ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বাড়ছে রাজধানী জুড়ে আতঙ্ক

অন্যান্য অর্থনীতি এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন জীবনী ঢাকা বানিজ্য রাজধানী সারাদেশ স্বাস্থ্য

বিশেষ প্রতিবেদক : ডেঙ্গু আতঙ্ক এখন রাজধানী জুড়ে। নগরবাসী জ্বর হলেই ছুটছেন চিকিৎসকের কাছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, সোমবার পর্যন্ত ৭ হাজার ১’শ ৭৯ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এদিকে মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) দুপুর দেড়টা পর্যন্ত কেবল রাজধানীতে ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছেন ৪০৭ জন। বিশেষ কর্নার খুলেও রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। শয্যা সংকটে অনেকের জায়গা হয়েছে মেঝেতে। ভয় না পেয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সাত নম্বর ওয়ার্ডের ২০ টি শয্যা ছেড়ে দেয়া হয়েছে শুধু ডেঙ্গু রোগীদের জন্য। তবে চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কও বাড়ছে রোগী ও স্বজনদের মধ্যে।
অনেকেই বিছানা না পেয়ে হাসপাতালের বারান্দায় চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এছাড়া এক পরিবারেই অনেকে আক্রান্ত হওয়ায় ভোগান্তি বেড়েছে কয়েক গুণ।
ডেঙ্গু আক্রান্তের আগের রেকর্ড ভেঙেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুম জানিয়েছে, এদিকে মঙ্গলবার দুপুর দেড়টা পর্যন্ত কেবল রাজধানীতে ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছেন ৪০৭ জন। বিশেষ কর্নার খুলেও রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। শয্যা সংকটে অনেকের জায়গা হয়েছে মেঝেতে।
সোমবার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে হবিগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মো. শাহাদৎ হোসেন হাজরা। ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক ও সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় ডেঙ্গু জ্বর ভালো হয়ে যায়। জ্বর হলে ওষুধ হিসেবে প্যারাসিটামল ও তরলজাতীয় খাবার খাবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন, বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ জানান, ডেঙ্গু কোনো মারাত্মক রোগ নয় এবং এতে চিন্তার কিছু নেই। এই রোগ নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়। প্রয়োজন সতর্ক ও সচেতন থাকা। রক্তের প্লাটিলেট কমে গেলেও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ডাক্তারদেরও সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, প্রেশার কমে যাচ্ছে কি না নিয়মিত চেকআপ করতে হবে। যাদের একাধিকবার ডেঙ্গু জ্বর হয়, তাদের ক্ষেত্রে একটু ঝুঁকি থাকে। তবে সুষ্ঠু ব্যবস্থপনায় ডেঙ্গু জ্বর ভালো হয়ে যায়। তিনি বলেন, যে কোনো জ্বরে আক্রান্ত রোগী যত বেশি বিশ্রামে থাকবে, যত বেশি তরল খাবার খাবে, তত দ্রুত জ্বর নিয়ন্ত্রণে আসবে। তাই ডেঙ্গুর মূল চিকিৎসা প্রচুর তরল বা পানি গ্রহণ করা, পর্যাপ্ত বিশ্রামে থাকা ইত্যাদি। যে কোনো জ্বরে ১০১ ডিগ্রি ফারেনহাইটের ওপর তাপমাত্রা গেলেই তা কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে সাপোজিটরি ব্যবহার করতে হবে। প্রচুর পানি, শরবত ও তরল খাবার বেশি দিতে হবে। কোনো অবস্থায়ই শরীরে যেন তরলের ঘাটতি না হয়। জ্বর হলে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ খাবেন না। অন্যান্য ওষুধ প্রয়োগ না করাই উচিত। তবে যে কোনো জ্বর তিন দিনের বেশি থাকলে, শরীরে প্রচন্ড ব্যথা থাকলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তিনি আরো বলেন, ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ, তাই এতে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো ভূমিকা নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অন্য কোনো ব্যথার ওষুধ সেবন করা যাবে না। কেননা, হেমোরেজিক ডেঙ্গু হলে কিছু ব্যথার ওষুধ রক্তক্ষরণ বাড়িয়ে বিপদ ঘটাতে পারে। তীব্র জ্বরের সঙ্গে শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা, চোখে ব্যথা ইত্যাদি লক্ষণ থাকলে অবশ্যই বিশ্রাম নিতে হবে। জ্বর কমে যাওয়ার পরের কিছুদিনকে বলা হয় ক্রিটিক্যাল পিরিয়ড। এ সময়টায় সবার সচেতন থাকা খুব জরুরি। ডেঙ্গুর চিকিৎসা বাড়িতেও সম্ভব, তবে বেশি দুর্বল ও পানিশূন্য হয়ে পড়লে বা শরীরের কোথাও রক্তবিন্দুর মতো দাগ, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, নাক বা মাড়ি থেকে রক্ত পড়ার মতো যে কোনো লক্ষণে দেরি না করে হাসপাতালে নিতে হবে।
গত ৯ জুলাই হবিগঞ্জের সিভিল সার্জন হিসেবে যোগদান করলেও বেশ কিছুদিন ধরেই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন হবিগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. শাহাদৎ হোসেন হাজরা। রোববার সকালের দিকে কার্যালয়ে এসে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মাসিক সমন্বয় সভায়ও অংশ নেন। এ সময় অসুস্থ বোধ করলে ডা. শাহাদৎ সিলেট বিভাগীয় পরিচালকের (স্বাস্থ্য) সঙ্গে কথা বলেন। পরে তাকে হবিগঞ্জ আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রোববার বিকাল ৪টার দিকে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা ডা. শাহাদেক ঢাকায় পাঠান। রাত সোয়া ১০টার দিকে সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া জানান, হাসপাতালে আনার আগেই মারা যান ডা. শাহাদাত হোসেন। যেহেতু মৃত অবস্থায় এসেছেন এবং তার শুধু জ্বরের হিস্ট্রি ছিল, তাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে মৃত্যুর কারণ বলা কঠিন।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, হবিগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. শাহাদৎ হোসেন হাজরার কী কারণে মৃত্যু হয়েছে তা তদন্ত করে দেখতে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে (আইইডিসিআর) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, এবার বৃষ্টির কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। ডেঙ্গুর বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে। গত সোমবার রাজধানীতে ৪০৩ জন আক্রান্ত হয়েছে। অতীতে কখনো এক দিনে এতসংখ্যক আক্রান্ত হয়নি। তবে ডেঙ্গুর চিকিৎসার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চিকিৎসকদের দেওয়া আছে। এ ব্যাপারে আরো বেশি সচেতন হতে সব বিভাগীয় পরিচালক ও সিভিল সার্জনদের সঙ্গে আজ মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। আজ বুধবার সব হাসপাতালের পরিচালক ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক হবে।
এদিকে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের মধ্যে শিশুদের সংখ্যাও কম নয়। ঢাকা শিশু হাসপাতালে ৬১ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে ১০ জন আইসিইউতে ভর্তি। এদের অবস্থা আশঙ্কজনক। ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শফি আহমেদ বলেন, ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। শিশুদের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলো তারা কিছু বলতে পারে না। তাদের ক্ষেত্রে বেশি সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে।


