সদরঘাটে উপচেপড়া ভিড়

অর্থনীতি এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন সারাদেশ

ট্রেনে শিডিউল বিপর্যয়, পরিবহন সংকটে হাজারো যাত্রী
মহসীন আহমেদ স্বপন : ঈদে নাড়ির টানে প্রিয়জনের কাছে ফিরতে রাজধানী ছাড়ছেন নগরবাসী। সে কারণে সোমবার ঘরমুখো মানুষের ঢল নেমেছে সদরঘাটে। প্রতিটি লঞ্চ ছাড়ার বেশ আগেই ভরে যাচ্ছে। লঞ্চে জায়গা পেতে অনেকেই দু-তিন ঘণ্টা আগেই ছুটে আসছেন সদরঘাটে। এদিন সদরঘাটের আগে রায় সাহেববাজার থেকেই চোখে পড়ে নৌপথের যাত্রীদের ভিড়। কেউ হাতে ও কাঁধে একাধিক ব্যাগ, কেউবা মাথায় বস্তা, মালামাল নিয়ে স্ত্রী-সন্তানসহ চলছেন লঞ্চের উদ্দেশে।
ঈদ সামনে রেখে নৌপথে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রাজধানী ছেড়ে যাওয়া মানুষের চাপ বেড়েছে। গতকাল সোমবার সরকারি ছুটির দিন না হলেও ঢাকার প্রধান নদীবন্দর সদরঘাটে যাত্রীর ভিড় দেখা গেছে। সকালে লালকুঠির ঘাটে চাঁদপুরগামী যাত্রীদের সবচেয়ে বেশি ভিড় দেখা যায়। বরিশাল, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী রুটেও বেশ ভিড় ছিল। গত চারদিন সকালে যাত্রীদের সামান্য চাপ থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমে যেতো। কিন্তু সকাল থেকে যাত্রীর চাপ ক্রমাগত বাড়ছে। বিআইডব্লিউটিএর পরিবহন পরিদর্শক দিনেশ কুমার সাহা বলেন, গত রোববার সদরঘাট থেকে ১১৩টি লঞ্চ ছেড়ে যায়। গতকাল সোমবার সকাল ১১টা পর্যন্ত ৪১টি লঞ্চ ছেড়ে যায়। এমভি রেডসান লঞ্চের কর্মচারী মো. শরিফ বলেন, যাত্রীর চাপ থাকলেও উপচে পড়া ভিড় নেই। আগে ঈদের সময় পন্টুনগুলোতে লোকে ঠাসা ছিল।বিকাল থেকে উপচে পড়া ভিড় হবে বলে আশা করছি। এমভি আওলাদ লঞ্চের ব্যবস্থাপক মাহফুজুর রহমান বলেন, আগে লঞ্চগুলো ছোট ছিল। এখন বড় বড় লঞ্চ হয়েছে। তাই পন্টুন ঠাসা যাত্রী দেখা যাবে না। সদরঘাট থেকে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে ৪৩টি নৌ-রুট রয়েছে আর যাত্রীবাহী লঞ্চ রয়েছে দুই শতাধিক। কোতয়ালী থানারপরিদর্শক (তদন্ত) মওদুত হাওলাদার জানান, সদরঘাট দিয়ে যাত্রীদের নির্বিঘœ যাতায়াতে সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ২৮২ জন মহানগর পুলিশ সদস্য পালাবদল করে ২৪ ঘণ্টা ডিউটি দিচ্ছে। ৪০টির বেশি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা দিয়ে পুরো এলাকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।১২ জুন পর্যন্ত এই বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। মহানগর পুলিশ ছাড়াও, নৌপুলিশ, র‌্যাব, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস ও বিপুল সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবকও দায়িত্বে রয়েছে।
শিমুলিয়া-কাঠালবাড়ি নৌরুটে লঞ্চ-স্পিডবোটে যাত্রীর চাপ: এদিকে দেশের ব্যস্ততম শিমুলিয়া-কাঠালবাড়ি নৌরুট হয়ে ফেরি, লঞ্চ ও স্পিডবোটে করে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন গন্তব্যে ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের চাপ বেড়েছে। গতকাল সোমবার সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এই নৌরুটে লঞ্চ ও স্পিডবোটগুলোতে যাত্রীর চাপ বেশি। তবে নাব্যতা সংকট না থাকায় দুর্ভোগ ছাড়াই পদ্মা পার হচ্ছে যাত্রীরা। ঢাকা থেকে খুলনাগামী যাত্রী হাবিবুর রহমান বলেন, মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটে স্পিডবোটে দেড়শ থেকে দুইশ টাকা ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। তবে ঘাটে তেমন দুর্ভোগ নেই। বিআইডব্লিউটিসির কাঠালবাড়ি ঘাটের ম্যানেজার আবদুস সালাম জানান, শিমুলিয়া-কাঠালবাড়ি নৌরুটে ১৮টি ফেরি, ৮৭টি লঞ্চ ও ২ শতাধিক স্পিডবোট দিয়ে যাত্রী পারাপার করা হচ্ছে। ঘাটে তেমন দুর্ভোগ নেই। তিনি বলেন, আমরা আবহাওয়া খারাপ থাকলে কিছু ফেরীতে শুধুমাত্র যাত্রী ও মটরসাইকেল পার করছি। অন্য ফেরিতে স্বাভাবিকভাবেই ছোট-বড় যানগুলোকে পার করছি।
