বিশেষ প্রতিবেদক : ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরে দুর্নীতি,অনিয়ম,বদলী ও নিযোগ বাণিজ্য নিয়ে একাধিক পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হওয়ায় প্রেক্ষিতে নড়ে চড়ে বসেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকের বিশেষ অভিযান পরিচালিত হয়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরে নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলি বাণিজ্য এবং কেনাকাটায় অনিয়মসহ নানাবিধ দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রাজধানীর সেগুনবাগিচাস্থ দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে এনফোর্সমেন্ট টিমের সদস্যরা প্রাপ্ত ওইসব অভিযোগে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরে অভিযান চালায়।

দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা ও উপ পরিচালক মো. আকতারুল ইসলাম গণমাধ্যমকে এই তথ্য নিশ্চিত করেন।

তিনি আরো জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) অভিযানকালে দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিমের সদস্যরা ওই অধিদপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেন এবং প্রাপ্ত অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা মিলছে। দুদক টিম উক্ত অফিস থেকে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করেছেন। এখন সংগৃহীত রেকর্ডপত্র সার্বিক পর্যালোচনাপূর্বক এনফোর্সমেন্ট টিমের পক্ষ থেকে কমিশনের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে মতামতসহ পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করবে।

অনুসন্ধানে জানাগেছে, আওয়ামী লীগের পতন হলেও ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদে আওয়ামী লীগের দোসররা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। তারা টিম ভারি করার জন্য আবারো দুর্নীতিবাজ উপপরিচালক ওহিদুল ইসলামকে ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরে বদলী করিয়েছেন। ওহিদুল একজন কট্রোর আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তা। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিটি দলীয় কর্মসূচিতে অংশ গ্রহণ করতেন। ওহিদুুলের ভাই নাসির আওয়ামী লীগের উপজেলার সাংগঠনিক সম্পাদক।
যিনি ছাত্র জনতার আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্য আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ,শ্রমিক লীগকে সহযোগিতা করেছেন । তার গ্রাম: নারসি পোস্ট : হার্ট ফুলবাড়ী থানা: সারিয়াকান্দি, জেলা : বগুড়া। এলাকার এক বিএনপি নেতা নাম না প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ওহিদুলের পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। তিনি নিজেও দলীয় অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করেন। তিনি বতর্মানেও আওয়ামী লীগকে পূর্ণবাসনের কাজ করছেন। সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল খান ও প্রতিমন্ত্রী সামশুল হক টুকুর সাথে ছিল তার ঘনিষ্ট সম্পর্ক। জুলাই-আগষ্টের ছাত্র জনতার আন্দোলন ব্যর্থ করতে অর্থ বিনিয়োগও করেছিলেন।
গত ১৭ই এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ মো.ওহিদুল ইসলামকে ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) পদে বদলীর আদেশ জারি করেছে।অথচ: মাত্র সাড়ে ৫ মাস আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী পন্থী হিসাবে চিহ্নিত করে ওহিদুল ইসলামকে অধিপ্তরের উপ পরিচালক পদ থেকে সরিয়ে ফায়ার সার্ভিসের মিরপুর ট্রেনিং কমপ্লেক্সে অধ্যক্ষ হিসাবে বদলী করে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের বদলী ও পদায়ন নীতিমালা-২০২৩ অনুযায়ী ওহিদুল ইসলামের অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক পদে ৩ বছরের আগে পদায়নের কোন সুযোগ নেই। কারণ নীতিমালার ৫ দশমিক ১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, একই কর্মস্থলে কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরীকাল একাধারে ৩ বছররের অধিক হলে বদলীযোগ্য হবেন। এর আগে বদলীর আবেদনেরই কোন সুযোগ নেই। ওহিদুল ইসামের পদায়নের ক্ষেত্রে নীতিমালার এ শর্তটি মানা হয়নি।