বিজ্ঞাপন

হলি ফ্যামিলি ৫০০ বেডের ১৬০টিতেই ডেঙ্গু রোগী : রাজধানীর ইস্কাটনে অবস্থিত হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ৫০০। এর মধ্যে ১৬০টিতে ভর্তি আছেন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) সকালে এ তথ্য জানান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
তারা জানান, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এ হাসপাতালে কোনো মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হননি। গত ১ মে হাসপাতালে প্রথম ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হন। গত ৭ জুলাই পর্যন্ত মোট ২২২ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হন।
মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) পর্যন্ত ৫৮৫ রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এ হাসপাতালে ভর্তি হন। গত ১৬ দিনে হাসপাতালে ৩৬৩ রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেন।
তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সোমবার থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত ৬০ রোগী ভর্তি হয়েছেন। ওই ৬০ জনসহ বর্তমানে ১৬০ ডেঙ্গু রোগী এ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
হাসপাতালটিতে এখন পর্যন্ত ভর্তি ৫৮৫ ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে ১৬০ জন ছাড়া বাকিরা চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
ডেঙ্গু আক্রান্ত এ হাসপাতালে কোনো রোগী মারা যায়নি। হাসপাতালটির মেট্রন বিভাগ এ তথ্য জানায়।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আরও জানায়, ৫০০ শয্যার সবকটি রোগীতে পূর্ণ। মঙ্গলবার বিকেল ৪টার মধ্যে কিছু রোগী সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছাড়বেন। তারা গেলে নতুন রোগী ভর্তির করা সম্ভব হবে।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *