আহমেদ হৃদয়: ২০২০-২১ অর্থবছেরর বাজেট ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে ঘাটতি রয়েছে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা।
বিশ্লেষকদের মতে, প্রস্তাবিত বিশাল এই বাজেট বাস্তবায়ন করতে হলে ঘটতির পরিমাণ আরো কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।
বিশ্লেষকরা আরো বলছেন, দুর্নীতিবাজ এবং লুটেরাদের প্রশ্রয় দিয়ে এবারের বাজেটেও সহজ শর্তে বলতে গেলে একরকম শর্তহীনভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে।
এত বড় একটি বৈশ্বিক মহামারীর পর অর্থনীতিতে তার যে নেতিবাচক প্রভাব সেই প্রেক্ষিতে অন্তত এরকম একটি গতানুগতিক বাজেট কোনোভাবেই প্রত্যাশিত ছিল না।
এ বিষয়ের নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ পথ পরিক্রমা’ শিরোনামে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপন করা হলেও প্রকৃত অর্থে অর্থনৈতিক উত্তরণ এবং ভবিষ্যৎ পথ পরিক্রমার কোন দিকনির্দেশনা নেই প্রস্তাবিত বাজেটে। এটি সম্পূর্ণ বাস্তবতা বিবর্জিত, উচ্চাকাঙ্ক্ষী একটি গতানুগতিক বাজেট। জিডিপি প্রবৃদ্ধি দেখানোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রমাণ করতে ৫ লক্ষ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট দেয়া হয়েছে যার মধ্যে ১ লক্ষ ৯০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি রয়েছে। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা যা সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব। তার মানে এই বাজেট বাস্তবায়ন করতে গেলে ঘাটতি বাজেট আরো বড় হবে। এবারের বাজেটে সুদ ব্যয় বেড়ে হয়েছে ৬৪ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে এই ব্যয় ১ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধরেই নেয়া যায়।
মাহমুদুর রহমান মান্না আরও বলেন, এখানে কেবলমাত্র কিছু বড় বড় সংখ্যা দেখানো হয়েছে। স্বাস্থ্যখাতের যে করুণ দশা এই করোনা মহামারীতে স্পষ্ট হয়েছে তা থেকে উত্তরণের জন্য প্রকৃত অর্থে গঠনমূলক কোন ব্যবস্থা এই বাজেটে নেয়া হয়নি। যে সকল প্রকল্প নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে সেই সকল প্রকল্পকেই সরকারের বিশেষ উদ্যোগ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
তিনি বলেন, সংকট কাটিয়ে অর্থনৈতিক উত্তরণের জন্য ইতোমধ্যে প্রস্তাবিত কিছু প্রণোদনার কথা বলা হয়েছে যা কেবলমাত্র কিছু ব্যাংক লোন। যা ব্যাংকিং খাতকে আরো রুগ্ন করে তুলবে। সরকারের পক্ষ থেকে এই বাজেটে করোনা সংকট কাটিয়ে একটি টেকসই অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলার কোন সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা নেই। শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা এবং খাদ্যের নিরাপত্তার জন্য প্রস্তাবিত বাজেট স্বাস্থ্যখাতের মতোই অসুস্থ। ঘাটতি বাজেট মেটানোর জন্য ব্যাংক থেকে যে অর্থ ঋণ নেয়া হবে তা আর্থিক খাতকে আরো দুর্দশাগ্রস্ত করে তুলবে। বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে, শিল্প খাত সমূহ মুখ থুবরে পড়বে। করোণা মহামারীর পর যে বেকারত্ব বাড়বে সেই বিষয়টি মাথায় রেখে কোন ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ যেখানে করোনা সংকটে অর্থনৈতিক মন্দায় কবলিত সেখানে বিদেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। যা এই মুহূর্তে অসম্ভব। করোনার প্রভাবে কর্ম হারানো প্রবাসীদের দেশে পুনর্বাসন এবং আত্মনির্ভরশীল করে তোলার কোনো দিকনির্দেশনা নেই। পোশাক খাতের অস্থিরতা কাটানোর জন্য কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সংকটের মধ্যেও মেগা প্রকল্পের মেগা লুটের সুযোগ তৈরি করতে এডিপি ৬.২৭ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ’র সাধারণ সম্পাদক কমরেড খালেকুজ্জামান বলেন, এবারের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে আগের চেয়ে আরো নমনীয় শর্তে। কিন্তু এ যাবৎ ১৬ বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার পরও মাত্র ১৪ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে, যার মধ্যে ৯ হাজার কোটি টাকাই ওয়ান এলেভেনের তত্ত্ববধায়ক সরকারের আমলে। ফলে কালো টাকা সাদা করার সুযোগে দুর্নীতি আরো বাড়বে।
এ বিষয়ে সমাজত্রান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, বাজেটের আয়তন বাড়লেও জনগণের প্রত্যাশার দৃষ্টিভঙ্গিতে বাজেট প্রণীত হয় নাই। এই করোনা মানুষজন সহায়তামূলক, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বেকার ও কর্মহীমদের কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবায় গুণগত মানোন্নয়ন, কৃষি সহায়তা, প্রবাসীদের কর্মসৃজনসহ অর্থনৈতিক দুর্দশা মোকাবিলার বাজেট দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু বাজেটে তার প্রতিফলন ঘটেনি।
রাজেকুজ্জামান রতন আরও বলেন, গত অর্থবছরের তুলনায় এবার ৪৫ হাজার কোটি টাকা বেশি বাজেট ঘোষিত হলেও কৃষি, স্বাস্থ্য, জন সুরক্ষা, শিক্ষা, গবেষণা, কর্মসংস্থান এসব খাতে বরাদ্দ বাড়েনি।
তিনি বলেন, কোন দুর্যোগে আক্রান্ত খাতগুলো যতটা আলোচনায় এসেছে বাজেটে ততোটা মনোযোগ পায়নি। বাস্তবতাকে বিবেচনায় না নিয়ে প্রবৃদ্ধি বেশি দেখানোর প্রবণতা বাজেটের বাস্তবায়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। উচ্চ আয়ের ক্ষেত্রে গত বাজেটে ৩০ শতাংশ কর ধার্য করা ছিল, এবার সেটি কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। অথচ মাসে ২৫ হাজার টাকা আয় করলে তাকে করের আওতায় আনা হয়েছে। ভ্যাটের আওতা বাড়ানো হয়েছে তাতে সাধারণ মানুষ কর দিতে বাধ্য হবেন কিন্তু যারা বিপুল সম্পদ ও প্রতিষ্ঠানের মালিক তাদের ক্ষেত্রে কর বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
তিনি আরো বলেন, দেশে ধনী দরিদ্রের ব্যবধান বাড়ছে, করোনা দুর্যোগ সাধারণ মানুষের আয় কমিয়ে বা বাড়িয়ে দিয়েছে, কৃষকের উৎপাদন ব্যয় বাড়লেও ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত হচ্ছে না, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না বরং প্রবাসীদের ফিরে আসার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বাজেটে এই সমস্যাগুলো সমাধানের পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়নি।
বাংলাদেশ সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মনিরুজ্জামান মনির বলেন, চলতি অর্থবছরের তুলনায় এবার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা বেশি। ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বিশাল বাজেটে ঘাটতিও রয়েছে বিশাল। বাজেট বাস্তনায়ন করতে হলে ঘাটতির পরিমান আরো বেশি বাড়বে।
মনিরুজ্জামান মনির বলেন, মহামারী করোনা ভাইরাস সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শ্রমিকরা। মহামারীর এই অবস্থায় শ্রমিকদের আয়ের পথ একেবারেই বন্ধ। যে কারণে সবচাইতে বেশি বিপদে রয়েছে শ্রমিকরা।