ট্রেনে শিডিউল বিপর্যয় : সোমবারও পাঁচ ঘণ্টা দেরিতে ছেড়েছে তিনদিন ধরে ধারাবাহিক শিডিউল বিপর্যয়ে পড়া চিলাহাটিগামী নীলসাগর এক্সপ্রেস। সকাল ৭টা ১০ মিনিটে কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছার কথা থাকলেও বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত স্টেশনে আসেনি। ট্রেনটি ১২টা ৫ মিনিটে কমলাপুরে এসে পৌঁছাবে বলে ধারণা করছে কর্তৃপক্ষ। ঢাকা থেকে নীলসাগর এক্সপ্রেসের সম্ভাব্য ছাড়ার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে বেলা ১২টা ৩০ মিনিটে। এ অবস্থায় বিপর্যয়ে পড়া ট্রেনগুলো ঈদের আগে নির্ধারিত শিডিউলে ফেরানো যাবে না বলে জানিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া লালমনিরহাটগামী ঈদ স্পেশাল লালমনি এক্সপ্রেস সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে কমলাপুর স্টেশন ছাড়ার কথা থাকলেও বেলা ১১টা পর্যন্ত ট্রেনটি কমলাপুরে পৌঁছেনি। এই ট্রেনটি ছাড়ার সম্ভাব্য সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ১১টা ৪৫ মিনিট। এছাড়া রংপুরগামী ট্রেন রংপুর এক্সপ্রেস সকাল ৯টায় ছাড়ার কথা থাকলেও ট্রেনটি দুই ঘণ্টা দেরিতে বেলা ১১টায় কমলাপুর থেকে ছেড়ে গেছে।
রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, রোববার সকাল ১০টার দিকে সিলেটগামী ট্রেন ‘কুশিয়ারা এক্সপ্রেস’ হবিগঞ্জের রশিদপুর এলাকায় লাইনচ্যুত হয়। এ ঘটনায় শায়েস্তাগঞ্জ জংশন ও কুলাউড়া স্টেশনে সিলেট থেকে ঢাকাগামী ‘জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস’, চট্টগ্রাম থেকে সিলেটগামী ‘জালালাবাদ এক্সপ্রেস’ এবং ঢাকা থেকে সিলেটগামী ‘পারাবত এক্সপ্রেস’ ট্রেন আটকা পড়েছে। এই ট্রেনগুলো নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছতে দেরি হওয়ায় ছাড়তেও দেরি হচ্ছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন ঈদে ঘরমুখো যাত্রীরা।
একই সঙ্গে অন্যান্য ট্রেনগুলোও নির্ধারিত সময়ের চেয়ে কিছু দেরিতে চলাচল করেছে। এর কারণ হিসেবে কর্তৃপক্ষ বলছেন, ঈদে যাত্রী সংখ্যা বেশি এবং বিভিন্ন স্টেশনে বিরতি দেওয়ায় বেশি সময় লাগছে। অন্য সময় ট্রেনগুলো প্রতিটি স্টেশনে দুই মিনিট করে দেরি করলেও এখন পাঁচ মিনিটের বেশি সময় দেরি করতে হচ্ছে। ফলে ট্রেন কমলাপুরে ফিরতে এবং ত্যাগ করতে কিছুটা সময় দেরি হচ্ছে। তবে ঈদযাত্রায় ১৫ থেকে ৩০ মিনিটকে বিলম্ব হিসেবে ধরে না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
কমলাপুর প্ল্যাটফর্মে শিডিউল বিপর্যয়ে পড়া ট্রেনের যাত্রীদের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। তারা বলছেন, প্রতিদিনই যদি ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় হয় তাহলে দুর্ভোগ আরও বাড়ছে। চিলাহাটিগামী নীলসাগর এক্সপ্রেসের যাত্রী সমীরা আক্তার সেতু বলেন, ‘২৫ মে আমার ছোট ভাই ১২ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে তিনটি টিকিট পেয়েছে। আমি, সে এবং আমার মা আজ বাড়ি যাবো। ট্রেনের শিডিউল অনুযায়ী নীলসাগর এক্সপ্রেস সকাল ৭টা ১০ মিনিটে ছাড়ার কথা। এখন ১১টা বাজে। এখনও ট্রেনের কোনও খবর নেই। সকাল ৬টা থেকে কমলাপুর স্টেশনে এসে আমরা বসে আছি।
এদিকে দুপুর পর্যন্ত প্রায় ৩০টি ট্রেন কমলাপুর ছেড়ে গেছে। স্টেশন ম্যানেজার আমিনুল হক বলেন, নানা কারণে দুই-চারটি ট্রেন বিলম্ব হয়েছে। সারাদিনে ৫০ হাজারেরও বেশি যাত্রী বিভিন্ন ট্রেনে বাড়ি ফিরেছেন। ট্রেনের ছাদে যাত্রী ফেরা ঠেকাতে তারা তৎপর রয়েছেন।
এদিকে সোমবার যারা ছুটি পাননি তারা অফিস শেষ করে বিকেলে বাসসহ বিভিন্ন যানবাহনে ঈদের যাত্রা শুরু করবেন। দুপুরের পর থেকে যানবাহনগুলোতে চাপ বাড়বে। তবে সকাল থেকে রাজধানী ঢাকার বাস টার্মিনালগুলোতে যাত্রীদের তেমন একটা চাপ দেখা যায়নি। নগরীর ফকিরাপুল বাস কাউন্টারে গিয়ে দেখা গেছে, শ্যামলী পরিবহনের কর্মীরা এসি বাসসহ যাত্রীদের ডেকে ডেকে টিকিট বিক্রি করছেন। এ কাউন্টার থেকে পরিবহনটি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-টেকনাফ-বান্দরবান-লামা-আলীকদম-ফটিকছিড়ি-খাগড়াছড়ি ও কাপ্তাই রুটে চলাচল করে। কাউন্টার মাস্টার রাজিবুল ইসলাম বলেন, এখনও তাদের বাসের টিকিট রয়েছে। এদিকে সদরঘাটসহ রাজধানীর চারটি বাস টার্মিনালে সকাল থেকেই যাত্রীদের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। মহাসড়কগুলোতে যানজট না থাকায় বাসের শিডিউলে কোনও বিপর্যয় ঘটেনি, নির্ধারিত সময়ে ছেড়ে যাচ্ছে বাসগুলো।
জানতে চাইলে গাবতলী টার্মিনালের রাজধানী এক্সপ্রেসের সহকারী ম্যানেজার রেজাউল মোল্লা রাজু বলেন, এখনও গার্মেন্ট কারখানা ছুটি হয়নি, চাপ নেই। বিকেল পাঁচটার পর যাত্রীদের চাপ বাড়বে। যেসব যাত্রী অগ্রিম টিকিট নিয়েছেন তারা এখন স্বস্তিতেই বাড়ি ফিরছেন।
পরিবহন সংকট, অপেক্ষায় হাজারো যাত্রী : বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীদের ভিড় বাড়ায় যানবাহনের সংকট দেখা দিয়েছে সাভারে। ঢাকা-আরিচা ও নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কে গাড়ির চাপ থাকলেও বেশি ভাড়া চাওয়ায় যাত্রীরা পড়েছেন চরম ভোগান্তিতে।
সোমবার বেলা আড়াইটার দিকে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড, সিএনবি, নবীনগর, বাইপাইল ও জামগড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় যানবাহনের জন্য যাত্রীদের অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। এছাড়া বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ডগুলোতে যানবাহন ধীরগতিতে চলছে।
যাত্রীদের অভিযোগ, সড়কে যানবাহন থাকলেও পরিবহনের শ্রমিকরা বাড়তি ভাড়া নিচ্ছে। এতে যাত্রীরা সহজে সব গাড়িতে যেতে পারছেন না।
মানিকগঞ্জ যাবেন আশিক ও তার পরিবার। সকাল ১১টা দিকে সাভার বাসস্ট্যান্ডে এলেও বাসে ভাড়া ও অতিরিক্ত মানুষের চাপে তারা উঠতে পারছেন না৷
আশিক বলেন, আমি মা, বোনসহ সকালে এসেছি। বাস আছে কিন্তু ভাড়া অনেক গুনতে হচ্ছে৷ এছাড়া বেশি যাত্রীর চাপ তাই বাসে ওঠাও সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে ফিটনেসবিহীন বাস মহাসড়কে নামতে দেওয়া হচ্ছে না বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এ ব্যাপারে ঢাকা জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক ও অপরাধ) সাইদুর রহমান বলেন, আজ পোশাক কারখানা ছুটি হয়ে যাওয়ায় ঘরমুখো মানুষের চাপ বেড়েছে। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি ঘরমুখো মানুষ যেনো নির্বিঘেœ বাড়ি পৌঁছাতে পারেন। কোথাও কোনো যানজট নেই তবে বাসস্ট্যান্ডগুলোতে যানবাহন ধীরগতিতে চলছে।
অতিরিক্ত ভাড়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সড়কে কর্মরত সব ট্রাফিক পুলিশ ও পুলিশকে বলে দেওয়া হয়েছে কেউ অতিরিক্ত ভাড়া নিলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *