নগদ টাকায় পিয়াজ কেনার জন্য কাড়াকাড়ি
মহসীন আহমেদ স্বপন : সকল নৈরাজ্যের রেকর্ড ভেঙে পেঁয়াজ এখন রাজধানির বাজারে ২০০টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। গত কয়েক মাস ধরে পেঁয়াজের বাজারে চরম অস্থিরতার ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার এই মূল্যে ক্রেতাদের পেঁয়াজ কিনতে হয়েছে। একদিকে পেঁয়াজের বাজারে যখন রীতিমতো নৈরাজ্য চলছে তখনি দায়িত্বশীলদের মন্তব্যে জনসাধারণের মাঝে হতাশার সৃস্টি হয়েছে। গত মঙ্গলবার বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির অনুপস্থিতিতে সংসদে শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন জোর দিয়ে বলেন বতর্মানে পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অথচ পেঁয়াজের মূল্য নিয়ে বাজারে বাজারে ক্রেতা বিক্রেতাদের মধ্যে চলছে বিবাদ বাক-বিতান্ডা।
বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা যায় দেশি পেঁয়াজ কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ১৯০ থেকে ২০০ টাকা দরে। পাইকারি বাজারে মিসর থেকে আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। আর মিয়ানমার থেকে আনা ভালো মানের পেঁয়াজের দাম ছুঁয়েছে ১৯০ টাকা কেজি। আর মিয়ানমার থেকে আনা মাঝারি মানের পেঁয়াজের দর ১৬০ টাকা কেজি। বেশ কয়েকটি বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের পেঁয়াজ আমদানির কথা থাকলেও এখনো তা এসে পৌঁছায়নি বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে ক্রেতাদের অভিযোগ, ইচ্ছেমতো দাম রাখছেন বিক্রিতারা। তারা বলছেন, দামের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস তাদের।
মিরপুরের পীরেরবাগ কাচাবাজারে গিয়ে দেখা যায়, দেশি ক্রস জাতের পেঁয়াজ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকায়। এর থেকে বাছাই করা তুলনামূলক ভালো মানের পেঁয়াজের দাম চাওয়া হচ্ছিল প্রতি কেজি ২০০ টাকা।
এই বাজারের একটি মুদি দোকানের সামনে প্রায় আধা ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে অন্তত পাঁচজন ক্রেতাকে পেঁয়াজের দাম শুনে ভ্রু কুচকাতে দেখা যায়। অন্য দুটি দোকানে গিয়েও একই দাম দেখেন তারা। এক পর্যায়ে পেঁয়াজ ছাড়া কাচাবাজারের অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনেই বাড়ি ফেরেন এসব ক্রেতা।
এর মধ্যে এই দোকান থেকে মাত্র একজনকে আধা কেজি পেঁয়াজ কিনতে দেখা যায়।
মুদি দোকানি মুরাদ হোসেন বলেন, মঙ্গলবার মিরপুর-১ নম্বরের পাইকারি বাজার থেকে প্রতি কেজি ১৫৫ টাকা দরে পেঁয়াজ কিনে এনেছেন তিনি। এর সঙ্গে পরিবহন ব্যয় যোগ করে এখন তিনি প্রতি কেজি ১৭০ টাকায় বিক্রি করছেন।
কোনোভাবেই পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বুধবারের চেয়েও গতকাল দেশি পেঁয়াজের দাম ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ১৯০ টাকায়। আর মিয়ানমারের পেঁয়াজ একদিনের ব্যাবধানে ৪০ টাকা বেড়ে ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মিশরের বড় বড় আকারের পেঁয়াজ ১৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। বৃহস্পতিবার কাপ্তান বাজার, রায়ের বাজার ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।
পেঁয়াজের এমন লাগামহীন দামে ক্ষোভ ক্রেতাদের মাঝে। পেঁয়াজের বাজার কারা নিয়ন্ত্রণ করছেন সে প্রশ্ন সাধারণ মানুষের। মিয়ানমার থেকে ৪২ টাকা দরে পেঁয়াজ কেনার পরেও দেশে কোন অজুহাতে এত দাম? সে প্রশ্নও ক্রেতাদের। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান তাদের।
বিক্রেতাদের দাবি, তাদের বেশি দামে কিনতে হয় বলেই বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায় পেঁয়াজের মুল্য নিয়ে ক্রেতা বিক্রেতা বিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন। ব্যবসায়ীদের দাবি, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকার কারণে পেঁয়াজের দাম না কমে বাড়ছে। এদিকে ক্রেতাদের অভিযোগ, ইচ্ছেমতো দাম রাখছেন বিক্রিতারা। রাজধানীর তোপখানা রোডের ব্যবসায়ি নাজমুল জানান বুধবার রাত থেকেই দেশী পেঁয়াজ ১৯০ থেকে ২০০ টাকা দরে বিক্রি করছি। তবে মিশরীয় ও বার্মার পেঁয়াজ ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সেগুনবাগিচা এলাকার কাঁচাবাজারের নিয়োমিত ক্রেতা রহিদুল রহিম বলেন ২০০টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ কিনলাম আমার জীবনে যা বিরল।
পেঁয়াজের বাজারের অস্থিরতার বিষয়ে কথা বলার জন্য বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীর দফতরে যান সাংবাদিকরা। তবে বাণিজ্যমন্ত্রী দেশের বাইরে রয়েছেন, আর বাণিজ্য সচিব এ বিষয়ে গাণমাধ্যমে কথা বলতে রাজি হননি।
রাজধানীর কাপ্তান বাজারে পেঁয়াজ কিনতে আসা রনি বলেন, আজ (বৃহস্পতিবার) ১৯০ কেজিতে পেঁয়াজ কিনলাম। আসলে পেঁয়াজ খেতে হয়, তাই খাই। নচেৎ যে অবস্থা, খুব খারাপ, শোচনীয় অবস্থা। আগে সপ্তাহে অন্তত দুই কেজি কিনতাম, এখন সেটি কামিয়ে ১ কেজিতে নিয়ে এসেছি।
তিনি বলেন, পেঁয়াজের বাজার কে নিয়ন্ত্রণ করছে, জানি না। তবে দিনে দিনে পেঁয়াজের দাম যে হারে বাড়ছে, তাতে করে আমরা অতীষ্ট।
এ বিষয়ে কাপ্তান বাজারের পেঁয়াজ-রসুন বিক্রেতা রুবেল বলেন, শ্যাম বাজার থেকে ১৭৫ টাকা কেজি করে পেঁয়াজ কিনে নিয়ে এসেছি। বিক্রি করছি খুচরা ১৯০ টাকা এবং পাইকারিতে ১৮৫ টাকা করে।
তিনি বলেন, বুধবার বার্মার পেঁয়াজ বিক্রি করেছি ১৪০ টাকা করে। আজ (বৃহস্পতিবার) শ্যামবাজারে বার্মার পেঁয়াজ পাওয়া যায়নি। তাই বাংলাদেশি-টা নিয়ে এসেছি। পাইকারিতে শ্যমাবাজারেই ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে’, বলে জানান তিনি।
রুবেল বলেন, শ্যামবাজারে মিশরের পেঁয়াজও পাওয়া যায়নি। বাজারে পেঁয়াজের পরিমাণ খুব কম বলেও জানান এ পেঁয়াজ বিক্রেতা।
কাপ্তান বাজারের আরও এক পেঁয়াজ-রসুন বিক্রেতা বাদল বলেন, মিশরের বড় বড় সাইজের পেঁয়াজ আজকে (বৃহস্পতিবার) ১৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি করা হচ্ছে। আর বার্মারটা বিক্রি করছি ১৮০ টাকা কেজি। প্রতিকেজি পেঁয়াজের দাম ২০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
এদিকে গত সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে এসে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ার পর খোলা বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করে সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। সর্বশেষ প্রতিদিন ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ৩৫টি ট্রাক বসিয়ে প্রতি কেজি ৪৫ টাকা দরে পেঁয়াজ বিক্রি করছিল সংস্থাটি।
একজন ক্রেতা এক কেজি করে পেঁয়াজ কিনতে পারছিলেন। আর ট্রাক সেলের ডিলার পাচ্ছিলেন প্রতি দিন এক টন করে পেঁয়াজ। অর্থাৎ দিনে একটি ট্রাক থেকে প্রায় এক হাজার পরিবারের পেঁয়াজের চাহিদা পূরণ হচ্ছিল।
তবে চলতি সপ্তাহে শুক্র ও শনিবার সপ্তাহিক ছুটির কারণে বিক্রি বন্ধ ছিল। রোববার ছিল সরকারি ছুটি। তাই এই তিন দিন টিসিবির পেঁয়াজ বিক্রি বন্ধ ছিল। তবে সোমবার বিক্রি হয়।
এ ছাড়া সরবরাহ ঘাটতির কারণে মঙ্গলবার পেঁয়াজ বিক্রি করতে পারেনি টিসিবি। তবে গত বুধবার এবং বৃহস্পতিবার আবার পেঁয়াজ বিক্রি করা শুরু করেছে টিসিবি।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ভারত কর্তৃপক্ষ পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ ঘোষণা করে। বিকল্প হিসেবে মিয়ানমার থেকে এলসি এবং বর্ডার ট্রেডের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পেঁয়াজ আমদানি শুরু করে বাংলাদেশ। পাশাপাশি মিসর ও তুরস্ক থেকেও এলসির মাধ্যমে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হয়। সম্প্রতি মিয়ানমারও পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি করে। ফলে বাংলাদেশের বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে।
এদিকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাবুল কুমার সাহার কাছে পেঁয়াজের মুল্য নিয়ে তাদের বর্তমান করণীয় বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি দৈনিক সকালের সময়কে বলেন, এই ধরনের কোনো কিছু জানতে হলে আমার অফিসে আসতে হবে।
তবে দেশের মানুষের বিশ্বাস একমাত্র প্রধানমন্ত্রিই বর্তমানে পেঁয়াজের বাজারে নৈরাজ্য ঠেকাতে পারবেন অন্যথায় কারোরই পক্ষে সম্ভব নয় কারণ কারোরই কথা বিশ্বাস যোগ্য নয়, কথার ফুলঝুরি ছড়ানো সংশ্লিষ্ট সকলেই যেন মাদকাসক্তদের মত অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছেন। আজ কয়েক মাস ধরে পেঁয়াজের নৈরাজ্য চলছে, এটা ঠেকাতে কেউ পারেননি। কেউ আসেননি।
নগদ টাকায় পিয়াজ কেনার জন্য কাড়াকাড়ি : বিনামূল্যে পণ্য পাওয়ার কোনো চিত্র নয়, মূলত পিয়াজ কেনার জন্য ক্রেতাদের উচ্চবাচ্য ও কাড়াকাড়ির ঘটনা ঘটেছে। বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে টিসিবি’র ভ্রাম্যমাণ পিয়াজ বিক্রয়কেন্দ্রে এমন ঘটনা ঘটে।
সকাল থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে টিসিবি’র ট্রাক ঘিরে দেখা গেছে দীর্ঘ লাইন। এসব ট্রাকে মসুর ডাল, চিনি, সয়াবিন তেল বিক্রি হলেও বেশি চাহিদা ছিল পিয়াজের। এখানে পিয়াজের মূল্য কেজি প্রতি ৪৫ টাকা। এদিকে, বৃহস্পতিবার রাজধানীতে খুচরা পর্যায়ে পিয়াজের মূল্য কেজি প্রতি ১৯০ থেকে ২০০ টাকা। তাই বৃহস্পতিবার টিসিবির এই বিক্রয়কেন্দ্রে খুব চাপ পোহাতে হয়েছে বিক্রেতাদের। অন্যদিকে তুলনামূলক অনেক সস্তায় পিয়াজ কেনার জন্য ছিল দীর্ঘ লাইন। একটা পর্যায়ে ট্রাকে রক্ষিত পিয়াজ যখন শেষ হয়ে আসছিল, তখন অনেককে উচ্চবাচ্য ও লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে ধাক্কাধাক্কিও করতে দেখা গেছে। দুপুর ২টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত টিসিবির এই ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের পিয়াজ বিক্রি পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়।