গণকবরে ও গণদাহে কভিড-১৯’র মৃত্যুযজ্ঞ

আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য

ডেস্ক রিপোর্ট : বিশ্বব্যাপী চলছে কভিড-১৯-এর মৃত্যুযজ্ঞ। পৃথিবীবাসীর জন্য আকস্মিক বিধ্বংস আর বিপর্যয়ের বার্তা নিয়ে আগত নভেল করোনাভাইরাস তছনছ করে দিয়েছে এতদিনে স্বাভাবিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সবকিছু। শুধু মানবতাবিরোধী অপরাধ নয়, মহামারীর প্রকোপের কারণেও যে গণকবর খুঁড়তে হয়, সে কথাটি এতদিন প্রায় বিস্মরণেই ছিল বিশ্ববাসীর। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রায় ভুলে যাওয়া সে বিষয়টিকেও আবার সামনে তুলে এসেছে। বিশ্বের অনেক স্থানেই মরদেহের স্বাভাবিক সৎকারও এখন প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পর্যুদস্ত দেশগুলোকে এখন নিজ নাগরিকদের জন্য গণকবর খুঁড়তে বাধ্য করছে কভিড-১৯-এর আক্রমণ।
কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক টেলিভিশন চ্যানেলের খবরের ফুটেজ ভাইরাল হয়ে পড়ে। তাতে মাস্ক পরিহিতা এক নারী সাংবাদিককে বলতে শোনা যায়, শহরের অস্থায়ী মর্গগুলোয় মরদেহের সংখ্যা এখন ধারণক্ষমতার চেয়েও বেশি। মৃতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় গণদাহ ও গণকবরের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে নগর কর্তৃপক্ষকে। তার এ বক্তব্যের সমর্থনে দেখা যায়, বিশাল গর্ত খুঁড়ে তাতে ট্রাকভর্তি প্লাস্টিকে মোড়ানো মরদেহ এনে ফেলা হচ্ছে।
টুইটার ও ফেসবুকে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে ভিডিওটি। ইতালিতে কভিড-১৯-এ মৃত ব্যক্তিদের জন্য এসব গণকবর খোঁড়া হয়েছে বলা প্রচার করা হয়। পরবর্তীকালে ভিডিওটির সত্যতা নিয়ে অনুসন্ধান চালান আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা। শেষ পর্যন্ত জানা যায়, এটি আসলে ২০০৭ সালে প্রচারিত একটি টেলিভিশন মিনি সিরিজ ‘প্যানডেমিকের’ দৃশ্য।
ভিডিওটি ভুয়া প্রমাণিত হলেও এর বিষয়বস্তুতে তৈরি হয় নতুন এক বড় ধরনের শঙ্কা। বিষয়টি হলো, মহামারীতে মৃত্যুর হার বেড়ে গেলে বিপুলসংখ্যক মরদেহের কী হবে?
এর সম্ভাব্য সমাধানও সেই ভুয়া ভিডিওটিতেই দেয়া ছিলগণদাহ ও গণকবর। কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবে পর্যুদস্ত কয়েকটি দেশকে এখন এ ধরনের পন্থা অবলম্বন করতে দেখা যাচ্ছে।
বর্তমানে নভেল করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ইতালিতে। গতকাল পর্যন্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৩৬২-তে। সম্প্রতি লোম্বার্ডিও বার্জামো শহরের একটি ক্রিমেটোরিয়াম (শব পোড়ানোর স্থান) থেকে ইতালীয় সেনাবাহিনীর বেশকিছু কফিনবাহী ট্রাক বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। ক্রিমেটোরিয়ামটিতে এরই মধ্যে অনেক মরদেহ দাহ করা হয়ে গিয়েছে। শব পোড়ানোর আর অবকাশ না থাকায় ট্রাকে করে প্রচুর মরদেহ সেখান থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়।
দিনরাত ২৪ ঘণ্টা চালু রাখার পরও মরদেহের সংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিতে হিমশিম খেয়ে যায় ইতালীয় ক্রিমেটোরিয়ামগুলো। একই অবস্থা দেখা গেছে কবরস্থানগুলোতেও।
সম্প্রতি সেখানকার একটি চার্চে বেশকিছু মরদেহ লাইন দিয়ে সংরক্ষণ করতে দেখা যায়। স্থানীয় একটি উপাসনালয়ের সেক্রেটারি জিলিও দেলাভিতে বলেন, ২৪ ঘণ্টা চালু রেখেও ক্রিমেটোরিয়ামে সবার মরদেহ দাহ করা সম্ভব হচ্ছে না।
আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে বর্তমানে কভিড-১৯-এর সবচেয়ে বড় সংক্রমণস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে বর্তমানে নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৪৫৪-এ। দেশটিতে এ মুহূর্তে সংক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে নিউইয়র্ক।
মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকায় নিউইয়র্ক সিটি কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি সেখানকার রিকার্স আইল্যান্ড জেলের কয়েদিদের জন্য নতুন একটি প্রস্তাব দিয়েছে। প্রস্তাবটি হলো, এ কয়েদিদের দিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে হার্ট আইল্যান্ডে গণকবর খোঁড়ানো হবে। এজন্য তাদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ (পিপিই) দেয়া হবে। একই সঙ্গে তাদের মজুরি দেয়া হবে ঘণ্টায় ৬ ডলার করে। দেশটির জেলখানায় কয়েদিদের যে হারে মজুরি দেয়া হয়, তার তুলনায় এ মজুরি হার অনেক বেশি।
নিউইয়র্কের মেয়র বিল ডি ব্লাসিওর দপ্তরের মুখপাত্র আভেরি কোহেন বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে তার দাবি এসব গণকবর যে শুধু কভিড-১৯-এ মৃতদের জন্যই করা হচ্ছে, তাও নয়।
এ অফার দেয়া হয়েছে শুধু যেসব কয়েদির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে, শুধু তাদের জন্য। যাদের অভিযোগ প্রমাণের আগেই জেলে দেয়া হয়েছে, তাদের জন্য এ প্রস্তাব দেয়া হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, হার্ট আইল্যান্ডের একটি সরকারি কবরস্থানেই শেষ ঠাঁই হচ্ছে সেখানকার করোনায় মৃত ব্যক্তিদের।
এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মৃতের সংখ্যায় সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে ইরান। দেশটিতে গতকালও সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৬৫১ জন। এর আগে ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে এ রোগে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয়েছে ১৫১ জনের।
ইরানে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা কোম শহর। সেখানকার বড় একটি কবরস্থান সম্প্রসারণের একটি স্যাটেলাইট ছবি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়। ওই ছবিতে দেখা যায়, কোম শহরের বেহেশত-ই মাসুমেহ নামে কবরস্থানে বড় দুটি গণকবর খুঁড়ে রাখা হয়েছে।
দক্ষিণ আমেরিকায় বর্তমানে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একুয়েডর। দেশটিতে এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে সংক্রমণের কথা স্বীকার করা হয়েছে ৩ হাজার ৪৬৫ জনের। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ১৭২। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা অনেক বেশি।
দেশটিতে কভিড-১৯ সংক্রমণের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র হলো গুয়াইয়াকুইল শহর। শহরটিতে রীতিমতো মড়ক লেগেছে। যদিও মৃতদের অনেকেরই দেহের রোগ থেকে যাচ্ছে অশনাক্ত অবস্থায়। অনেক মরদেহ এখন সড়কের ওপর বেওয়ারিশ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতাল-ক্লিনিকেও পড়ে রয়েছে এমন অনেক বেওয়ারিশ মরদেহ। এসব মরদেহ সৎকারের জন্য বর্তমানে গুয়াইয়াকুইলের স্থানীয় কর্তৃপক্ষও গণকবর খোঁড়ার উদ্যোগ নিয়েছে।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *