জাল টাকার মাস্টারমাইন্ড মাসুদের ব্যবসা কলকাতায়

অপরাধ আইন ও আদালত

নিজস্ব প্রতিবেদক : ২০০৪ সালে সীমান্তে পাহারারত অবস্থায় মিস ফায়ারিংয়ে পায়ে গুলি লাগে সিপাহী কাজী মাসুদ পারভেজের। উন্নত চিকিৎসার পরও মেডিক্যালে আনফিট হওয়ায় চাকরিচ্যুত হন তৎকালীন বিডিআরের (বর্তমান বিজিবি) এই সদস্য। এরপর অসৎ উদ্দেশ্যে সম্পদ গড়ার ইচ্ছা থেকে নেমে পড়েন জাল টাকা তৈরির ব্যবসায়। ২০০৬ সাল থেকে শুরু করা জাল টাকা তৈরির বড় একটি চক্রের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করেন তিনি। চক্রটি জাল টাকা ছড়ায় কলকাতায়। আর এর মাধ্যমেই গড়ে তোলেন নামে-বেনামে অবৈধ সম্পদের পাহাড়।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র বলছে, ১৯৯৩/১৯৯৪ সালের দিকে তৎকালীন বিডিআর বর্তমান বিজিবিতে সিপাহী পদে যোগ দেন কাজী মাসুদ পারভেজ। সাত-আট বছর চাকরির পর ২০০৪ সালের দিকে হিলি সীমান্তে পাহারারত অবস্থায় মিস ফায়ারিংয়ে পায়ে গুলি লাগে বলে দাবি করেন মাসুদ। চাকরিচ্যুত হওয়ার পর অসৎ পথে টাকা হাতিয়ার গড়ার উদ্দেশ্েয নামেন জাল টাকার ব্যবসায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, কাজী মাসুদ পারভেজের নেতৃত্বে যে চক্রটি কাজ করে, এই চক্র সচরাচর দেশের বাইরে জাল টাকা ছড়িয়ে দেয়। যেহেতু কলকাতা শহরে বাংলাদেশি টাকার লেনদেন ভালো হয়। সেটাকেই জাল টাকার বাজার হিসেবে বেছে নেন তারা। আর সেখানে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন এক লাখ জাল টাকা।
অভিযানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আমরা জাল টাকার অনেক চক্র পেয়েছি। তবে এই চক্রটি জাল টাকার পাশাপাশি অভিনব কায়দায় ডলারও তৈরি করে। কলকাতা শহরে যেহেতু বাংলাদেশি টাকা ও ডলার দুটিই চলে। এতে তাদের ব্যবসার প্রসার হবে ভেবে জাল ডলারও তৈরি করে।
ডিবি পুলিশ বলছে, ডলার তৈরির কৌশলের বিষয়ে তারা জানায় ডলারের সব নোট একই সাইজের হওয়াতে মূল কাগজ ঠিক রেখে শুধু ১০০ ডলার এর জলছাপ অল্প যেকোনও ডলারের ওপর বসিয়ে দেওয়া যায়। ডলার সম্পর্কে যাদের খুব ভালো ধারণা না থাকে তারা এ জাল ডলার সহজে চিনতে পারে না।
গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, এই চক্রের সঙ্গে দেশি-বিদেশি অনেক সদস্য জড়িত। কয়েকজন দেশে থেকে কাজ করে, বাকি কয়েকজন দেশের বাইরে থেকে কাজ করে। যারা বাইরে থাকে তারা ওই দেশেরই নাগরিক। দেশে তৈরি জাল টাকাগুলো সীমান্ত পার করে দেয় দেশি চক্র। সীমান্তের ওপারে থাকা সদস্যরা নগদ টাকা নিয়ে অপেক্ষা করে। সীমান্তের কোনও দুর্বল জায়গায় সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এই অবৈধ জাল টাকা লেনদেন হয়। পরবর্তীতে সেখানকার সদস্যরা তাদের মার্কেটে ছড়িয়ে দেয়। তবে সবাই এই চক্রের হয়ে কাজ করে।
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, জাল টাকা মাধ্যমেই সম্পদ গড়েছেন এই মাস্টারমাইন্ড। প্রতারণা ও জাল টাকার ব্যবসার মাধ্যমে একটি ডেইরি ফার্ম, আইটি ফার্ম, ঢাকা শহরে তিন-চারটি বাড়ি ও ব্যাংকে লাখ লাখ টাকা জমিয়েছেন।
ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, মাসুদ পারভেজ আমাদের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। তার সব তথ্য আমরা বিশ্বাস করছি না। তথ্যগুলো যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন। আমরা তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডের নিয়েছি। রিমান্ডে তাকে এসব বিষয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তার আরও অবৈধ সম্পদের বিষয়ে যদি তথ্য পাই, তাহলে প্রয়োজনে আমরা মানি লন্ডারিংয়ের মামলা করবো।
গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা রাসেল আরও বলেন, আমরা তার কাছে থেকে একটা পাসপোর্ট জব্দ করেছি। গত মার্চেও সে ভারতে গিয়েছিল।
আরও প্রতারণা
পায়ের সমস্যায় চাকরিচ্যুত হয়েছেন দাবি করা মাসুদ জাল টাকার ব্যবসার পাশাপাশি যেকোনোভাবে মানুষ ঠকিয়ে টাকা হাতিয়ে নিতো। তার অংশ হিসেবে কষ্টি পাথরের ব্যবসা, টাকা ডাবল করার প্রতারণা স্কিম। সীমান্তে পিলারে সোনা থাকে বলে পিলার বিক্রির মতো প্রতারণা করেও টাকা হাতিয়ে নিতো।
বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর) রাজধানীর কোতোয়ালি ও আদাবর এলাকায় অভিযান চালিয়ে জাল টাকা তৈরির সরঞ্জামসহ ৫ জন ব্যক্তিকে আটক করে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৫৮ লাখ জাল টাকা ও ১১৩টি জাল ডলার জব্দ করে। চক্রের অন্য সদস্যদের তথ্যের ভিত্তিতে চেকপোস্ট বসিয়ে এফ প্রিমিও প্রাইভেট গাড়ির ভেতর থেকে গ্রেফতার করেন মাস্টারমাইন্ড কাজী মাসুদ পারভেজকে।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, গ্রেফতারকৃতরা অনেক বছর ধরে জাল নোট প্রস্তুত করে খুচরা ও পাইকারিভাবে বিক্রি করতো। তারা বড় কোনও উৎসব যেমন ঈদ, দুর্গা পূজাকে টার্গেট করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সহযোগীদের মাধ্যমে জাল টাকা সরবরাহ এবং বিক্রয় করতো। তারা ডলার তৈরিতেও পারদর্শী ছিল। তাদের তৈরি ডলার আসল না নকল তা সহজে বোঝা যেতো না।


বিজ্ঞাপন