নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর অভিজাত গুলশান-বনানী এলাকা—বিলাসিতা, প্রভাব ও ক্ষমতার প্রদর্শনের প্রতীক। কিন্তু এই ঝলমলে আলোর নিচেই চলছে এক অন্ধকার ব্যবসা—সিসা বার বা হুক্কা লাউঞ্জের নামে মাদক ও অর্থবাণিজ্যের নতুন কেন্দ্র। সম্প্রতি পুলিশের অভিযানে গুলশানের একটি লাউঞ্জ থেকে বিপুল পরিমাণ সিসা, হুক্কা সেটআপ, নগদ অর্থ ও মাদকদ্রব্য জব্দের ঘটনা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।

অভিযানে পাঁচজনকে আটক করা হয় এবং ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। অভিযানের পরই উঠে আসে এক প্রভাবশালী সাবেক মেয়রের পরিবারের নাম, যিনি একসময় নগর উন্নয়নের মুখ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। অভিযোগ—তার পরিবারের এক সদস্য এই সিসা লাউঞ্জের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন।
মধ্যরাতের অভিযান ও চমকপ্রদ নথিপত্র উদ্ধার : গুলশান থানার ওসি জানান, গভীর রাতে চালানো হয় এ অভিযান। জায়গাটি মূলত ক্যাটারিং ব্যবসার জন্য ভাড়া নেওয়া হলেও, পরে অনুমোদন ছাড়াই সেখানে রেস্টুরেন্ট ও সিসা বার চালু করা হয়। উদ্ধার করা হয় প্রায় চার কেজি সিসা, একাধিক হুক্কা-বার সেটআপ, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মাদকদ্রব্য ও নগদ টাকা। লাউঞ্জের প্রকৃত মালিককে ঘটনাস্থলে পাওয়া না গেলেও, পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র জব্দ করেছে পুলিশ।

প্রভাবশালীদের ছায়ায় বিলাসী বার : সিসা লাউঞ্জ সংস্কৃতি নতুন নয়। অভিজাত এলাকার অনেক প্রতিষ্ঠানই রাজনৈতিক ক্ষমতার ছায়ায় ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল। বিশেষ করে আগের সরকার আমলে বেশ কিছু নামিদামি সিসা বার পুলিশ প্রহরায় চলেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি বার পরিচালিত হয়েছে প্রভাবশালী পরিবার ও রাজনৈতিক নেতাদের ঘনিষ্ঠ মহলের হাতে।

সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর পরিস্থিতি উল্টে যায়। অনেক বার বন্ধ হয়ে গেলেও, আবারও নতুন উদ্যোক্তারা তদবিরের জাল বিছিয়ে দিচ্ছে—কখনও প্রভাবশালী নাম ভাঙিয়ে, কখনও নতুন রাজনৈতিক পরিচয়ে।
তদবিরবাজ সিন্ডিকেট ও নতুন ‘মালিকানা যুদ্ধ’ : সূত্রগুলো বলছে, কয়েকটি সিসা বার পুনরায় খুলে দিতে এখন সক্রিয় একদল তদবিরবাজ সিন্ডিকেট। তাদের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন কথিত ব্যবসায়ী, কিছু অসাধু আইনজীবী ও প্রভাবশালী কর্মকর্তা। তারা রাজনৈতিক যোগাযোগের ছবি, সেলফি ও পরিচয় ব্যবহার করে প্রশাসনের ভেতরে চাপ সৃষ্টি করছেন।
একই সঙ্গে রাজধানীর কয়েকটি বন্ধ সিসা বারের মালিকানা নিয়েও চলছে গোপন দর কষাকষি। অনেকেই গা ঢাকা দিয়ে এখন ভিন্ন রাজনৈতিক পরিচয়ে হাজির হয়েছেন—যেন কিছুই হয়নি।
অদৃশ্য জাল ও স্থায়ী সমাধানের প্রশ্ন : বিশ্লেষকদের মতে, রাজধানীতে সিসা লাউঞ্জ সংস্কৃতি কেবল বিলাসিতা নয়, বরং এক নতুন ধরণের অপরাধ অর্থনীতির প্রতিফলন। এর সঙ্গে রাজনীতি, প্রশাসন ও ব্যবসার ত্রিমুখী জোট তৈরি হয়েছে। এই জাল ভাঙা সহজ নয়, কারণ প্রতিটি ধাপে প্রভাব, পৃষ্ঠপোষকতা ও ‘অদৃশ্য নিরাপত্তা’ কাজ করছে।
নারকোটিক্স অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কয়েক দফা অভিযান চালালেও প্রশ্ন থেকে যায়—এই অভিজাত মাদক ব্যবসা আদৌ থামানো সম্ভব হবে কি না।
কারণ শহরের রাত যত অন্ধকার হয়, ততই জেগে ওঠে সেই অদৃশ্য প্রভাবের সাম্রাজ্য—যেখানে ধোঁয়ার আড়ালে লুকিয়ে থাকে অর্থ, প্রভাব আর ক্ষমতার কুয়াশা।