আজকের দেশ ডেস্ক : ২৩ ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। আজ পূর্ণ হলো বঙ্গবন্ধু উপাধির ৫১ বছর। একদিনে আসেনি বঙ্গবন্ধু উপাধি। তার পেছনে রয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের ১৩ বছর জনগণের মুক্তির জন্য পাকিস্তান জেলে থাকার ঘটনা। বিশ্বের কোনও নেতা জনগণের জন্যে এত ত্যাগ স্বীকার করেননি।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হিসেবে কারাগারে বন্দী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি পান। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হিসেবে কারাগারে বন্দী থেকে মুক্তি পান। আগরতলা মামলা থেকে সবে মাত্র মুক্তি লাভ করে ফিরে আসা শেখ মুজিবুর রহমানকে ২৩ ফেব্রুয়ারি গণসংবর্ধনা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আর সে গণসংবর্ধনায় শেখ মুজিবুর রহমানকে কী উপাধিতে ভূষিত করা হবে তা নিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
গণসংবর্ধনায় উপাধি প্রদান নিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা আলোচনায় বসেছিলেন। তখন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হয়েছিল। সমগ্র জাতি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা স্থাপন করেছিলো। যে মানুষটি শুধুমাত্র পূর্ব বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা, স্বাধিকারের জন্য তার জীবনের মূল্যবান গুরুত্বপূর্ণ সময় জেলে কাটিয়েছেন; অকুতোভয় যার প্রতিটি উচ্চারণ, তাকে গণ উপাধিতে ভূষিত করার বিষয় সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঐতিহাসিক কারণেও উপাধি দেয়া ছিলো ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের কর্তব্য। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানকে নতুন নামে উপাধিতে ভূষিত করার।
অনেক নামে তাকে ডাকা হতো। বাংলার নয়নমণি, বঙ্গশার্দুল, অবিসংবাদিত নেতা, বাঙালির মুক্তিদাতাসহ বিভিন্ন নামে ভূষিত করা হলেও অর্পূণ ছিল জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের উপাধি। আর সে অপূর্ণতা পূরণ হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯। আর ইতিহাস হয়ে গেল সেদিনের তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত গণসংবর্ধনা সমাবেশ।
এদিন বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের আপোষহীন নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ভূষিত করা হয় নতুন উপাধিতে। আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি লাভের পর রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানকে দেয়া সে গণসংবর্ধনায় দশ লাখেরও বেশি মানুষের রায় নিয়ে তৎকালীন ডাকসুর ভিপি ও সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি তোফায়েল আহমেদ ঘোষণা করেন ‘আজ থেকে তিনি আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’।
একটি কবিতা থেকে বাঙালি ইতিহাসে অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি। সে কবিতার প্রতিটি লাইনে শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু বলে সম্বোধন করা হয়েছিল। কবিতাটির নাম ছিল ‘বঙ্গবন্ধু’। যার অর্থ বাংলার জনগণের বন্ধু। কবিতা লিখেছিলেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন (ডিইউসিএসইউ)-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য তোফায়েল আহমেদ রাজনৈতিক ছোট ভাই।
সেদিনের সেই আলোচনায় প্রধান্য পায় কবিতা থেকে নেয়া ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য তোফায়েল আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের সকলের কাছেই বেশ ভালো লাগলো। আমরা সকলেই একমত হলাম। ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটির অর্থ সে কি বিশাল! তিনিই বঙ্গবন্ধু যিনি ভালোবাসেন, শুধু ভালোবাসেন না ভালোবাসার জন্য আপোষহীন আমৃত্যু সংগ্রাম করেন, যার ভালোবাসা নির্লোভ-নিঃস্বার্থ। শেখ মুজিবুর যখন বঙ্গবন্ধু তখন তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার প্রকৃতির বন্ধু, বাংলার ভাষা কৃষ্টি সংস্কৃতির বন্ধু, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বন্ধু, জাতীয়তাবোধের বন্ধু, মুক্তিসংগ্রামের বন্ধু সুতরাং একমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানই ‘বঙ্গবন্ধু’। ওই বৈঠক থেকে আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেই আমরা আমাদের নেতাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করবো।’
১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে সেদিন লাখ লাখ জনতার ঢল নেমেছিল। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত সে বিশাল গণসংবর্ধনায় সভাপতির বক্তব্যে দিতে দাঁড়ালেন তৎকালীন ডাকসুর সভাপতি, শেখ মুজিবের একনিষ্ঠ সহচর তোফায়েল আহমেদ।
তিনি জনগণের কাছে প্রশ্ন করলেন, যে নেতা তার যৌবনে কাটিয়েছেন কারাগারে, মৃত্যু ভয় যার কাছে ছিল তুচ্ছ; যে নেতা বলেছেন, আমি ক্ষুদিরামের বাংলার মুজিব, সূর্যসেনের বাংলার মুজিব; যিনি বলেছিলেন বাংলার মানুষের জন্য আমি হাসিমুখে জীবন দিতে পারি… সেই নেতাকে কী আমরা একটি উপাধি দিয়ে বরণ করতে পারি?
তিনি আরও মাইকে ঘোষণা করেন, ‘কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি ঋণের বোঝা হালকা করতে চায়। জাতির পক্ষ থেকে প্রিয় নেতাকে উপাধি দিতে চাই।’ রেসকোর্স ময়দান প্রকম্পিত করে প্রায় ১০ লাখ মানুষ দু’হাত তুলে সমর্থন করেন তাকে। সে সময়ে তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান হাজার বছরের মহাপুরুষ, লাঞ্চিত-বঞ্চিত বাঙালির নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করলাম। আজ থেকে তিনি আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান…। লক্ষ কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হলো জয় বঙ্গবন্ধু…।
তারপর তোফায়েল আহমেদ বলেন, এবার বক্তৃতা করবেন আমাদের প্রিয় নেতা ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমান। সে সময় বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতাও ঘোষণা করা হয়। তখন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা রূপে আত্মপ্রকাশ করেন শেখ মুজিবুর রহমান।
পরে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালিরা তাদের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে স্বাধীনতা অর্জন করে। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ যাকে মহাত্মা উপাধি দিয়েছিলেন সেই মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, শেরে বাংলা একে ফজলুল হকসহ পৃথিবীতে অনেকেই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপাধি পেয়েছেন। কিন্তু ফাঁসির মঞ্চ থেকে মুক্ত হয়ে, গণমানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে, এমন আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে কেউ উপাধি পাননি। এরপর থেকেই জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে গেলেন বাঙালির প্রিয় ‘বঙ্গবন্ধু’।