নিজস্ব প্রতিবেদক : মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের সবচেয়ে বড় প্রকল্প প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি)। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে (২০২০) নেয়া এই প্রকল্পটি বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রাণিসম্পদ খাতে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি, পশু-পাখির উৎপাদনশীলতা ও সর্বোপরি খামারিদের ভাগ্যোন্নয়ন।

প্রাণিসম্পদ খাত কিংবা খামারীদের তেমন উন্নয়ন না হলেও ভাগ্যবদল হয়েছে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তা ও বিগত সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী মহলের। লুটপাটের এই প্রকল্পের শুরু থেকেই মূল ভূমিকায় ছিলেন প্রকল্পের চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর (সিটিসি) ড. মো: গোলাম রব্বানী।
গত বুধবার তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। প্রকল্পের বর্তমান পিডি ডা. মো: জসিম উদ্দিনকেও সরিয়ে দেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
ফ্যাসিবাদ পতনের পর প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পান সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ডা. মো: জসিম উদ্দিন। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানো ঠিক আগের দিনও রাজধানীর খামারবাড়ির প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের সামনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে শ্লোগান তুলেছিলেন এই কর্মকর্তা। সেদিন বঙ্গবন্ধু ভেটেরিনারি পরিষদের ব্যানারে শেখ হাসিনার পক্ষে আয়োজিত কথিত শান্তি সমাবেশে ছাত্র-জনতাকে ‘সন্ত্রাসী, জামায়াত-শিবির রাজাকার’ বলে শ্লোগানের নেতৃত্ব দেয়াদের অন্যতম ছিলেন এই কর্মকর্তা। অথচ ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার পতনের পর দলবাজ এই কর্মকর্তার কাঁধে ওঠে প্রাণিসম্পদ খাতের সবচেয়ে বড় প্রকল্প ‘এলডিডিপি’। ওই দিন খামারবাড়ি চত্বরে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের আরো বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে সরব দেখা যায়।

প্রাণিসম্পদ খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, করোনাকালে এই প্রকল্পটি শুরু হয়। শ.ম রেজাউল করীম ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী। ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের ভর্তুকি হিসেবে দেয়া হয় প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা। যার বেশিরভাগই লুটপাট হয়েছে বলে তখন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। প্রকৃত খামারিরা এই প্রকল্পের তেমন কোনো সুফলই পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ। এছাড়া, অনেক প্রতারক খামারি সেজে প্রকল্পের সুবিধা নিচ্ছেন। তাদের সহযোগিতা করেছেন বা করছেন প্রকল্পেরই কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা। বিনিময়ে তারা আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন।

জানা যায়, এলডিডিপি প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে ম্যাচিং গ্র্যান্ট (অনুদান) বাবদ। তবে শর্ত রয়েছে, অফেরতযোগ্য এই অর্থ প্রতিষ্ঠান আধুনিকায়নে ব্যয় করবেন খামারিরা। ছোট খামারিরা ম্যাচিং গ্র্যান্টের টাকা ও নিজস্ব অর্থায়নে মিষ্টি তৈরির মেশিন, দই ইনকিউবেটর, মিক্সচার মেশিন, দুধ ঠাণ্ডাকরণ যন্ত্র, প্যাকিং মেশিন, লাবাং মেশিন, পাস্তুরাইজার মেশিন, এসএস চুলা কেনার শর্তে অনুদান পাবেন।
প্রকল্প থেকে অনুদান পাওয়া তালিকা ধরে অনুসন্ধানে জানা যায়, অনুদান পাওয়া এসব ব্যক্তির খামার বা দুগ্ধজাত প্রতিষ্ঠান কোনোটিই নেই। প্রতারণার মাধ্যমে অনেকেই অনুদানের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। প্রকৃত খামারিদের ভাগ্যোন্নয়ন না হলেও অসাধু কর্মকর্তা ও তাদের কমিশন দিয়ে সুবিধা নেয়া কিছু মানুষের ঠিকই পকেট ভারী হচ্ছে। এলডিডিপি প্রকল্পের শুরু থেকেই চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ছিলেন ড. মো: গোলাম রব্বানী। ১৯তম বিসিএস (পশুসম্পদ) ক্যাডার কর্মকর্তা তিনি।
গত বুধবার তাকে প্রকল্প থেকে সরিয়ে ঢাকা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, লিভ, ডেপুটেশন অ্যান্ড ট্রেনিং রিজার্ভ হিসেবে সংযুক্ত করা হয়েছে। একই দিন তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সচিব আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ড. মো: গোলাম রব্বানীকে চাকরি হতে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। বরখাস্তকালে তিনি বিধি অনুযায়ী খোরপোষ ভাতা প্রাপ্য হবেন। জনস্বার্থে জারিকৃত এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে বলে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়।
জানা গেছে , মূলত গত ১৪ সেপ্টেম্বর রংপুরের আরডিআরএস বেগম রোকেয়ার মিলনায়তনে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) বিভাগীয় অগ্রগতি পর্যালোচনা কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। কর্মশালায় প্রেজেন্টেশন দিচ্ছিলেন ড. মো: গোলাম রব্বানী। শুরুতেই স্লাইডে শেখ মুজিবুর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি ভেসে ওঠে।
অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মুহাম্মদ জাবেরসহ মন্ত্রণালয় ও রংপুর বিভাগের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। মূলত এই ঘটনার প্রেক্ষিতেই ড. মো: গোলাম রব্বানীকে বরখাস্ত করা হয়।
এদিকে, শেখ হাসিনার পতন পরবর্তী বাংলাদেশে ডা. মো. জসিম উদ্দিনকে এলডিডিপির মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের পিডি করা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে তাকে পিডি নিযুক্ত করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এর আগে তিনি প্রেষণে কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম সম্প্রসারণ এবং ভ্রূণ স্থানান্তর প্রযুক্তি বাস্তবায়ন প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রকল্পটি গত বছরের জুনে শেষ হয়েছে।
প্রকল্পের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ড. মো: গোলাম রব্বানীর পরে পিডি জসিম উদ্দিনকেও সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
তার পরিবর্তে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পেয়েছেন প্রাণী সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মহাখালীর (গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়ন) ড. মো: মোস্তফা কামাল।