স্বীকারোক্তি দিলেন ইকবাল
যেভাবে ধরা পড়লো ইকবাল
নিজস্ব প্রতিবেদক : কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে পবিত্র কুরআন রাখার ঘটনায় মূল অভিযুক্ত স্থানীয় তরুণ ইকবাল হোসেনকে কক্সবাজার থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে দশটার দিকে কলাতলী এলাকা থেকে তাকে আটক করা হয়। সকালে ইকবালকে কুমিল্লা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ইকবালকে নিয়ে তারা কুমিল্লার উদ্দেশে রওনা হন।
চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন জানান, বৃহস্পতিবার ট্রেনে চট্টগ্রামে আসে ইকবাল। সেখান থেকে যায় কক্সবাজারে। দুর্গাপূজার সময় কুমিল্লার নানুয়াদিঘি পূজা ম-পে পবিত্র কোরআন পাওয়ায়, ধর্ম অবমাননার অভিযোগে সাম্প্রদায়িক সংঘাতে জড়ায় একদল লোক। পরে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে তাকে শনাক্তের দাবি করে পুলিশ।
কুমিল্লার দারোগা বাড়ি মাজার থেকে কোরআন শরিফ নিয়ে পূজাম-পে রাখে স্থানীয় তরুণ ইকবাল। গদা হাতে সেখান থেকে বেরিয়ে ফোন দেয় ট্রিপল নাইনে। পরদিন উত্তেজিত জনতার মধ্যে উসকানিমূলক বক্তব্যও দেয় সে। আর এই ঘটনার ফুটেজ পাওয়া গেছে একাধিক সিসিটিভি ক্যামেরা থেকে।
১২ অক্টোবর রাত ৩টা ৪২ মিনিট। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে, মণ্ডপে কোরআন রাখায় অভিযুক্ত ইকবালকে দেখা যায় কুমিল্লার দারোগা বাড়ি মাজারে ঢুকতে।
পরদিন রাত সাড়ে ১০টায় মাজারের খাদেমের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায় তাকে। এর কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে যায় সে।
সে রাতেই ২টার দিকে আবার মাজারে আসে ইকবাল। দানবাস্কের ওপর থেকে কোরআন শরিফ নিয়ে রাখেন মেঝেতে। কিছুক্ষণ ঘোরাফেরার পর কোরআন নিয়ে চলে যায় বাইরে।
কোরআন হাতে বেরিয়ে যাওয়ার সেই ছবি মিলেছে আরেক সিসিটিভি ক্যামেরায়ও। সেখানে থেকে জগন্নাথ মন্দিরের সামনে যায় ইকবাল। এরপর যায় চকবাজারের দিকে। পূবালী ব্যাংকের পাশের গলিতে নৈশপ্রহরীর সঙ্গে কথাবার্তা বলতেও দেখা যায় তাকে।
এরপর আসে নানুয়া দীঘির পূজাম-পে। সেখানে কোরআন শরিফ রেখে চলে যায় হনুমানের গদা নিয়ে। রাত সোয়া তিনটার দিকে গদা ঘাড়ে হাঁটতে দেখা যায় তাকে। সে সময়ই মণ্ডপে কোরআন রাখা নিয়ে ট্রিপল নাইনে ফোন দিয়ে কথা বলে পুলিশের সঙ্গে।
পরদিন সকালে কোরআন রাখা নিয়ে উত্তেজিত জনতার মধ্যে উসকানিমূলক বক্তব্য দিতেও দেখা যায় ইকবালকে।
কোরআন রাখার স্বীকারোক্তি ইকবালের : কুমিল্লার পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখার কথা স্বীকার করেছেন ইকবাল হোসেন। শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তাকে কুমিল্লা পুলিশ লাইনে এনে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি এ ঘটনা স্বীকার করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন কর্মকর্তা এতথ্য নিশ্চিত করেছেন।
ওই কর্মকর্তা জানান, নগরীর নানুয়ার দিঘিরপাড়ে দর্পন সংঘের অস্থায়ী পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখার পর হনুমানের মূর্তি থেকে গদা সরিয়ে নেওয়ার কথাও স্বীকার করেছেন ইকবাল। তবে কার নির্দেশে তিনি এ কাজটি করেছেন, তা এখনো জানাননি।
এর আগে, বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) রাত সাড়ে ১০টার দিকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত এলাকার সুগন্ধা পয়েন্ট থেকে ইকবালকে আটক করে পুলিশ। খবর পেয়ে রাতেই কুমিল্লা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) সোহান সরকারের নেতৃত্বে কুমিল্লা থেকে রওনা দেয় পুলিশের একটি টিম। শুক্রবার দুপুরে তাকে কুমিল্লা পুলিশ লাইনে এনে প্রাথমিকভাবে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
গত ১৩ অক্টোবর কুমিল্লা মহানগরীর নানুয়ার দিঘিরপাড় পূজাম-পে কোরআন রাখা নিয়ে মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় কুমিল্লার বিভিন্ন থানায় নয় মামলায় ৭৯১ জনকে আসামি করা হয়। এরমধ্যে কোতোয়ালি মডেল থানায় পাঁচটি, কুমিল্লা সদর দক্ষিণ মডেল থানায় দুটি এবং দাউদকান্দি ও দেবীদ্বার থানায় একটি করে মামলা হয়েছে। ৯১ জনের নাম উল্লেখ করে মামলায় ৭০০ অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৪৪ জনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
মণ্ডপের আশপাশসহ নগরীর বেশ কয়েকটি এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে ইকবালকে শনাক্ত করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
যেভাবে ধরা পড়লো ইকবাল : কক্সবাজারে ঘুরতে যাওয়া কয়েক তরুণের সঙ্গে গানে গলা মিলিয়ে ধরা পড়েছেন কুমিল্লার পূজামণ্ডপে কোরআন শরিফ রাখার ঘটনায় অভিযুক্ত ইকবাল। বৃহস্পতিবার রাতে কক্সবাজার পুলিশ ইকবালকে গ্রেফতার করে।
ছাত্রলীগ কর্মী ও চৌমুহনী সরকারি এস এ কলেজের ব্যবস্থাপনা বিষয়ের মাস্টার্সের ছাত্র অনিক রহমান দাবি করেন, আমি, বন্ধু মেহেদী হাসান মিশু ও সাইফুল ইসলাম সাইফ মিলে ইকবালকে ধরিয়ে দিয়েছি।
ওই তিন জনকে ছাত্রলীগের কর্মী বলে নিশ্চিত করেছেন নোয়াখালী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আসাদুজ্জামান।
এদিকে ছাত্রলীগ কর্মীদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কুমিল্লা ও কক্সবাজার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইকবালকে ধরা হয় বলে নিশ্চিত করেছেন নোয়াখালীর (বেগমগঞ্জ সার্কেল) এএসপি শাহ ইমরান। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ছাত্রলীগ কর্মী অনিক ও মিশু আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে ইকবালের তথ্য দেন। তারা ইকবালকে ধরিয়ে দিতে সহায়তা চান। পরে আমি কুমিল্লা ও কক্সবাজারের পুলিশের সঙ্গে ইকবালকে গ্রেফতারের জন্য যোগাযোগ করি।
ইকবালকে গ্রেফতারের ঘটনা বলতে গিয়ে ছাত্রলীগ কর্মী অনিক বলেন, ১৯ অক্টোবর সোমবার রাতে বন্ধু মেহেদি হাসান মিশু ও ঢাকার তিন ব্যবসায়ী বন্ধু রায়হান, মামুন ও হৃদয়সহ পাঁচ জন কক্সবাজারে বেড়াতে যাই। ২০ অক্টোবর বৃহস্পতিবার সকালে সেখানে থাকা আরেক বন্ধু সাইফুল ইসলাম সাইফ আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। এরপর বিকাল ৪টায় দরিয়ানগরে ঘুরতে বের হই। সেখানে ছয় বন্ধু মিলে সময় কাটাতে গান গাওয়ার সময় ইকবালও পাশে এসে গানে সুর মেলায়। এরপর ওই রাতে টেলিভিশনে এবং ফেসবুকে ছবি দেখে ইকবালের বিষয়ে নিশ্চিত হই।
এস এ কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র এবং ছাত্রলীগ কর্মী মেহেদী হাসান মিশু বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে তারা সুগন্ধা পয়েন্টে গেলে ইকবালের সঙ্গে তাদের আবার দেখা হয়। তখন আমরা তার সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলি। একপর্যায়ে সে পালিয়ে যেতে চাইলে তাকে নাশতা ও সিগারেট খাইয়ে কৌশলে আটকে রাখি। এ সময় তার নাম জানতে চাইলে সে ইকবাল বলে জানায়। তখন আমরা কৌশলে তার ছবি তুলে নোয়াখালীর এএসপির সঙ্গে যোগাযোগ করি ও ছবি পাঠাই। তিনি আমাদের কুমিল্লার পুলিশ সুপারের মোবাইল নম্বর দেন। এরপর কুমিল্লার পুলিশ সুপারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ছবি পাঠাই। তিনি কক্সবাজারের পুলিশ সুপারকে বিষয়টি অবহিত করেন। পরবর্তীতে রাত সাড়ে ১০টায় পুলিশ এসে ইকবালকে আটক করে নিয়ে যায়।
এর আগে, কুমিল্লার পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখার ঘটনায় ১৬ মিনিট ৫২ সেকেন্ডের একটি সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজ গণমাধ্যমের কাছে আসে। সেখানে দেখা যায়, অভিযুক্ত ইকবাল হোসেন মসজিদ থেকে কীভাবে কোরআন নিয়ে বের হয়ে পূজামণ্ডপের দিকে যান এবং মণ্ডপ থেকে হনুমানের গদা হাতে নিয়ে ফেরেন।