চীনের নেতৃত্বাধীন জোটে বাংলাদেশ
দুই-তৃতীয়াংশ হাসপাতালে নেই আইসিইউ
নিজস্ব প্রতিবেদক : করোনাভাইরাসের টিকা পেতে ৬টি দেশ নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে চীনের উদ্যোগে নতুন প্ল্যাটফর্ম ‘ইমার্জেন্সি ভ্যাকসিন স্টোরেজ ফ্যাসিলিটি ফর কোভিড ফর সাউথ এশিয়া’তে যোগ দিচ্ছে বাংলাদেশ। মঙ্গলবার দুপুরে করোনার টিকা নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার ৬ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর একথা জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যখন কোনো দেশের টিকা প্রয়োজন হবে তখন তারা এই সুবিধা থেকে সাহায্য নিবেন। তাছাড়া তারা তিনটি সুবিধা দেবে। একটি হচ্ছে- পোস্ট কোভিড প্রোভারট্রি অভিযোগ। দ্বিতীয়ত, করোনার কারণে দেশে দেশে যে দারিদ্র বাড়ছে তারা সেটা জানতে চায়। আর দারিদ্র যেন না বাড়ে সে বিষয়ে কাজ করতে চায়। তৃতীয়ত, করোনার কারণে সরাসরি বিক্রয় করতে না পারার কারণে তারা ই-কমার্স চালু করতে চায়।
মন্ত্রী আরও বলেন, করোনাকালে এক দেশ আরেক দেশকে সাহায্য ও সহযোগিতা করবে এটার ওপর এই ৬টি দেশ জোর দিয়েছে। বাংলাদেশের মঙ্গলের জন্য যা যা করা দরকার সব করা হবে।
এদিকে, নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট ও বহুগুণ শক্তি নিয়ে করোনা ভাইরাস দ্বিতীয় দফায় আক্রমণ করায় দিশেহারা বিশ্বের অনেক প্রভাবশালী দেশ। পরিস্থিতি সামাল দিতে অধিকাংশ দেশই এখন করোনার টিকা পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এই দৌড়ে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। কারণ ভারতের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী টিকা না পাওয়ায় বিকল্প টিকা উৎপাদনকারী দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করছে সরকার।
ইতোমধ্যে চীন ও রাশিয়ার কাছ থেকে টিকা পাওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া মিলেছে। তারপরও শতভাগ ভরসা না পেয়ে দেশেই যৌথ উদ্যোগে টিকা উৎপাদনের চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। বর্তমানে বিশ্বে সর্বোচ্চ টিকা উৎপাদন করে ভারত। বিশ্বে বছরে বিভিন্ন রোগের যত টিকা উৎপাদন হয়, তার ৬০ শতাংশের বেশি উৎপাদন করে তারা।
আর জাতিসংঘ বছরে যত টিকা কেনে, তার ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ সরবরাহ করে ভারত। করোনার প্রতিষেধক তৈরিতে ভারত তাই শুরু থেকেই সচেষ্ট ছিল। উন্নত দেশের সঙ্গে এক্ষেত্রে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা পাল্লা দিয়ে সফলও হয়েছেন। এখন করোনার সবচেয়ে বেশি ভ্যাকসিন ভারতই উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সেই ভারতের অবস্থাও আজ শোচনীয়।
জানা গেছে যুক্তরাষ্ট্র অভ্যন্তরীণ চাহিদার চাপে ভারতে টিকা উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল রপ্তানি বন্ধ রেখেছে। ফলে কাঁচামাল না পেলে চুক্তির আওতায় ভারত থেকে বাংলাদেশে টিকা রপ্তানি স্থগিত থাকবে বলে জানা গেছে। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ টিকা সরবরাহের কী হবে, তা নিয়ে চলছে কূটনৈতিক পর্যায়ে তৎপরতা।
এছাড়া বাংলাদেশেও করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টের কারণে মৃত্যু ও সংক্রমণ বেড়েছে। কিন্তু ভারতের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী টিকা না পাওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যাওয়ায় ভ্যাকসিন কূটনীতি জোরালো করেছে সরকার।
ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে তিন কোটি ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন আনার চুক্তি হলেও কথা রাখতে পারছে না দেশটি। প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ টিকা দেওয়ার কথা থাকলেও গত দুই মাসে কিছুই দিতে পারেনি। তাই ভ্যাকসিন পেতে টিকা উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়ানো হয়েছে।
বিশেষ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ইতোমধ্যে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে শুধু একটি দেশের ওপর ভরসা না রেখে বিকল্পও পথে হাঁটতে চাইছে সরকার।
