ডেঙ্গু নিয়ে দিশেহারা

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন ঢাকা রাজধানী স্বাস্থ্য

*মশার ওষুধে কার্যকারিতা নেই- মেয়র
*১৫ জুলাই থেকে ভ্রাম্যমাণ মেডিক্যাল টিম দক্ষিণ সিটিতে
*অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হলে ডিএনসিসির উদ্যোগে বিদেশে চিকিৎসা

বিশেষ প্রতিবেদক
রাজধানীতে মহামারী আকার ধারণ করেছে ডেঙ্গু রোগ। হাসপাতালগুলোতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসেবে ৬ জুলাই রাজধানীতে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১৬৪ জন, পর দিন ১২০ ও ৮ জুলাই ১২১ জন। পরিসংখ্যান ইঙ্গিত দিচ্ছে চলতি মাসে ছাপিয়ে যাবে জুনের রেকর্ড। সবদিক বিবেচনায় এরই মধ্যে ঢাকা মেডিকেল, সোহরাওয়ার্দী শিশু হাসপাতাল, হলি ফ্যামেলিসহ বেশ কিছু হাসপাতালে খোলা হচ্ছে বিশেষ উইনিট।
এখন পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ২ হাজার ৬২৬ জন, বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৫৫১ জন, এ তথ্য জানিয়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. জাহিদ মালেক। তবে এর আগে শনিবার ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র সাঈদ খোকন জানিয়েছিলেন ডেঙ্গু এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি। এসময় তিনি জোর গলায় তুলে ধরেন তাদের নেয়া কার্যক্রমগুলো।
ক’দিন ধরেই থেমে থেমে বৃষ্টি আর বাড়তি আর্দ্রতা এডিসের বংশবিস্তার আরো বাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা কীটতত্ত্ববিদদের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসেবে এরই মধ্যে রোগীর বাড়তি চাপ সামাল দিতে বেশ কয়েকটি হাসপাতালে খোলা হয়েছে ডেঙ্গুর বিশেষ ইউনিট। তারা বলছে, ডেঙ্গু মোকাবিলায় প্রস্তুত তারা। তবে মহামারি রূপ নেয়ার আগে মশক নিয়ন্ত্রণে আরো সচেষ্ট হওয়ার তাগিদ তাদের। যদিও সিটি করপোরেশন বলছে, আতঙ্কিত হওয়ার মত এখনো পরিস্থিতি হয়নি।
চলতি সপ্তাহের প্রথম দুদিনই থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। সোমবার বিকেল নাগাদ এক দফা ভারি বর্ষণ হলেও তা দূর করতে পারেনি কপালে চিন্তার ভাঁজ। তার উপর আর্দ্রতাও বেশি। কীটতত্ত্ববিদরা বলছে এমন আবহাওয়া এডিসের বংশবৃদ্ধিতে সহায়ক।এদিকে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও একই শঙ্কায়। তবে ব্যবস্থাপনা ভলো থাকায় মৃত্যুর হার সে তুলনায় বাড়বে না বলে আশাবাদ তাদের। তবে এডিস নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের আরো কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ তাদের।
যদিও সিটি করপোরেশন বলেছে সঠিক পথেই আছেন তারা। কেবল হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা তিন হাজার ছাড়ালেও তাদের দাবি, আতঙ্কের কিছু নেই।
১৫ জুলাই থেকে মাঠে নামবে সিটি করপোরেশনের মেডিকেল টিম। তারপরই দেয়া হবে ফ্রি চিকিৎসা। নগরের মোড়লদের এমন ভূমিকায় ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ।
এক অনুষ্ঠানে মেয়র আতিকুল ইসলাম মশা নিধনের কার্যকারিতা কমেছে উল্লেখ করে ওষুধ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, মশার ওষুধ ছিটানোর দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। দ্যা এগ্রো লিমিটেড এবং এগ্রোফুডকে কালো তালিকাভুক্ত করেছি। এবং তাদের মশার মেডিসিন আমরা নেবো না। এই অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেছিলেন, কোনো ওয়ার্ড কাউন্সিলের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আর গত বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গুর উপদ্রব অনেক বেশি উল্লেখ করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশা ধ্বংস করলে ডেঙ্গুর প্রকোপ না বেড়ে কমার কথা। মঙ্গলবার সচিবালয়ে জাতীয় শোক দিবস পালনের প্রস্তুতি সভার শুরুতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী এ কথা জানান।
ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের মশা নিধন কার্যক্রমে আপনি সন্তুষ্ট কিনা- জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ওনারা তো ওনাদের চেষ্টা করছেন, কিন্তু রোগীর সংখ্যা তো বাড়ছে। রোগীর সংখ্যা যদি বেড়ে যায়….আমরা আশা করব রোগীর সংখ্যা যাতে না বাড়ে। মশার উৎপত্তিস্থল যদি ধ্বংস করা হতো, মশার সংখ্যা কমে যেত, তাহলে তো ডেঙ্গু বাড়ার কথা নয়, কমার কথা।তিনি বলেন, আমি মনে করি আরও জোরেশোরে কাজ হওয়া প্রয়োজন, যাতে মশার সংখ্যা কমে যায়, তাতে ডেঙ্গু আক্রান্ত লোকের সংখ্যাও কমে যাবে। রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। যেহেতু প্রত্যেকদিন বৃষ্টি হচ্ছে, তাই মশাও বেড়ে যাচ্ছে। ডেঙ্গুর হারও বেড়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকটি হাসপাতালেই কম-বেশি ডেঙ্গু রোগী আমরা পাচ্ছি, বলেন জাহিদ মালেক।স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, এখন বর্ষার দিন, বর্ষার কারণে মশার উপদ্রব বেড়ে গেছে। মশার উপদ্রবের কারণে ডেঙ্গু হচ্ছে। ডেঙ্গুজনিত কারণে দু-একটি মৃত্যুও ঘটেছে। আমরা হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আমাদের ডাক্তার-নার্সদের অবহিত করা হয়েছে, তারা যাতে ভালভাবে চিকিৎসাটা ভালভাবে দিতে পারেন প্রশিক্ষণও তাদের দেয়া হয়েছে।
মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য জনগণকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে মন্ত্রী বলেন, এ বছর ডেঙ্গুর উপদ্রব অনেক বেশি। রোগীর সংখ্যাও অনেক বেশি ইতোমধ্যে আমরা পেয়েছি। আমাদের চেষ্টা অনুযায়ী চিকিৎসা আমরা দিচ্ছি। আমাদের চেষ্টা থাকবে, হাসপাতালে যাতে কোনো মৃত্যু না ঘটে, কোনো অবহেলার কারণ নেই। আমরা বেডের ব্যবস্থা করেছি।জাহিদ মালেক বলেন, আমরা আশা করব দুই সিটি করপোরেশন যাতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তাদের নিয়েও মিটিং করেছি। তাদের আহ্বান জানিয়েছি বেশি করে স্প্রে করুন, যাতে মশার উৎপত্তিস্থল ধংস করা হয়। তাতে ডেঙ্গু কন্ট্রোল করা যাবে, মশা কন্ট্রোল করা যাবে।
তিনি আরও বলেন, এটাও বলছি- জ্বর হলে কেউ যাতে দেরি না করেন, তাড়াতাড়ি যাতে স্বাস্থ্য সেবাটা গ্রহণ করেন। সময়মতো স্বাস্থ্য সেবা নিলে ডেঙ্গুতে ঝুঁকি নেই, দেরি করলেই সমস্যা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাটা বেশি থাকে।
রাজধানীতে মশা নিধনের জন্য ছিটানো ওষুধে ভেজাল না থাকলেও এর কার্যকারিতা খুব একটা নেই বলে স্বীকার করছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন। আর নতুন ওষুধ না আসা পর্যন্ত বর্তমান ওষুধই নগরে মশা নিধনে ব্যবহার করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
সাঈদ খোকন বলেন, বর্তমানে আমরা (সিটি করপোরেশন) যে ওষুধ ব্যবহার করছি সেটার কার্যকারিতা খুব একটা নেই। আমরা যে ওষুধগুলো ব্যবহার করে থাকি সেটা ওর্য়াল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনন (ডাব্লিউএইচও) কর্তৃক প্রেসক্রিপশন দেওয়া। সুতরাং যদি ওষুধ পরিবর্তন করতে হয় তাদের অনুমোদন নিয়ে করতে হবে। কিন্তু এটা করতে সময় লাগবে।
তিনি বলেন, এই সময়ের মধ্যে আমাদের বর্তমান যে ওষুধগুলো রয়েছে, যেগুলো আমরা কিনেছি সেগুলোই এখন আমাদের ব্যবহার করা ছাড়া বিকল্প তেমন কিছু নাই। যদিও এই ওষুধগুলোর কার্যকারিতা কিছুটা কম, কিন্তু তারপরেও হচ্ছে, একেবাবে জিরো এইরকম না। যতটুকু হওয়ার কথা ততটুকু না। মেয়র বলেন, ওষুধের মধ্যে কোন ভেজাল নেই। তবে কার্যকারিতা কিছুটা কমে গেছে।
এ বছর ডেঙ্গুর মাত্রা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ছে কি – না? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সাঈদ খোকন বলেন,গত কয়েক বছরের তুলনায় এই বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কিছুটা বেশি। কিন্তু এখনও আতঙ্কিত হবার মতো কোন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ থাইল্যান্ডে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ে ২৮ হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আত্রান্ত হয়েছে এবং ৪৩ জনের মূত্যু হয়েছে। এছাড়া সিঙ্গাপুরে এ বছর ৬ হাজার ২২১ জন ডেঙ্গুতে আত্রান্ত হয়েছে। যা ৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী দিল্লী শহরেও ঢাকা শহর থেকে অনেক বেশি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের ঢাকা শহরে যে সমস্ত ডেঙ্গু রোগী আসছেন তারা সারা বাংলাদেশ থেকে আসছেন। এমন নয় এই রোগীগুলো কেবল ঢাকা উত্তর কিংবা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের রোগী।
তিনি বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সারা বাংলাদেশ থেকে ঢাকায় চিকিৎসা নিতে আসছেন এমন ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ১০০ প্লাস। এসব রোগী ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ১ হাজার ৮৭৫ জনের বেশি রোগী ইতিমধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। দুইজনের মূত্যু হয়েছে। আরেকটি মুত্যুর কথা শোনা যায়, একজন ডাক্তার, যিনি তিনবার হ্রদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন এমনটায় জানা গেছে। এই রকম একটা পরিসংখ্যান কোনভাবেই প্রমাণ করে না ডেঙ্গু অনেক ব্যাপকতা ছড়িয়েছে এই কথা আমরা বলতে পারি না।
ডিএনসিসি মেয়র বলেন, ডেঙ্গুর ব্যাপকতা যদি ছড়িয়ে যেত, আমরা অব্যশই সেটা জনগণকে অবহিত করতাম। আমরা যে ব্যবস্থাগুলো নিচ্ছি তাতে ডেঙ্গু সম্পন্নভাবে নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় থাকবে, ভয়ের কোন কারণ নেই। আতঙ্কিত হবার মত এখনো কিছু হয়নি।
তিনি বলেন, আগামী ১৫ জুলাই থেকে ৪ শ ৫০টি ভ্রাম্যমাণ মেডিক্যাল টিম প্রতিটি ওয়ার্ডে থাকবে। বিনামূল্য চিকিৎসা দেওয়া হবে, ওষুধ দেয়া হবে। একটি হটলাইন চালু করা হবে। ওই নাম্বারে ফোন করা হলে মেডিকেল টিমি বাসায় চলে যাবে। কোন নাগরিক ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে সঙ্কটাপন্ন হলে প্রয়োজনে ডিএনসিসির উদ্যোগে তাকে বিদেশে পাঠানো হবে।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *