অর্থনৈতিক প্রতিবেদক : বিভিন্ন অপকর্ম ও অনিয়মে ধংস হয়ে যাওয়া সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালসের ২০২২-২৩ অর্থবছরের আর্থিক হিসাবে গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন নিরীক্ষক। যে কোম্পানির আর্থিক হিসাবে কোম্পানি কর্তৃপক্ষের দেখানো আয়, ব্যয়, মজুদ পণ্য, গ্রাহকের কাছে পাওনা (দেনাদার), ডেফার্ড ট্যাক্স, স্থায়ী সম্পদ, অবন্টিত লভ্যাংশ, ট্যাক্স প্রদান, ব্যাংক হিসাবসহ আরও অনেক বিষয়ের সত্যতা পায়নি নিরীক্ষক। যে কোম্পানিটির আর্থিক হিসাব শুধুই মিথ্যার উপর ভিত্তি করে তৈরী করা হয়েছে। যার সঠিক তথ্য তুলে ধরা হলে, কোম্পানির কিছুই নাই।অনিয়মের বিষয়ে শেয়ারাবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহি পরিচালক ও মূখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম গণমাধ্যম কে বলেন, অর্থবছর শেষে নিরীক্ষকের মতামতসহ তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বার্ষিক প্রতিবেদন কমিশনে আসে। যা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যাচাই-বাছাই করে। এতে কোন অনিয়ম বা অসঙ্গতি পেলে, কমিশন আইন অনুযায়ি ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সেন্ট্রাল ফার্মায়ও তার ব্যতিক্রম হবে না।
সেন্ট্রাল ফার্মার কাছে ২০০৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৯৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা আয়কর দাবি করে ২০২২ সালের ১৫ মার্চ চিঠি দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কিন্তু কোম্পানিটির এর বিপরীতে মাত্র ২৮ কোটি ২ লাখ টাকার প্রভিশনিং করা আছে। বাকি ৭০ কোটি ৮০ লাখ টাকার বিপরীতে কোন প্রভিশনিং বা এনবিআর এর সঙ্গে বিষয়টি সমাধান করেনি। এর মাধ্যমে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ৭০ কোটি ৮০ লাখ টাকার সম্পদ বেশি দেখিয়ে আসছে।
এদিকে ভ্যাট কর্তৃপক্ষ কোম্পানিটির কাছে বিভিন্ন অর্থবছরের জন্য ২৩ কোটি ১ লাখ টাকার ভ্যাট ও শাস্তি দাবি করেছে। কিন্তু কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ওই অর্থ প্রদান বা সমাধান করেনি। এছাড়া প্রভিশনিংও গঠন করেনি। এর মাধ্যমেও কোম্পানিটিতে ২৩ কোটি ১ লাখ টাকার সম্পদ বেশি দেখানো হচ্ছে।
নিরীক্ষক জানিয়েছেন, কোম্পানিটির আর্থিক হিসাবে জনতা ব্যাংক থেকে ২৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকার ঋণ দেখানো হয়েছে। কিন্ত এর বিপরীতে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ব্যাংক স্টেটমেন্ট বা ব্যাংক সার্টিফিকেট দিতে পারেনি। এছাড়া ব্যাংকে চিঠি দিয়েও ওই ঋণের বিষয়ে কোন সাড়া পায়নি নিরীক্ষক। যে কোম্পানিটি ঋণের কিস্তি প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে।
নিরীক্ষক জানিয়েছে, গ্রাহকদের কাছে ৮ কোটি ৪ লাখ টাকা পাওয়া যাবে বলে আর্থিক হিসাবে উল্লেখ করেছে। কিন্তু এর বিপরীতে পর্যাপ্ত প্রমাণাদি দিতে পারেনি কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। যে অর্থ দীর্ঘদিন ধরে দেখিয়ে আসা হচ্ছে। যা আদায় নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন নিরীক্ষক। কিন্তু কোম্পানি কর্তৃপক্ষ কোন প্রভিশনিং গঠন করেনি। এর মাধ্যমেও সম্পদ বেশি দেখানো হচ্ছে।
এদিকে স্পেয়ার পার্টস অ্যান্ড সাপ্লাইস হিসেবে দেখানো ১ কোটি ৪৮ লাখ টাকার বিপরীতেও কোন প্রমাণাদি পায়নি নিরীক্ষক। যা সম্পদ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে দেখিয়ে আসা হচ্ছে। তবে ওই সম্পদ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন নিরীক্ষক। কিন্তু কোম্পানি কর্তৃপক্ষ কোন প্রভিশনিং গঠন করেনি। এর মাধ্যমেও সম্পদ বেশি দেখানো হচ্ছে।
সেন্ট্রাল ফার্মার জনতার ব্যাংকের ঢাকা লোকাল অফিসে ৩টি হিসাব রয়েছে। যেগুলো ট্যাক্স অথোরিটি লেনদেন অযোগ্য (ফ্রিজ) করে রেখেছে। তাদের দাবিকৃত ৯ কোটি ৩১ লাখ টাকার ট্যাক্সের জন্য ২০১৫ সালে এমনটি করে রেখেছে। তবে এখনো এ বিষয়টির কোন সমাধান বা উন্নতি হয়নি। যাতে কোম্পানি নগদে লেনদেন করছে।
এই কোম্পানি কর্তৃপক্ষ এখন ইসলামী ব্যাংকে একটি হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ করে। তারা ইসলামী ব্যাংক ছাড়া অন্যসব লেনদেন নগদে করে। অধিকাংশ লেনদেন নগদে করার কারনে ব্যয় কম বা বেশি দেখানো যায়। এছাড়া আয়ও বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেখানো যায় বলে জানিয়েছেন নিরীক্ষক। যা হরহামেশ করাও হয়।
কোম্পানিটির আর্থিক হিসাবে অগ্রিম প্রদান হিসেবে ২৮ কোটি ৭১ লাখ টাকার সম্পদ দেখানো হয়েছে। এরমধ্যে ৩ লাখ ৫২ হাজার টাকা অগ্রিম আয়কর প্রদান। বাকি ২৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকার বিষয়ে কোন প্রমাণাদি দেখাতে পারেনি নিরীক্ষককে। এমনকি যথাযথ ঠিকানার অভাবে কাদেরকে ওই টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে চিঠি দিয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি নিরীক্ষক। যা দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক হিসাবে দেখিয়ে আসছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ যা একপ্রকার জালিয়াতি । যা আদায় বা সমন্বয় নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন নিরীক্ষক। কিন্তু কোম্পানি কর্তৃপক্ষ কোন প্রভিশনিং না করে সম্পদ বেশি দেখিয়ে দীর্দিন যাবত জাল-জালিয়াতি চালিয়ে আসছে।
কোম্পানিটির ৬৮ লাখ টাকার মজুদ পণ্যেরও সত্যতা পায়নি নিরীক্ষক। এছাড়া ২ কোটি ৯৩ লাখ টাকার ওষুধ বিক্রি, ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকার কাঁচামাল ক্রয় ও ৩৯ লাখ টাকার প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল ক্রয়ের সত্যতা পায়নি নিরীক্ষক। এমনকি ২ কোটি ৯৩ লাখ টাকার ওষুধ বিক্রির বিপরীতে ২ কোটি ৮ লাখ টাকার কাচাঁমাল ব্যবহার, ১৭ লাখ টাকার ডিরেক্ট ব্যয়, ২ কোটি ৯২ লাখ টাকার ম্যানুফ্যাকচারিং ওভারহেড, ৮২ লাখ টাকার প্রশাসনিক ব্যয় ও ১ কোটি ৮ লাখ টাকার বিক্রি ও বিতরন ব্যয়ের বিপরীতে প্রমাণাদি দেখাতে পারেনি।
২০১৩ সালে শেয়ারবাজারে আসা কোম্পানিটিতে এখনো আইপিও আবেদনকারীদের ৬০ লাখ টাকা পড়ে রয়েছে। আইপিওতে আবেদন করে শেয়ার না পাওয়া সত্ত্বেও ওই টাকা কোম্পানিতে রয়ে গেছে। এছাড়া কোম্পানিটিতে ৯ লাখ টাকার অবন্টিত লভ্যাংশ রয়েছে। কিন্তু এ অর্থ বিএসইসির ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডে স্থানান্তর করেনি।
সেন্ট্রাল ফার্মার আর্থিক হিসাবে ২৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকার স্থায়ী সম্পদ দেখানো হয়েছে। কিন্তু এরমধ্যে কারখানা ও অধিকাংশ মেশিনারীজ প্রায় ধংস হয়ে গেছে। তারপরেও তারা ইমপেয়ারমেন্ট করে প্রকৃত অবস্থা বা বাজার দর নির্ণয় করেনি।
এসব বিষয়ে জানতে সেন্ট্রাল ফার্মার মালিক মো: মুনসুর আহমেদ ও কোম্পানি সচিব মো. তাজুল ইসলামের ব্যক্তিগত ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।বিধায় তাদের কোন প্রকার বক্তব্য প্রকাশিত হলো না।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া সেন্ট্রাল ফার্মার পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ১১৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এরমধ্যে শেয়ারবাজারের বিভিন্ন শ্রেণীর (উদ্যোক্তা/পরিচালক ব্যতিত) বিনিয়োগকারীদের মালিকানা ৭৪.১১ শতাংশ। কোম্পানিটির সোমবার (১১ ডিসেম্বর) লেনদেন শেষে শেয়ার দর দাঁড়িয়েছে ২৩.৫০ টাকায়।