সূত্র জানায়, ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের সাথে গভীর সম্পর্ক বজায় রাখতে চায় ভারত ও চীন। এ কারণে উভয় দেশই বাংলাদেশকে ভ্যাকসিন দিতে শুরু থেকেই আগ্রহী ছিল। তাই বাংলাদেশকে ঘিরে ভারত ও চীন উভয় দেশই ভ্যাকসিন কূটনীতি চালিয়ে আসছে।
কিন্তু ভারতীয় টিকা আসার অনিশ্চয়তার মধ্যে সম্প্রতি জরুরি প্রয়োজনে টিকা পেতে বাংলাদেশসহ ৬টি দেশের সমন্বয়ে একটি জোট তৈরি হয়। এই জোটে ভারত বাদে রয়েছে বাংলাদেশ, চীন, পাকিস্তান, নেপাল, আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। এসব দেশে যদি টিকা আসে বাংলাদেশও টিকা পাবে। বাংলাদেশের এই জোটে অংশগ্রহণে ভারতও কিছুটা মনোযোগী হয়েছে বাংলাদেশকে টিকা দিতে। এ কারণে বিষয়টি নিয়ে মোদি সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে গত সপ্তাহে দিল্লি যান ঢাকায় নিযুক্ত সেদেশের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী দিল্লি থেকে ফেরার পর হাইকমিশন থেকে এ সংক্রান্ত একটি নোট-ভারবাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। নোট-ভারবালে প্রস্তাব দেওয়া হয়, ভারত এখনই অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা বাংলাদেশকে দিতে পারছে না। বিনিময়ে ভারত তাদের বায়োটেক উদ্ভাবিত কোভ্যাকসিনের যৌথ উৎপাদনে বাংলাদেশকে প্রস্তাব দিয়েছে। ভারতে এখন কোভ্যাকসিনের তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল চলছে। এ টিকার ৭৮ শতাংশ কার্যকর বলে জানিয়েছে ভারত বায়োটেক।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাশার খুরশীদ আলম এ বিষয়ে বলেন, আগামী মে মাসের প্রথম সপ্তাহে করোনা ভাইরাসের প্রায় ২১ লাখ টিকা দেশে আসবে। এর মধ্যে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ২০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন এবং কোভ্যাক্স থেকে ফাইজারের উৎপাদিত ১ লাখ টিকা পাওয়া যাবে। এছাড়া চীন থেকেও ৫ লাখ ডোজ টিকা উপহার হিসেবে পাওয়ার কথা রয়েছে।
প্রায় তিন সপ্তাহের বেশি সময় বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ঊর্ধ্বগতি। জনগণের অসচেতনতার কারণে সংক্রমণের তীব্রতা না হওয়া পর্যন্ত হাসপাতালমুখী হয় না মানুষ। এ অবস্থায় রোগীকে বাঁচাতে হাসপাতালে একটি আইসিইউ (হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে) বেড খুবই জরুরি। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় দেশের জেলা শহরের সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে কোনো হাসপাতালে আইসিইউ সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি বেশিরভাগ হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সিস্টেম নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সুত্রে জানা গেছে, দেশের ৬৪ টি জেলার মধ্যে ৩৯টিতে এখনো করোনা রোগীদের জন্য কোনো আইসিইউ বেড নেই। এ অবস্থায় গুরুতর রোগীরা অপেক্ষমাণ জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।
সরকারি তথ্য অনুসারে, দেশের জেলাগুলোর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট নেই। হাসপাতালের এক-তৃতীয়াংশের মধ্যে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থাও নেই। অথচ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত গুরুতর রোগীদের চিকিৎসার জন্য এই দুটি সিস্টেম প্রধান ভূমিকা রাখে।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর গত বছর অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রীর দেশের সব সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট ও সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রায় এক বছর সময় পেয়েও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একাজগুলো বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
সরকারি তথ্য মতে, রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে দেশের ২৫ টি জেলার সরকারি হাসপাতালে মাত্র ২৩৯ টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। সে হিসাবে একটি জেলায় গড়ে ১০টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। আর ৬৪ টি জেলার মধ্যে ৩৯ টিতে কোভিড আক্রান্ত রোগীদের জন্য কোনো আইসিইউ বেড নেই।
কোভিড-১৯ এর জন্য আইসিইউ শয্যাবিহীন হাসপাতালগুলোর মধ্যে রয়েছে- ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, রাজবাড়ী, কিশোরগঞ্জ, শরীয়তপুর, টাঙ্গাইল, খুলনা, নেত্রকোণা, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, পঞ্চগড়, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ।
এছাড়া, কোভিড রোগীর একটানা অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করার আরেকটি মূল উপাদান হলো একটি হাসপাতালের কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রেকর্ড থেকে দেখা যায় যে, ২৩ টি জেলার সরকারি হাসপাতালে এখনো কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা নেই।
সে জেলাগুলো হলো-ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, রাজবাড়ী, কিশোরগঞ্জ, শরীয়তপুর, টাঙ্গাইল, খুলনা, নেত্রকোণা, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, পঞ্চগড়, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ।
অন্যদিকে রাজধানী ঢাকা এবং চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলো বর্তমানে কোভিড রোগীদের একটি অপ্রতিরোধ্য চাপের মধ্যে রয়েছে। এই দুটি এলাকায় গুরুতর কোভিড রোগীর মৃত্যুর হার ৯০ শতাংশের বেশি। রাজধানী অনেক হাসপতালে আইসিইউ সাপোর্টের জন্য রোগীর স্বজনরা হাহাকার করছেন।
রাজধানীর মোট ১৩টি সরকারি হাসপতালে মোট ২৪২টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। এছাড়া কয়েকদিন আগে ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতাল চালু হওয়ার পর থেকে অব্যাহতভাবে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা।
চাট্টগ্রামের ৪টি সরকারির হাসপাতালগুলোর মধ্যে ৪৩টি কোভিড রোগীর জন্য আইসিইউ শয্যা রয়েছে। যার সবকটিই রোগীতে পূর্ণ। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন যে, ক্রমান্বয়ে কোভিড রোগীর সংখ্যা দেশর বিভিন্ন অঞ্চলে বাড়ছে। এ অবস্থার মোকাবিলার জন্য জেলাগুলোতে প্রস্তুতি খুব কম। যাতে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বাড়ার আশঙ্ক রয়েছে।
কোভিড-১৯ এর ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কিত ন্যাশনাল গাইডলাইনসের সম্পাদকীয় বোর্ডের সদস্য মুজিবুর বলেন, সংক্রামণ বাড়ছে। এতে মানুষের মৃত্যুর সংখাও বাড়ছে। কারণ রোগীর তীব্রতার সময় পর্যপ্ত আইসিইউ সেবা দেওয়া যচ্ছে না।
বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট নজরুল ইসলাম বলেন, দেশে করোনভাইরাস প্রাদুর্ভাবের এক বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও জেলাগুলো এখনো চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত হয়নি। ফলে জেলা পর্যায়ে করোনা সংক্রামণ ছড়িয়ে পড়লে সরকারের তা মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পরবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য এবং কোভিড-১৯ সম্পর্কিত জাতীয় প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আন্তরিকতা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় উচ্চ আদালত এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ সত্ত্বেও হাসপতালগুলোত করোনা চিকিৎসার সব সুযোগ-সুবিধা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এর দায় মন্ত্রণালয় এড়াতে পারে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ফরিদ উদ্দিন মিয়া বলেন, নানা সংকটে সব জেলায় আইসিইউ শয্যা ও কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থায় সজ্জিত করা যায়নি। তবে এখন প্রতিটি জেলায় জেলায় আইসিইউ এবং কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ সিস্টেম স্থাপনের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ চলছে। তবে প্রকল্পটি কবে শেষ হবে সে সম্পর্কে তিনি অবশ্য কোনো সময়রেখা দিতে পারেননি।