এদিকে বদলী ও পদায়ন নীতিমালার ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নবম ও তার উর্ধ্বে কর্মকর্তাদের বদলী ও পদায়নের ক্ষেত্রে অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত প্রস্তাাবের প্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগ নিষ্পণ্ন করবেন। এক্ষেত্রে ওহিদুল ইসলামের বদলী ও পদায়নে অধিদপ্তর থেকে কোন সুপারিশ না করা হলেও ভুতুড়ে বদলীর আদেশ জারি করেন সংশ্লিষ্টরা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের এমন বিধি বহির্ভূত বদলীর আদেশ ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরে অসন্তোষ তৈরি করেছে। এই বদলীর কাজটি করেছেন ফায়ার সার্ভিস অফিসের দুর্নীতিবাজ কয়েকজন কর্মকর্তা,বগুড়ার কাহালু ফায়ার ষ্টেশনের ফায়ারম্যান শাহীন, প্রভাবশালী ঠিকাদার সজল সহ আরো অনেকে। আসন্ন নিয়োগে,নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই সচিবকে ভুল বুঝিয়ে এই সিন্ডিকেট মো: ওহিদুল ইসলামকে অধিদপ্তরে বদলী করে এনেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিপ্তরের মহাপরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল-এনডিসি এ প্রতিবেদককে বলেন, মো: ওহিদুল ইসলামের বদলীর আদেশটি মন্ত্রণালয় জারি করেছে। আমি এর বেশিকিছু বলতে পারবো না। এ বিষয়ে আপনার কোন কিছু জানার থাকলে আপনি মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেন।এদিকে ওহিদুল ইসলামকে পুনরায় ফায়ার সার্ভিসের পদে পদায়ন করার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের উপ সচিব সফিকুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না। ওহিদুল ইসলামের পদায়নের বিষয়টি সিনিয়ররা বলতে পারবেন। উল্লেখ্য ওহিদুল ইসলামকে পদায়নের প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেন উপ সচিব সফিকুল ইসলাম।
সুত্রমতে,শুধু বদলী আর পদায়নই নয়। ওহিদুল ইসলাম ফায়ার সার্ভিসের খুবই আলোচিত নাম। আওয়ামীলীগ সরকারের সময়ে ছিলেন খুবই প্রভাবশালী। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের এপিএস মনিরের সাথে ছিল দহরম মহরম সম্পর্ক। তাই পদে উপ-পরিচালক হলেও ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তর চলতো তার ইচ্ছে মতোই। নিয়োগ,কেনা-কাটা, টেন্ডার সব কিছুই ওহিদুল ইসলাম নিয়ন্ত্রণ করতেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফায়ার সার্ভিসের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ড. ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্র্তীকালীন সরকারের বয়স ৮ মাস অতিক্রম করলেও ফ্যাসিষ্টমুক্ত করা যায়নি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরকে।
আরো জানা যায়, ৫ই আগষ্টের পর ওহিদুলকে অধিদপ্তর থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সরিয়ে দেওয়ার সাড়ে ৫ মাসের মাথায় আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তাদের শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কারণে ওহিদুলকে পুণরায় উপ পরিচালক পদে বহাল করা হয়েছে। ওহিদুল ইসলাম বিধি বহির্ভুতভাবে ২০২২ সালে ১৩ই মে ফায়ার সার্ভিস শারীরিক যোগ্যতা যাচাই পরীক্ষা স্থগিত করেন।
এ বিষয়ে তখন সমালোচনা সৃষ্টি হলে তাকে উপ পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) পদ থেকে স্ট্যান্ড রিলিজ করে উপ পরিচালক হিসেবে রাজশাহীতে বদলী করা হয়। যদিও কিছুদিন পরই তাকে আবার অধিদপ্তরের উপ পরিচালক পদে পদায়ন করে ফিরিয়ে আনা হয়।তিনি বলেন, ওহিদুলের এ সিন্ডিকেট আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে ১৫/১৬ বছর ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। তারা নিয়োগ,বদলী,কেনা-কাটা, পদন্নোতি, পদায়নসহ সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতো। এসব করে সিন্ডিকেটটি শতশত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে গেলেও এ সিন্ডিকেট এখনো শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে।
