নিজস্ব প্রতিবেদক : শুদ্ধি অভিযানে’র মধ্যে গত শনিবার আওয়ামী লীগের তৃণমূল সম্মেলন হয়েছে। দলের জাতীয় ত্রিবার্ষিক সম্মেলনের আগে তৃণমূলের প্রথম সম্মেলন হয়েছে ফেনীতে। তাই সারা দেশের দলীয় নেতাকর্মীদের চোখ ছিল এই সম্মেলনে। কারণ তৃণমূলে কারা নেতা হবেন সে ধরনের একটি পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছিলেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা।
বলা হয়েছিল, দল এবং সরকার আলাদা করা হবে। দুর্নীতিবাজ ও অরাজনৈতিক কাউকে নেতা বানানো হবে না। ফেনীর সম্মেলনে শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যের প্রতিফলন না দেখে হতাশ সারা দেশের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
ফেনীর নেতারা বলছেন, যেই লাউ সেই কদুই। বরং ফেনীর সভাপতি আবদুর রহমান বিকমকে বদলে দিয়ে আরও বেশি সমালোচনা সৃষ্টি করেছে ফেনী জেলার সম্মেলন। ফেনীতে আরও ক্ষমতার অধিপতি হলেন ফেনী-২ আসনের সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের দ্বিতীয়বার নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী। জয়নাল হাজারীর একসময়ের শিষ্য নিজাম হাজারী ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পৌরসভার মেয়র হিসেবে ফেনীর রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ধীরে ধীরে ফেনীর নিয়ন্ত্রণও নিতে শুরু করেন তিনি। এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ পরপর দুটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাংসদ নির্বাচিত হন।
এক যুগ ফেনী তার কব্জায়। ফেনীতে আরও দুজন সাংসদ থাকলেও তার কথার বাইরে যাওয়ার সাহস নেই তাদেরও। এর মধ্যে একজন অবশ্য জাসদ থেকে নির্বাচিত সাংসদ শিরীন আখতার, অপরজন জাতীয় পার্টির মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। ওই জেলার লোক নিজাম হাজারীকে চেনে ‘ফেনীর সরকার’ হিসেবে। তার কথার বাইরে যাওয়ার সুযোগ ও সাহস কারও নেই। ফেনীর আওয়ামী লীগ নেতারা তার এই শক্তির নেপথ্যের খুঁটি মনে করেন সাবেক এক সরকারি কর্মকর্তাকে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক প্রভাবশালী নেতাও রয়েছেন তার শক্তির উৎস হিসেবে। ফেনীর নেতারা বলেন, উনি যা বলেন, নিজাম তাই করেন।
নিজাম হাজারীর অরাজনৈতিক শক্তির কথা বলতে গিয়ে ফেনীর নেতারা বলেন, শনিবার ফেনীর সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিজাম হাজারীর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সাহস কেউ দেখাতে পারেনি। তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিসেবে দ্বিতীয়বার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সভাপতিও বানান তার ও সাবেক ওই কর্মকর্তার পছন্দের লোক আকরামুজ্জামানকে। যদিও সভাপতি পদে চারজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। পরে দুজন প্রত্যাহার করে নিলেও আবদুর রহমান বিকম প্রত্যাহার না করায় অবশেষে ‘ম্যানেইজড’ ভোট করে পছন্দের লোক আকরামুজ্জামানকে বিজয়ী করা হয়। ফেনীর নেতারা আরও বলেন, আওয়ামী লীগের নেতাদের জন্য এই জেলা আতঙ্কের। এখানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতেই ফুলগাজী উপজেলার চেয়ারম্যান সাবেক ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা একরামুল হক একরাম সন্ত্রাসী হামলায় মারা গেছেন। মারা গেছেন আরও অনেক নেতাকর্মী। নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অসংখ্য। তবুও মুখ খোলা যাচ্ছে না।
ফেনী জেলার কয়েক নেতা আরও বলেন, সভাপতি পদের ভোট করার ক্ষেত্রও তৈরি করেন নিজাম হাজারী। সর্বশেষ সদর উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থিতা নিয়ে মূলত সাবেক ওই সরকারি কর্মকর্তা ও নিজাম হাজারীর সঙ্গে জেলার সভাপতি রহমান বিকমের দূরত্ব তৈরি হয়। তাই রহমান বিকমকে সভাপতির পদ থেকে সরাতে উঠেপড়ে লাগেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের ম্যানেজও করেছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে রহমান বিকম বলেন, আমাকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করাতে কেন্দ্রীয় নেতারাও অনুরোধ করেন। কিন্তু নেত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমি কথা দিয়েছিলাম, তাই প্রত্যাহার করিনি।
ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় নেতা দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ ও সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম ফেনীর জেলা সম্মেলনে যান অতিথি হিসেবে। তারাও রহমান বিকমকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে নিরুৎসাহিত করেন। নাছোড়বান্দা রহমান বিকম প্রার্থিতা প্রত্যাহার করবেন না জানিয়ে দিলে সভাপতি পদে ভোট করার সিদ্ধান্ত নেন কেন্দ্রীয় নেতারা। জানতে চাইলে রহমান বিকম বলেন, এত কিছু আমাকে ঠেকানোর জন্যই জানতাম। তারপরও অনড় ছিলাম প্রত্যাহার না করার ব্যাপারে।
অবশ্য ভোটের সিদ্ধান্তে খুশি হন নিজাম হাজারী। পরে ভোটেই জিতিয়ে আনেন তার আস্থা ও বিশ্বাসের নেতা আকরামুজ্জামানকে। এ প্রসঙ্গে ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের বিদায়ী সভাপতি রহমান বিকম বলেন, আমাকে মেকানিজম করে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি জানতাম আমাকে সভাপতি হতে দেবে না। তারপরও আমি প্রার্থী হিসেবে থেকেছিলাম নেত্রীকে (শেখ হাসিনা) কথা দিয়েছিলাম বলে। কী কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, গতবার উপজেলা নির্বাচনে আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হলো। সব ঠিকঠাক। হঠাৎ করে একটি ফোন এলো। কোনো এক জায়গা থেকে। তখনই আমাকে বাধ্য করা হলো ফেনী সদর উপজেলার মনোনয়ন না দেওয়ার ব্যাপারে। আমি নেত্রীর কাছে গেলাম। সব খুলে বললাম। নেত্রী আমাকেই নির্বাচন করার অনুমতি দিলেন। ওই সময় নেত্রী বলেছিলেন সম্মেলনের সময়ও আপনাকে বাধ্য করা হলে প্রার্থী না হয়ে ঢাকায় চলে আসবেন নাকি। তখন আমি বললাম না নেত্রী, আমি আসব না। সে কথাটিই আমি রেখেছি। তিনি বলেন, নির্বাচনের সময় ওই ফোনের কথামতো চলিনি বলেই আমাকে মাসুল গুনতে হয়েছে। ৫২ বছর রাজনীতি করেন জানিয়ে আবদুর রহমান বিকম বলেন, রাজনীতি এখন রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। মাসলম্যান ও কিছু পয়সাওয়ালার হাতে চলে গেছে। কার ফোন ছিল সেটি জানতে চাইলে তিনি বলেন, তা বলে আর কিছু হারাতে চাই না।
সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত বাংলাদেশ আ’লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য ফেনীর সাবেক সাংসদ জয়নাল হাজারী গত ২৯ অক্টোবর গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাতকারে ভূমি মালিকদের বরাত দিয়ে বলেন, শুদ্ধি অভিযানের মধ্যে ২১জন নিরীহ ভূমি মালিকদের ১০ কোটি মূল্যের জায়গা দখল করে ফেনী জেলা আ’লীগ কার্যালয় করার পায়তারা করছে এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারী।
অপরদিকে, যুবলীগ থেকে বহিষ্কৃত নেতা ইসমাঈল হোসেন সম্রাটের ‘গুরু’ ও ‘সহযোগী’ খ্যাত বাংলাদেশি এমপিদের সিক্রেট মিশনের বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান শুরু করেছে সরকারের একাধিক টিম ও সংস্থা। এরই মধ্যে তারা ঢাকায় রিপোর্টও পাঠানো শুরু করেছেন। তদন্ত সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে লাখ-কোটি টাকা পা’চার করা হয়েছে সিঙ্গাপুরে। অবৈধ পথে আয় করা বিপুল পরিমাণ ওই অর্থ কতিপয় ব্যক্তির মনোরঞ্জন আর ব্যক্তিগত ভোগবিলাসের জন্য বিদেশে পাচার করেছেন।
এর একটি অংশ গেছে জুয়া, লটারি, ক্যাসিনোতে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, পাচারকারীদের তালিকা বেশ দীর্ঘ। প্রতিনিয়ত তালিকায় নতুন নতুন নামের সংযোজন ঘটছে। সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ,মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড, কানাডা, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
বিদেশ থেকে প্রাপ্ত তথ্য, দালিলিক প্রমাণের ভিত্তিতে সংসদ সদস্য, ব্যবসায়ী, আমলা এবং তাদের সহযোগী ‘সম্রাট’দের চলাফেরায় বিধিনিষেধ আরোপসহ নানা পদেক্ষপ নেয়া হচ্ছে।
ক্যাসিনো-জুয়া খেলতে নিয়মিত সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় যাতায়াতকারী বি’তর্কিত যুব নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাটের ঘনিষ্ঠ নিজাম উদ্দিনসহ ৫ এমপি, ১০ ব্যবসায়ী, ৯ যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা এবং সম্রাটের ৩ জন আত্মীয়ের বিদেশে থাকা অর্থ সম্পদ, বাড়ি-গাড়ির খোঁজে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন সরকারের বিভিন্ন ইউনিটের গোয়েন্দারা।
চালু আছে- ঢাকায় সম্রাটের আগে যুবলীগের দায়িত্ব পালনকারী বর্তমানে বৃহত্তর বরিশালের এক এমপি সিঙ্গাপুরেও সম্রাটদের পথপ্রদর্শক! কিন্তু আজ কর্মগুণে এমপি ‘গুরু’কেও টপকে গেছেন শিষ্য ইসমাইল সম্রাট। ওই এমপির জগত কেবল সিঙ্গাপুর হলেও ‘শিষ্য’ সম্রাটের নেটওয়ার্ক মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া হয়ে সুইজারল্যান্ড অবধি বিস্তৃত!
ওইসব দেশেও তার বিপুল সম্পদ থাকার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে বলে দাবি অনুসন্ধানকারী সূত্রের। তাদের দাবি মতে, সিঙ্গাপুর কানেকশন রয়েছে- এমন ৫ এমপির মধ্যে ক্যাসিনোতে অর্থ উড়ানো ফেনীর এমপি নিজাম উদ্দিন, কিশোরগঞ্জের একজন এবং বরিশালের দুজন প্রভাবশালী তরুণ এমপির বিষয়ে তারা নিশ্চিত ! সুনামগঞ্জের একজন এমপির নামও তারা পেয়েছেন, যিনি এক সময় শেরাটনে সাপ্লাইয়ের ‘ব্যবসা’ করতেন। সিঙ্গাপুরে তিনি অর্থকড়ি সরিয়েছেন, নানা আড্ডায় সময় কাটিয়েছেন এটা প্রায় নিশ্চিত। তবে তার জুয়া বা ক্যাসিনো কানেকশনের প্রমাণাদি এখনো পুরোপুরি পাওয়া যায়নি। দায়িত্বশীল সূত্র মতে, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে থাকা তথ্য মিলিয়ে তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা পেয়েছেন কর্মকর্তারা।
এতে রাঘব বোয়ালদের নাম এলেও তাদের কাউকে ছাড় না দিতে সরকারপ্রধানের তরফে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে বলে সূত্র জানায়।