খোকন বিকাশ ত্রিপুরা জ্যাক, (খাগড়াছড়ি) : পাহাড়ি শিশুরা যখন জন্মগত শারীরিক জটিলতা নিয়ে বেড়ে ওঠে, তখন তাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে সীমাবদ্ধতার প্রাচীর—অর্থাভাবে ভালো চিকিৎসা inaccessible, দূরত্বে ঢাকা-চট্টগ্রামের হাসপাতাল কেবল কল্পনায় থাকে। আর ঠিক সেই কল্পনাকে বাস্তবতায় রূপ দিল ‘অর্থো কিডস ক্যাম্প’—এক অনন্য মানবিক উদ্যোগ।

স্বপ্ন যেখানে থেমে যায়, সেখানেই নতুন শুরু : শনিবার (১৯ জুলাই), খাগড়াছড়ির জিরোমাইল এলাকায় পার্কসাইড অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আয়োজিত হলো এই ব্যতিক্রমী ক্যাম্প। আয়োজক ‘খগেন্দ্র-শান্তি ফাউন্ডেশন’, সহযোগিতায় ছিলেন খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন ও স্বনামধন্য চিকিৎসকরা।

শতাধিক পাহাড়ি শিশু পেল ফ্রি চিকিৎসা, অপারেশন ও বিশেষ পরামর্শ। রাজধানীর কৃতি অর্থোপেডিক সার্জনরা এসে দাঁড়ালেন এই শিশুদের পাশে—তাদের দৃষ্টিতে এটা শুধুই চিকিৎসা নয়, বরং মানবতার লড়াই।

রাজধানীর ডাক্তার, এখন পাহাড়ে: হৃদয়ের ডাকেই সাড়া:
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. সারওয়ার ইবনে সালাম-এর নেতৃত্বে ক্যাম্পে অংশ নেন দেশের শীর্ষ অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞরা:প্রফেসর ডা. সায়েদ আহমেদ,ডা. কাইসুর রাব্বি,ডা. রুবায়েত তাসফিন,ডা. এ.কে.এম. শাহজাহান,ডা. গোলাম ফরহাদ,প্রাক্তন সিভিল সার্জন ডা. শহীদ তালুকদার,খাগড়াছড়ির নিজ সন্তান ডা. সুবল জ্যোতি চাকমাসহ আরও অনেকে।

এই পুরো কার্যক্রমের মূল পরিকল্পক ও সংগঠক ডা. নয়ন ময় ত্রিপুরা, যিনি ‘অর্থো কিডস অ্যান্ড ট্রমা সেন্টার’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সদর হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট। তিনি বলেন—”আমরা শিশুর শরীর নয়, জীবন সাজাচ্ছি। এই ক্যাম্প একদিনের নয়, এটি চলমান সংগ্রাম। শিশুদের হাঁটতে শেখানো মানে ভবিষ্যতের সমাজ গড়া।”মায়ের চোখে জল, শিশুর মুখে হাসি।
যারা এসেছিলেন, তারা শুধু রোগী ছিলেন না—ছিলেন প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা মা-বাবা, আশা আর আশঙ্কার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা পরিবার। কেউ কেউ বলছিলেন—“ঢাকা পর্যন্ত যেতে পারব কি না, জানতাম না। আজ এই পাহাড়েই সন্তানের অপারেশন হয়ে গেল—এটা স্বপ্ন না তো কী?”
শিশুদের জন্মগত পা বেঁকে যাওয়া, হাঁটার সমস্যা, হাড়ের বক্রতা কিংবা মেরুদণ্ডের জটিলতার মতো অনেক কঠিন রোগের চিকিৎসা এই একদিনেই পেয়েছে।
স্বেচ্ছাসেবী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের আন্তরিক সহযোগিতা ক্যাম্পটিকে রূপ দিয়েছে এক মানবিক উৎসবে। ‘অর্থো কিডস’—শুধু চিকিৎসা নয়, এক সুস্থ্যতার নাম: এই উদ্যোগ শুধু স্বাস্থ্যসেবা নয়, বরং শিশুদের “চিকিৎসার মাধ্যমে সামাজিক অন্তর্ভুক্তি”-র একটি উদাহরণ।
ডা. নয়ন ময় ত্রিপুরা আরও বলেন— “এই শিশুরা যখন দৌঁড়াতে শিখবে, হাঁটতে শিখবে, তখন তার চোখে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ দেখতে পারব। খাগড়াছড়িকে আমরা শুধু পর্যটন নয়, স্বাস্থ্যসেবার শহর হিসেবেও গড়ে তুলতে চাই।”
খাগড়াছড়ির আকাশে ওই দিনটা একটু অন্যরকম ছিল—মেঘে-ঢাকা পাহাড়ের নিচে ছোট ছোট পায়ে ভর করে শুরু হয়েছিল এক নতুন যাত্রা।
“অর্থো কিডস ক্যাম্প” শুধু একটি দিন নয়, এটি একটি শিশু-কেন্দ্রিক, স্বপ্ন-কেন্দ্রিক দীর্ঘস্থায়ী পথচলা। যেখানে সমাজ, রাষ্ট্র, চিকিৎসক আর সচেতনতার হাত মেলেছে, সেখানে পাহাড়ের শিশুরাও পাবে আকাশে উড়ার অধিকার।