সাবেক আইনমন্ত্রীর  ব্যক্তিগত সহকারী হওয়ার পর ভাগ্য বদলে যায় আলাউদ্দিন বাবু ও সফিকুল ইসলাম সোহাগের : অল্পদিনের মধ্যেই বনে যান কয়েকশ কোটি টাকার মালিক

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত জাতীয় ঢাকা বিশেষ প্রতিবেদন রাজধানী সারাদেশ

!!   থানার দারোগা-ওসি, সাবরেজিস্ট্রার, জেলা রেজিস্ট্রার বদলি বাণিজ্য, সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেওয়ার দোকান খুলে বসেন। দুহাতে কামাই করতে শুরু করেন কোটি কোটি টাকা। সাবরেজিস্ট্রার বদলির ক্ষেত্রে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়। জেনে যাওয়ার ভয়ে এসব পদে কর্মরত এলাকার লোকদের দূরে সরিয়ে রাখেন। বরং তাদের সঙ্গে চাকরের মতো আচরণ করতে শুরু করেন। সূত্র জানায়, সাবরেজিস্ট্রার বদলির শতকরা ৯০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে আলাউদ্দিন বাবু আর সফিকুল ইসলাম সোহাগের মাধ্যমে। স্থান ভেদে ৪০ লাখ থেকে শুরু করে ৫০-৬০ লাখ, এমনকি দেড় থেকে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় সাবরেজিস্ট্রার বদলির ক্ষেত্রে। যে বেশি টাকা দিতো তাকেই ভালো জায়গায় পোস্টিং দেওয়া হতো। টাকা কম দিলে বেশি টাকা দেওয়ার লোক আছে বলে টাকার অঙ্ক বাড়ানো হতো। তেজগাঁও রেজিস্ট্রি কমপ্লেক্সে খিলগাঁও, উত্তরা, বাড্ডা, পল্লবী, গুলশান, শ্যামপুর, মিরপুর, সাভার, রূপগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ এসব স্থানে বদলির জন্য একেকজন সাবরেজিস্ট্রারকে ২ কোটি টাকার উপরে দিতে হয়েছে। সাবরেজিস্ট্রার ছাড়াও বিচারাঙ্গনের লোকজনও ভালো পোস্টিংয়ের জন্য ধরনা দিয়েছেন বাবু আর সোহাগের কাছে। পিএ হলেও এপিএসের চেয়ারেই বসতেন আলাউদ্দিন বাবু। তার জন্য গুলশান অফিসে এসি রুম এবং একটি জিপ বরাদ্দ ছিল  !! 


বিজ্ঞাপন
সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে কাজের লোক থেকে বেক্তিগত সহকারী বনে যাওয়া  আলাউদ্দিন বাবু ও শফিকুল ইসলাম সোহাগ।

 

 

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : চাকরি, বদলি বাণিজ্য, মাদকের সিন্ডিকেট পরিচালনা, পাহাড় কাটা, মামলা দিয়ে মানুষকে হয়রানি করা, কোনো অপকর্মই বাদ ছিল না আলাউদ্দিন বাবু ও শফিকুল ইসলাম সোহাগের। এ দুজন পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আইনমন্ত্রী ও কসবা-আখাউড়ার সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আনিসুল হকের দুই ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ)। কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তারা। সম্পদের পাহাড় বানিয়েছেন।


বিজ্ঞাপন

বাবু আর সোহাগ এই দুই নামেই মুখর ছিল গত এক দশক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা ও আখাউড়া উপজেলা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছিল সোহাগ-বাবুর বন্দনা। তাদের খুশি করাই যেন ছিল সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নির্বাচনি এলাকার এ দুই উপজেলার সুযোগ-সুবিধাবাদী মানুষের কাজ।

আলাউদ্দিন বাবু একাধিকবার পরীক্ষা দিয়ে এসএসসি পাশ করেন বাবু। ২০১৩ সালে জীবিকার জন্য পাড়ি জমান বাহরাইনে। আনিসুল হক প্রথম বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি এবং মন্ত্রী হওয়ার পর কয়েক মাসের মধ্যে দেশে ফিরে আসেন বাবু। এরপর মন্ত্রীর বাসায় কাজের লোক হিসেবে যোগ দেন।

মন্ত্রীর গুলশান অফিসে যাওয়া-আসা ছিল এমন কয়েকজন জানান, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মন্ত্রীর অফিসে চা পরিবেশন করতেন বাবু। পিএ হওয়ার আগে ৫শ থেকে ১ হাজার টাকাতেই তার হাসিমুখ দেখা গেছে; কিন্তু পরে আর বান্ডিল ছাড়া তুষ্ট করা যায়নি তাকে।

মন্ত্রীর সাবেক এপিএস রাশেদুল কাওসার ভূঁইয়া জীবন কসবা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হয়ে এলাকায় চলে আসার পর বাবু হয়ে উঠেন সবকিছুর হর্তাকর্তা। ২০১৮ সালে পিএ নিয়োগ হওয়ার পর বাবুর অন্যরূপ বেরিয়ে আসতে শুরু করে।

খারাপ আর কর্কশ আচরণের কারণে তার কাছে মান-সম্মান হারানোর ভয়ে মন্ত্রীর গুলশানের অফিসে যাওয়া ছেড়ে দেন সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকে। সেখানে এলাকার লোকজনের সঙ্গেও তার দুর্ব্যবহার ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। মন্ত্রীর পিএসসহ অন্য স্টাফরা বাবুর কাছে হয়ে পড়েন অসহায়। তাদের কথায় কোনো কাজ হতো না। পিএ হওয়ার পরই যেন আলাদীনের চেরাগ হাতে পান বাবু।

থানার দারোগা-ওসি, সাবরেজিস্ট্রার, জেলা রেজিস্ট্রার বদলি বাণিজ্য, সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেওয়ার দোকান খুলে বসেন। দুহাতে কামাই করতে শুরু করেন কোটি কোটি টাকা। সাবরেজিস্ট্রার বদলির ক্ষেত্রে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়। জেনে যাওয়ার ভয়ে এসব পদে কর্মরত এলাকার লোকদের দূরে সরিয়ে রাখেন। বরং তাদের সঙ্গে চাকরের মতো আচরণ করতে শুরু করেন।

সূত্র জানায়, সাবরেজিস্ট্রার বদলির শতকরা ৯০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে আলাউদ্দিন বাবু আর সফিকুল ইসলাম সোহাগের মাধ্যমে। স্থান ভেদে ৪০ লাখ থেকে শুরু করে ৫০-৬০ লাখ, এমনকি দেড় থেকে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় সাবরেজিস্ট্রার বদলির ক্ষেত্রে। যে বেশি টাকা দিতো তাকেই ভালো জায়গায় পোস্টিং দেওয়া হতো। টাকা কম দিলে বেশি টাকা দেওয়ার লোক আছে বলে টাকার অঙ্ক বাড়ানো হতো।

তেজগাঁও রেজিস্ট্রি কমপ্লেক্সে খিলগাঁও, উত্তরা, বাড্ডা, পল্লবী, গুলশান, শ্যামপুর, মিরপুর, সাভার, রূপগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ এসব স্থানে বদলির জন্য একেকজন সাবরেজিস্ট্রারকে ২ কোটি টাকার উপরে দিতে হয়েছে। সাবরেজিস্ট্রার ছাড়াও বিচারাঙ্গনের লোকজনও ভালো পোস্টিংয়ের জন্য ধরনা দিয়েছেন বাবু আর সোহাগের কাছে। পিএ হলেও এপিএসের চেয়ারেই বসতেন আলাউদ্দিন বাবু। তার জন্য গুলশান অফিসে এসি রুম এবং একটি জিপ বরাদ্দ ছিল।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কসবা উপজেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়নের সীমান্তঘেঁষা কাজিয়াতলা গ্রামের ইদ্রিস মিয়ার ছেলে আলাউদ্দিন বাবু। যদিও তাদের আদি বাড়ি সীমান্তের ওপারে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মতিনগর থানার ধনছড়ি গ্রামে। তার বাবা ইদ্রিসের নানার বাড়ি কসবার পানিয়ারূপে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের গ্রামে। তার নানা-মামা ইদ্রিসকে অ্যাডভোকেট সিরাজুল হকের (আইনমন্ত্রীর প্রয়াত পিতা) বাড়িতে কাজের ছেলে হিসেবে নিযুক্ত করে দেন। বাড়ির গৃহস্থালি কাজকর্ম করার পাশাপাশি আইনমন্ত্রীর বৃদ্ধা দাদির সেবা করতেন ইদ্রিস। পরে আইনমন্ত্রীর প্রয়াত মা জাহানারা হকের সেবায় নিয়োজিত হন। তিনি তাকে স্বামীর গ্রামের বাড়ির কেয়ারটেকার হিসেবে স্থায়ী করে দেন।

ঢাকার গুলশান থানার শাহজাদপুর (বাঁশতলা) এলাকার খ-৪০/১ এ বাবুর ২টি বিশাল ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়া কসবা পৌর এলাকার আড়াইবাড়ির কদমতলী এলাকায় রাস্তার পূর্বপাশে আজিজুর রহমান টুটুল এর কাছ থেকে ৬ কাঠার একটি বাণিজ্যিক জায়গা কিনেন। যার বর্তমান বাজার মূল্য ৫ কোটি টাকার উপরে। ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি গোপীনাথপুরের জগন্নাথপুর মৌজায় ৫৭৪ নং দাগে ও ১০৮৮ নং দলিলে বাবু তার শ্বশুর দলিল লেখক ফরিদ মিয়া নামে ১৬ কানি সমতল পাহাড় কিনেন। ওই জমিতে রয়েছে মাল্টা বাগান। সেখানে যাওয়ার জন্য করা হয়েছে পাকা রাস্তা। যার বর্তমান বাজার মূল্য আড়াই কোটি টাকারও বেশি।

কসবার আড়াইবাড়ী মাঠের পাশেই রয়েছে ১৮ শতক জায়গা। কসবা পৌরশহরের ইমামপাড়ায় রয়েছে ভগিনীপতি আমজাদ হোসেন মাস্টারের নামে বাবু কেনা ৫ তলা একটি বাড়ি। এ ছাড়াও নামে বেনামে কোটি কোটি টাকার আরও অনেক জমি রয়েছে এলাকায়।

এদিকে পানিয়ারূপ গ্রামের কৃষক মৃত হাছু মিয়ার ছেলে শফিকুল ইসলাম সোহাগ। তিন ভাইয়ের মাঝে সবার ছোট সোহাগ। এক সময় কসবার কায়েমপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের গ্রামের বাড়ির কয়েকশ গজ সামনেই সোহাগের বাড়ি। সোহাগের বড় ভাই মতিন কাজ করতেন আইনমন্ত্রীর আপন মামা সাংবাদিক আতাউস সামাদের বাসায়। সোহাগও প্রায় ২০ বছর ধরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ছোট ভাই আরিফুল হক রনির বাসার কাজের লোক ছিলেন। আরিফুল হক রনি মারা যাওয়ার পর সোহাগ চলে আসেন মন্ত্রীর বাড়িতে।

মন্ত্রীর ঢাকার বনানী বাসার কাজকর্ম ও মন্ত্রীর মাকে দেখাশোনা করতেন সোহাগ। কাজের লোক থেকে হয়ে যান মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী। ব্যক্তিগত সহকারী হয়ে আর পিছু তাকাতে হয়নি সোহাগকে। চাকরি, থানার ওসি ও সাবরেজিস্ট্রার বদলি, বিচারাঙ্গণে ভালো পোস্টিং, এলাকায় মাদকের সিন্ডিকেট পরিচালনা করে কামিয়েছেন শত শত কোটি টাকা।

ঢাকার গুলশান থানার শাহজাদপুর (বাঁশতলা) এলাকার খ-৪০/১ এ সোহাগের ৪টি বিশাল ফ্ল্যাট রয়েছে। কসবা পৌরশহরে কিনেছেন দুইটি ফ্ল্যাট। গ্রামের বাড়ি পানিয়ারূপে করেছেন কয়েক কোটি টাকা খরচ করে ডুপ্লেক্স বাড়ি। তবে সোহাগ তার বেশিরভাগ সম্পত্তি ক্রয় করেছেন তার বড় ভাই মতিনের নামে।

মতিন তার স্ত্রী এবং শাশুড়ির নামে কসবা পৌর শহরের ইমামপাড়ায় কিনেছেন ১৫ শতক জায়গা। মতিন কসবার লক্ষ্মীপুর, পানিয়ারূপ, বিলগর, মাইকার ও মুরাদনগরের ডালপাড়ে কয়েকশ কানি জমি কিনেছেন। এছাড়াও ঢাকার আফতাবনগর ও বনশ্রীতে সোহাগ ও মতিনের নামে শত শত কোটি টাকার জায়গা-সম্পদ রয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানায়।

সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের চাচাতো ভাই শফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, বাবু এবং সোহাগের অপকর্মের কথা বলে শেষ করা যাবে না। চাকরি, বদলি বাণিজ্য, এলাকায় মাদকের সিন্ডিকেট পরিচালনা, পাহাড় কাটা, মামলা দিয়ে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা, কি হতো না তাদের ইশারায়। তাদের অপকর্মের কারণে আজকে আনিসুল হকের এ অবস্থা। তাদের অত্যাচারের ক্ষোভে মন্ত্রীর বাড়িটাও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছেন এলাকাবাসী। গত ১০ বছর বাবু-সোহাগের ভয়ে এলাকায় কথা বলতে পারেনি কেউ।

৫ আগস্টের পর আত্মগোপনে রয়েছে বাবু-সোহাগ। অনেকে বলছেন বিদেশ পাড়ি জমিয়েছেন তারা। তাদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনও বন্ধ রয়েছে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *