বিশেষ প্রতিবেদন : বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের জীবন্ত কিংবদন্তি নায়িকা ববিতার ৬৮তম জন্মদিন ৩০ জুলাই শুক্রবার । বাংলাদেশ চলচ্চিত্রকে বিশ্ব পরিমণ্ডলে পরিচিতি লাভ করতে নায়িকাদের মধ্যে ১ম ভূমিকা রাখেন ববিতা। চলচ্চিত্রের আধুনিক পটভূমি সৃষ্টি করতে অগ্রণী ভূমিকাও পালন করেন তিনি।
চলচ্চিত্রের অভিনেত্রীদের অভিনয়ে আধুনিকতার ছোঁয়ায় আবিষ্ট করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তৎকালীন সময়ে নায়িকা ববিতা। অভিনয়ে সাজসজ্জা, গল্প ও বিভিন্ন দৃশ্যে আধুনিক অভিনয় যুক্ত করতে পারঙ্গম অবস্থা সৃষ্টি করেছেন তিনি। ফলে, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দর্শক সিনেমা হলগুলোতে তৎকালীন সময়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন।
ববিতা প্রায় ৩ দশক ধরে চলচ্চিত্রে অভিনয় করছেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ববিতা একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। নায়িকা হিসেবে তাঁর স্বাতন্ত্র্যতা লক্ষণীয় ছিল। অভিনয়, গ্ল্যামার, স্কিন পার্সোনালিটি, নৃত্য কুশলতা সবকিছুতেই তিনি পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন। গ্রামীণ, শহুরে চরিত্র কিংবা সামাজিক অ্যাকশন অথবা পোশাকী সব ধরনের ছবিতেই তিনি সাবলীলভাবে অভিনয় করেন।
স্বাধীনতার পর তিনি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন। তৎকালীন সময়ে তিনি ফ্যাশনের ক্ষেত্রে শহরের মেয়েদের ভীষণ প্রভাবিত করেন। সত্তর দশকের প্রথমার্ধে রুচিশীল, সামাজিক সিনেমা মানেই ছিল ববিতা।
১৯৬৮ সালে প্রখ্যাত নির্মাতা জহির রায়হানের ‘সংসার’ ছবিতে শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন ববিতা। এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ২৭০টির মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন।
তিনি ১৯৭৬ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তনের পর টানা তিনবার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জেতেন। এছাড়া ১৯৮৬ সালে আরেকবার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী, ১৯৯৭ সালে শ্রেষ্ঠ প্রযোজক এবং ২০০৩ ও ২০১৩ সালে দুইবার শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রীর পুরস্কার লাভ করেন। বাংলা চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৬’-এ আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন। এছাড়া ২০১৮ সালে তাঁকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আজীবন সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করা হয়।
ববিতা বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতির পক্ষ থেকে সর্বভারতীয় শ্রেষ্ঠ নায়িকার পুরস্কার পান। এছাড়াও সরকারি এবং বেসরকারী অসংখ্য পুরস্কার তিনি লাভ করেছেন। এজন্য তাঁকে ‘পুরস্কার কন্যা’ বলা হতো। তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে সবচেয়ে বেশিবার আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
ববিতা ১৯৫৩ সালের ৩০ জুলাই বাগেরহাট জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম ফরিদা আক্তার পপি। বাবা নিজামুদ্দীন আতাউব একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন এবং মাতা বি. জে. আরা ছিলেন একজন চিকিৎসক। বাবার চাকরি সূত্রে তারা তখন বাগেরহাটে থাকতেন।
তবে তাঁর পৈতৃক বাড়ি যশোর জেলায়। তিন বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে বড়বোন সুচন্দা চলচ্চিত্র অভিনেত্রী, বড়ভাই শহীদুল ইসলাম ইলেট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, মেজভাই ইকবাল ইসলাম বৈমানিক, ছোটবোন গুলশান আখতার চম্পা চলচ্চিত্র অভিনেত্রী এবং ছোটভাই ফেরদৌস ইসলাম বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা। এছাড়াও অভিনেতা রিয়াজ তাঁর চাচাত ভাই। চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান তার ভগ্নিপতি।
ববিতার একমাত্র ছেলে অনীক কানাডায় পড়াশোনা করেন, তাই তিনি ২০১০ সালের মাঝামাঝিতে প্রায় ছয় মাস কানাডায় অবস্থান করেন।
শৈশব এবং কৈশোরের প্রথমার্ধ কেটেছে যশোর শহরের সার্কিট হাউজের সামনে রাবেয়া মঞ্জিলে। ববিতার পরিবার একসময় বাগেরহাট থেকে ঢাকার গেন্ডারিয়াতে চলে আসে। তাঁর মা ডাক্তার থাকায়, ববিতা চেয়েছিলেন ডাক্তার হতে।
তিনি পড়াশোনা করেছেন যশোর দাউদ পাবলিক বিদ্যালয়ে। সেখানে অধ্যয়নকালে বড়বোন কোহিনুর আক্তার চাটনীর (সুচন্দা) চলচ্চিত্রে প্রবেশের সূত্রে পরিবার সহ চলে আসেন ঢাকায়। গেন্ডারিয়ার বাড়ীতে শুরু হয় কৈশরের অবশিষ্টাংশ।
এখানে তিনি গ্লোরিয়া স্কুলে পড়াশুনা করেন। চলচ্চিত্রে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়ায় প্রতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট অর্জন না করলেও ববিতা ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে শিক্ষিত করে তোলেন। দক্ষতা অর্জন করেন ইংরেজিসহ কয়েকটি বিদেশী ভাষায়। নিজেকে পরিমার্জিত করে তোলেন একজন আদর্শ শিল্পীর মাত্রায়।
বড়বোন সুচন্দা অভিনীত জহির রায়হানের সংসার চলচ্চিত্রে শিশুশিল্পী হিসেবে ববিতার আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৬৮ সালে। এই চলচ্চিত্রে তিনি রাজ্জাক-সুচন্দার মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্র জগতে তাঁর প্রাথমিক নাম ছিলো “সুবর্ণা”। তিনি কলম নামের একটি টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেছিলেন সে সময়। জহির রায়হানের জ্বলতে সুরুজ কি নিচে চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে গিয়েই তাঁর নাম “ববিতা” হয়ে যায়।
১৯৬৯ সালে শেষ পর্যন্ত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন প্রথম নায়িকা চরিত্রে। ১৯৬৯ সালের ১৪ই আগস্টে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় এবং ঐদিন তাঁর মা মারা যান।
তাঁর কর্মজীবনের শুরুতে ভগ্নিপতি জহির রায়হানের পথ প্রদর্শনে চললেও পরে তিনি একাই পথ চলেছেন। ৭০’-এর দশকে শুধুমাত্র অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি গোটা দশকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। ‘টাকা আনা পাই’ সিনেমাটা ছিল তাঁর জন্য টার্নিং পয়েন্ট যা পরিচালনা করেছিলেন জহির রায়হান। এরপর তিনি নজরুল ইসলামের ‘স্বরলিপি’ সিনেমাতে অভিনয় করেন যা ছিল সুপারহিট সিনেমা।
ববিতার চলচ্চিত্র কর্মজীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একই নামের একটি অসমাপ্ত উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সত্যজিৎ রায় পরিচালিত অশনি সংকেত (১৯৭৩)। এই চলচ্চিত্রে “অনঙ্গ বৌ” চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক শিল্পীর মর্যাদা লাভ করেন এবং ব্যপক প্রশংসিত হন।
১৯৯৩ সালে ভারতে বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার, ১৯৭৩ সালে ভারতে বাংলা চলচ্চিত্র প্রসার সমিতি পুরস্কার এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি কর্তৃক বিশেষ পুরস্কার অর্জন করেন।