জীবনের মূল্যবান বছরগুলি হারিয়ে যায়৷ লিভার সিরোসিস থেকে শুরু করে কর্মক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন অনেকে৷ ডাব্লিউএইচও-র রিপোর্ট বলছে, ২০১২ সালে বিশ্বব্যাপী মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে ৩.৩ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করেন৷ এছাড়া ২০০টি নানা ধরনের অসুখ-বিসুখ হতে পারে অতিরিক্ত অ্যালকোহলের কারণে৷
বাংলাদেশে এই নতুন ধরনের মাদক যে আগে ছিলো না, তা নয়৷ তবে এর আগে দুই-একবার ধরা পড়লেও দীর্ঘ সময় আর দেখা যায়নি৷ কিন্তু করোনার সময় আবার দেখা যাচ্ছে এবং তা ভয়বহ আকারে দেখা যাচ্ছে৷ মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহাকারী পরিচাল মেহেদি হাসান জানান, ‘‘২০০৯ সালে একবার আমরা আইস মাদকসহ কয়েকজনকে আটক করেছিলাম৷

আর এলএসডি মাদক প্রথম ২০১৯ সালে আমরা উদ্ধার করি৷ এরপর আরো অনেক পাওয়া গেছে৷”

তিনি জানান, ‘‘আইস এখন মিয়ানমার থেকেও আসা শুরু করেছে৷ আমার দেখতে পাচ্ছি যারা ইয়াবার কারবার করে তারাই আবার আইস কারবারের সাথে জড়িয়ে পড়ছে৷ আর এক গ্রাম আইস এখানে ১০-১৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়৷
ফলে এটা উচ্চবিত্তদের সন্তানরাই বেশি সেবন করছে৷ মাদক কারবারিরা এখন নতুন রুট ও কৌশল কাজে লাগচ্ছে৷”