ভাড়া বাড়ানোয় ক্ষুব্ধ মানুষ

বিশেষ প্রতিবেদন

অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করলে কঠোর ব্যবস্থা: কাদের
বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাখ্যান যাত্রী কল্যাণ সমিতির
গ্যাসে চলা বাসও নিচ্ছে বাড়তি ভাড়া
বাস-লঞ্চের ভাড়া বাড়ানোয় ক্ষুব্ধ মানুষ

 

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্তের পর পরই প্রত্যাহার হয় বাস-লঞ্চের ধর্মঘট। সরব হয়ে উঠে রাজধানীর টার্মিনালগুলো। দুই দিনের স্থবিরতার পর আবারও ঘুরতে শুরু করে গণপরিবহনের চাকা। সড়কে বাস নামায় স্বস্তি মিললেও, আকস্মিক এই ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ সাধারণ যাত্রী।
এরই মধ্যে রাজধানীর গুলিস্তান থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত আগে ১০ টাকা ভাড়া নিলেও এখন ১৫ টাকা করে নেয়া হচ্ছে। যদিও সন্ধ্যায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সঙ্গে পরিবহন মালিক সমিতির বৈঠকে মহানগরে ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ দিকে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সোমবার সকালে এক ব্রিফিংয়ে তিনি এ হুঁশিয়ারি দেন। কাদের বলেন, নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া যেন যাত্রীদের থেকে আদায় করা না হয়, সে ব্যাপারে পরিবহন মালিক শ্রমিকদের সতর্ক থাকতে হবে। এ ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে জনস্বার্থে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে।
তিনি বলেন, দেশে কোনো ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি নেই। জনস্বার্থে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি, দুর্নীতিবাজ এবং অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান কঠোর।
এ সময় গ্যাস অকটেন ও পেট্রোলচালিত যানবাহনের ক্ষেত্রে বর্ধিত এ ভাড়া প্রযোজ্য হবে না বলেও জানান আওয়ামী লীগের এই নেতা।
অন্যদিকে গণপরিবহনের বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাখ্যান করে একটি ন্যায্য এবং গ্রহণযোগ্য বাস ও লঞ্চের ভাড়া নির্ধারণের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
রাজধানীর সেগুনবাগিচা শিশুকল্যাণ পরিষদ মিলনায়তনে সোমবার সকালে ‘যাত্রী স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে মালিক শ্রমিক সরকার মিলেমিশে একচেটিয়াভাবে গণপরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি’র প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এ দাবি জানান।
এসময় তিনি আরও বলেন, অধিক হারে মুনাফা লুটপাটের সুযোগ করে দিতে সরকার-মালিকদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী বাস ও লঞ্চের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির পর সব পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সহনীয় মাত্রায় ভাড়া বৃদ্ধি করা হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। কিন্তু এই ভাড়া বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তা প্রতিফলন হয়নি।
মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বাস ও লঞ্চ মালিকদের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে সরকার তাদের চাহিদা অনুযায়ী একচেটিয়া ভাড়া বাড়িয়ে দিতে যাত্রী প্রতিনিধি বাদ দিয়ে বাস ও লঞ্চের ভাড়া বাড়িয়েছে সরকার। এটা জনগণের সঙ্গে সরকারের প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।
এবিষয়ে বাসের চালক ও সহকারীরা বলছেন, ‘গুলিস্তান থেকে ফার্মগেটের ভাড়া আগে ১০ টাকা থাকা থাকলেও এখন ১৫ টাকা নিতাছি। মালিকরা আমাদের এই ভাড়া নিতে বলছে বইলাই নিচ্ছি। কালই নতুন ভাড়ার চার্ট টাঙানো হইব।’
পরিবহন ধর্মঘট তুলে নেওয়ার পর রোববার সন্ধ্যায় রাজধানীতে বাস চালু হলে আগের চেয়ে ৫০ শতাংশ বাড়তি ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে। এদিকে নিত্যপণ্যের উর্ধ্বগতির মধ্যে এবার বাস ভাড়া বাড়ায় ক্ষুব্ধ সাধারণ যাত্রীরা।
আকস্মিক এই সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিকও মনে করছেন তারা। এদিকে, জ্বালানি বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বা গণপরিহনের ভাড়া বাড়াতে আরও সময় নেয়ার সুযোগ ছিলো।
দূরপাল্লায় গড়ে ২৭ আর মহানগরে বাস ভাড়া বেড়েছে ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ। এদিকে ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে যাত্রীবাহী লঞ্চের ভাড়াও বাড়লো ৩৫ শতাংশ। এই হিসাবে কিলোমিটারপ্রতি ৬০ পয়সা করে ভাড়া বাড়বে।
নিত্যপণ্যে অগ্নিমূল্যের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত বড় সমস্যা তৈরি করবে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। ডিজেল-কেরোসিনের দাম বা ভাড়া বাড়াতে আরও সময় নেয়া উচিত ছিল বলেও মনে করছেন তারা।
যন্ত্রাংশ ও ইঞ্জিন ওয়েলের দাম বাড়ার অজুহাতে দীর্ঘদিন ধরেই ভাড়া বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছিলো পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা।
দূরপাল্লার বাসে ভাড়া নৈরাজ্য : জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বাস ভাড়া বাড়ানোয় যাত্রীদের মাঝে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চাইতেও বেশি নেওয়ার অভিযোগ তাদের। তারা বলছেন, দূরপাল্লার বাসে ভাড়া নিয়ে চলছে নৈরাজ্য। নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে দ্বিগুণ নেওয়ার অভিযোগ। ভোগান্তিতে পড়েছেন শিক্ষার্থীসহ নি¤œ ও মধ্যবিত্তরা।
তবে, অচলাবস্থা কাটিয়ে পরিবহন চলাচল শুরু হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন যাত্রী ও শ্রমিকরা। এদিকে, সিএনজি চালিত বাসেও একই ভাড়া নির্ধারণ করায় তদারকির দাবি যাত্রীদের।
শেষমেশ ভাড়া বাড়িয়েই ঘুরল বাসের চাকা। প্রায় ২৭ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্তে তিন দিন পর ধর্মঘট প্রত্যাহার শেষে রোববার রাত থেকেই গণপরিবহন চলাচল শুরু হয়।
বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে পরিবহন মালিকদের দাবির মুখে গণপরিবহনে ভাড়া সমন্বয় করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। নতুন এ ভাড়া শুধু ডিজেলচালিত বাসের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু সিএনজি চালিত গাড়িতেও বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। নেই কোনো সুনির্দিষ্ট তদারকি।
এদিকে, বাড়তি ভাড়া ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ মানুষ। অনেকের আর্থিক সামর্থ্যেও পড়েছে টান। ভুক্তভোগীরা বলছেন, জনগণের বিষয়টি দেখা হয়নি। তাদের সুবিধাটাই দেখা হচ্ছে। ব্যয় বাড়ে কিন্তু কর্মস্থলে বেতন বাড়ে না।
যাত্রীরা বলছেন, মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য ভাড়া বাড়াটা খুবই অসুবিধার। আগে রাজশাহী থেকে নাটোরের ভাড়া নিত ৫০ টাকা কিন্তু এখন নিচ্ছে ৮০ টাকা। বাড়তি ভাড়া দিয়ে যাতায়াত তো কষ্টদায়ক।
ভাড়া আদায় নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে বাসের হেলপার-সুপারভাইজারদের বাকবিত-া করতে দেখা যায়। এদিকে, ভাড়া বাড়ার কারণে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে শিক্ষার্থীরা।
চালকরা বলছেন, কথা কাটাকাটি করে ভাড়া আদায় করতে হচ্ছে। না নিলেও তো আমরা গাড়ি চালাতে পারি না। শিক্ষার্থীরা বলছেন, এ রকম বাড়ালে তো আমাদের যাওয়া আসার সমস্যা হয়। টাকা বেশি নেওয়াটা সাধারণ মানুষের জন্য কঠিন হয়ে গেছে।
এদিকে, ভাড়া বাড়লেও পরিবহন শ্রমিকদের মজুরি বাড়ে না বলে অভিযোগ করেছেন তারা। বলছেন, গাড়ি চলছে কিন্তু আমাদের তো আর বেতন ভাতা বাড়াচ্ছে না। ২০-২৫ বছর ধরে একই বেতনে কাজ করছি। মালিক কত পেল না পেল, সেটা তো আমরা পাই না।
এত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও অচলাবস্থা কাটিয়ে গণপরিবহন চলাচল শুরু হওয়ায় স্বস্তি ফিরেছে যাত্রীদের মনে।
গ্যাসে চলা বাসও নিচ্ছে বাড়তি ভাড়া : জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর পরিবহন ধর্মঘটের মুখে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়িয়েছে সরকার। সরকার শুধু ডিজেলচালিত বাসের ভাড়া বাড়ালেও রাজধানীতে সিএনজিচালিত বাসগুলোও নিচ্ছে বাড়তি ভাড়া। বাড়তি ভাড়া নিতে যাত্রীদের সঙ্গে বিত-া করছেন পরিবহন শ্রমিকরা।
জানা গেছে, ঢাকায় মাত্র ৫ শতাংশ বাস ডিজেলে চলে, বাকি বাস চলে সিএনজিতে। যদিও ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে এসব বাসগুলোও ধর্মঘটে বন্ধ থাকে। সরকার সিএনজিচালিত বাসের ভাড়া না বাড়ালেও তারা অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে। সরকার ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে ভাড়া কিলোমিটার প্রতি এক টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে দুই টাকা ১৫ পয়সা করা হয়েছে। মহানগরে চলা মিনিবাসের ভাড়া এক টাকা ৬০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে দুই টাকা পাঁচ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। সর্বনি¤œ ভাড়া ৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ টাকা করা হয়েছে। ফলে যাত্রীকে এক কিলিমিটার পথ গেলেও বাসে উঠলেই ১০ টাকা ভাড়া দিতে হবে। আর মিনিবাসের ন্যূনতম ভাড়া ৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকা করা হয়েছে।
সজীব চৌধুরী বলেন, ‘বিমানবন্দর থেকে নতুন বাজারের দূরত্ব প্রায় ৭ কিলোমিটার। কিন্তু ভাড়া নিচ্ছে ৩৫ টাকা। এটা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়।’
বাসগুলো ইচ্ছা মতো ভাড়া নিচ্ছে। কিলোমিটার প্রতি হিসাব করে ভাড়া নিচ্ছে না। যাত্রী অরূপ চৌধুরী বলেন, ‘রাইদা বাসে যাত্রাবাড়ী থেকে উত্তরার ভাড়া ছিল ৫০ টাকা। ভাড়া ২৭ শতাংশ বাড়ালে হয় ৬৩.৫ টাকা। কিন্তু ৭০ টাকা ভাড়া নিচ্ছে। বাসের কন্ট্রাক্টর বলছে, সরকার আর কোম্পানি ভাড়া বাড়িয়েছে। কারও কোনও নজিরদারি না থাকায় এমন পরিস্থিতি হয়েছে। শুধু তাই নয় কোনও প্রশ্ন করলে খারাপ ব্যবহার করছে বাসের কন্ট্রাক্টরা।’
মালিকপক্ষ যেভাবে ভাড়া আদায় করতে বলছে, সেভাবে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে বলে জানালেন পরিবহন শ্রমিকরা। কয়েকটি বাসের কন্ট্রাক্টর বলেন, ‘আমরা মালিকের চাকরি করি, যেভাবে ভাড়া নিতে বলবেন, আমাদের তো সেভাবেই নিতে হবে। কিন্তু যাত্রীদের সঙ্গে আমাদের ঝামেলা হচ্ছে।’
হাতিরঝিল চক্রাকার বাস সার্ভিস ৫০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করেছে বলে অভিযোগ যাত্রীদের। রফিকুল ইসলাম নামে এক যাত্রী বলেন, ‘গতকাল দুপুরে রামপুরা থেকে ১০ টাকা দিয়ে বউবাজার আসছিলাম। সোমবার সকালে ১৫ টাকা দিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি। মানে ৫০ ভাড়া বাড়লো। যে যেমন পারছে, সুযোগ নিচ্ছে।’


বিজ্ঞাপন