পাকবাহিনী দিশাহারা চতুর্মুখী আক্রমণে

জাতীয়

আজকের দেশ রিপোর্ট : ১১ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর চতুর্মুখী আক্রমণে দিশাহারা হয়ে পালাতে শুরু করে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী। প্রাণে বাঁচতে কেউ কেউ আত্মসমর্পণ করে। এই দিনে শত্রুমুক্ত হয় টাঙ্গাইল, কুমিল্লার লাকসাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর ও দিনাজপুরের হিলি।


বিজ্ঞাপন

রাস্তায় নেমে আসে মুক্তিকামী জনতা। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে পথঘাট।

কুমিল্লা : ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর ভোরে লাকসামকে শত্রুমুক্ত বলে ঘোষণা করে যৌথবাহিনী। তবে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নির্মম গণহত্যার স্মৃতি নিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে আছে লাকসাম বেলতলি বধ্যভূমি।

পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ১০ হাজারেরও বেশি নিরীহ-নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে এখানে মাটিচাপা দেয়। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ৮ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর বিভিন্ন কমান্ড লাকসামে অবস্থানরত পাক হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু করে। পরবর্তীতে মিত্রবাহিনী লাকসাম জংশন ও সিগারেট ফ্যাক্টরিসহ বিভিন্ন অবস্থানের ওপর বিমান হামলা চালিয়ে পাকসেনাদের তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। দুই দিন ধরে প্রচণ্ড যুদ্ধের পর পাকবাহিনী লাকসাম থেকে পশ্চিম দিকে মুদাফরগঞ্জ হয়ে চাঁদপুরের দিকে পালাতে থাকে।
পালানোর সময় মিত্রবাহিনী চুনাতি নামক গ্রামে এবং মুক্তিবাহিনী শ্রীয়াং ও বাংলাইশে পাকবাহিনীকে মুখোমুখি আক্রমণ করে। এতে পাকবাহিনীর অসংখ্য সেনা প্রাণ হারায়। বন্দী হয় অনেকে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ : ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার প্রাণকেন্দ্র রহনপুর হানাদারমুক্ত হয়। উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা আখতার আলী খান কচি জানান, মুক্তিযুদ্ধে এ এলাকা ৭ নম্বর সেক্টরের অধীন ছিল।

১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর খুব সকালে লেফটেন্যান্ট রফিকের নেতৃত্বে প্রায় ৩০-৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল বাঙ্গাবাড়ী থেকে রহনপুর অভিমুখে রওনা হয়। পথে আলিনগর এলাকার মুক্তিযোদ্ধারাও তাদের সঙ্গে যোগ দেন। এ ছাড়া মহানন্দা নদী পেরিয়ে বোয়ালিয়া এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা রহনপুরে প্রবেশ করে। মুক্তিযোদ্ধারা আসছে শুনেই তারা রহনপুরে প্রবেশের আগেই পাকসেনারা রহনপুর এবি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে গড়ে তোলা সেনা ক্যাম্প গুটিয়ে ট্রেনযোগে পালিয়ে যায়। পরে মুক্তিযোদ্ধারা নাচোল-আমনুরা হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের দিকে রওনা করেন।
টাঙ্গাইল : ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলার সূর্যসেনারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে টাঙ্গাইলকে মুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এখানকার অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতাপূর্ণ যুদ্ধের কাহিনি দেশের সীমানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বজুড়ে। বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত ‘কাদেরিয়া বাহিনী’র বীরত্বের কথা স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। খন্দকার আবদুল বাতেনের নেতৃত্বে গঠিত ‘বাতেন বাহিনী’ও অনেক জায়গায় হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শুরুতেই ‘টাঙ্গাইল জেলা স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদ’ গঠন করা হয়। চলতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ। ৩ এপ্রিল মির্জাপুরের গোড়ান-সাটিয়াচড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের অবরোধ ভেঙে হানাদার বাহিনী টাঙ্গাইল শহরে প্রবেশ করে। অল্পদিনের মধ্যেই প্রতিরোধ গড়ে তোলে কাদেরিয়া বাহিনী। চারদিক থেকে তাদের আক্রমণে দিশাহারা হয়ে পড়ে পাকবাহিনী। ১০ ডিসেম্বর বিকালে টাঙ্গাইল শহরের অদূরে পৌলিতে মিত্রবাহিনীর প্রায় ২ হাজার ছত্রীসেনা অবতরণ করায় হানাদারদের মনোবল ভেঙে পড়ে। তারা ছুটতে থাকে ঢাকার দিকে। ১১ ডিসেম্বর ভোর থেকে বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধারা শহরে প্রবেশ করতে থাকেন। টাঙ্গাইল শহর শত্রুমুক্ত হয়। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে শহর।

দিনাজপুর : দিনাজপুরের হিলি মুক্ত দিবস আজ। ১৯৭১ সালের এই দিনে শত্রুমুক্ত হওয়ার প্রাক্কালে পাক-হানাদার বাহিনীর অতর্কিত হামলায় একসঙ্গে শহীদ হন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাসহ মিত্রবাহিনীর ৩৫৭ জন সদস্য। এর মধ্যে ৩৪৫ জন ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সদস্য।
মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর এত সংখ্যক সদস্য একসঙ্গে শহীদ হওয়ার নজির আর নেই।