উল্লেখ্য যে অধিদপ্তরের এক প্রভাবশালী ঠিকাদারের সাথে ওহিদুলের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। তিনি নিজেকে ফায়ার সার্ভিসের ছায়া ডিজি হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। কখনো আওয়ামী লীগ আবার কখনো বিএনপি যে যখন ক্ষমতায় থাকে তখন সেই দলেরই লোক বলে নিজেকে পরিচয় দিয়ে থাকেন।
ফায়ার সার্ভিসের একাধিক কর্মকর্তা এই সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত থাকায় তাদেরকে নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের সেফটি প্ল্য্যান, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ এবং কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের বদলি তদবির করেন। যার কারনে অন্যান্য ঠিকাদাররা ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছেন। অতীতে এক ঠিকাদার ও মো. ওহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিলেন।
এর আগেও মো. ওহিদুল সহকারী পরিচালক, ওয়ার হাউস ও ফায়ার প্রিভেনশন এর দায়িত্বে থাকাকালীন সময় কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি ও অনিয়মের জন্য পত্রিকার শিরোনাম হয়েছেন । মো. ওহিদুল ইসলাম এডি ওয়্যার হাউজ এবং ডিডি এডমিন থাকা কালিন সময়ে তার স্ত্রীর-সন্তান ও অন্যান্য আত্মীয়দের নামে বগুড়া, ঢাকা, রাজশাহী, দিনাজপুর, জয়দেবপুরসহ বিভিন্ন স্হানে ৫ একর জমি ক্রয় করেছেন।
এছাড়া স্ত্রীর নামে ও মেয়ের নামে ২টি প্লট ২টি গাড়ী রয়েছে তার। উত্তরাতে এক ঠিকাদারের সাথে পার্টনারশীপে ব্যবসা করে আসছেন। এছাড়াও, উত্তরাতে তার রয়েছে ২০ কাঠা জমি। ঠিকাদারের সাথে গড়ে তুলেছেন ডেইরি ফার্ম যার আনুমানিক মূল্য হবে ৫ কোটি টাকা।
মো. ওহিদুল ইসলামের এহেন কর্মকান্ডে বিব্রত খোদ ফায়ার সার্ভিসের উর্ধতন কর্মকর্তারা।বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি বদলি ও নিয়োগ বাণিজ্যের সাথে জড়িত থাকা এবং ডিপার্মেন্টের ভেতরে বেপরোয়া কর্মকান্ডে বিরক্ত ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ। যার ফলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্ট্যান্ড রিলিজ করে উপ-পরিচালক, রাজশাহী হিসাবে বদলি করা হয়েছিল ওহিদুলকে।
সেখানে গিয়ে তিনি আগের চেয়ে আরও বেশি বেপরোয়া ও দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়েন। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বারবার তাকে সতর্ক করার পরেও তিনি তার কাজ অব্যাহত রাখতে থাকেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা ও সেবা বিভাগ পুনরায় তাকে উপ-পরিচালক (উন্নয়ন) হিসাবে অধিদপ্তরে বদলি করে।
তবে ওহিদুল সেখানে যোগদান না করে উপর মহলে তদবীরের মাধ্যমে উপ-পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) অথবা উপ-পরিচালক ঢাকা হওয়ার জন্য চেষ্টা করেন। পরে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, ট্রেনিং কমপ্লেক্স, মিরপুর, ঢাকা, অধ্যক্ষ হিসাবে যোগদান করে ছিলেন।
এদিকে ওহিদুল ইসলামকে পুনরায় অধিদপ্তরের উপ পরিচালক পদে পদায়ন করায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরে কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের মধ্যে তীব্র অসস্তোষ দেখা দিয়েছে। কেন-না, মো. ওহিদুল ইসলাম এর আগে যখন এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তখন তিনি প্রশাসনিক খড়গ চালিয়ে ফায়ার কর্মীদের অতিষ্ঠ করে তুলেছিলেন।
ফায়ার সার্ভিস এ কর্মরত দেশ প্রেমিক কর্মকর্তা ও কর্মচারিরা অনতিবিলম্বে মো: ওহিদুল ইসলামের বদলী আদেশ বাতিল করার জন্য স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র সচিব, সুরক্ষা ও সেবা বিভাগের সচিব ও ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালকের দ্রুত পদক্ষেপ কামনা করেছেন।