প্রবল স্রোতে ফেরি চলাচল ব্যাহত
এম এ স্বপন : প্রধান প্রধান নদ-নদীর পানি বাড়ায় বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে বাড়ছে বানভাসির সংখ্যা। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। অনেক স্থানে বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি, ফসল ও পুকুরের মাছ। আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন বন্যাদুর্গতরা। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে কলেরা, ডায়রিয়াসহ ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত রোগ।
বন্যার পানির তোড়ে ভেসে যাচ্ছে বসতবাড়ি। বুধবার রাতে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের তাড়াই এলাকায় বাঁধ ভেঙে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে আরও ১০টি গ্রাম। পানিবন্দি ১১১ গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ। পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা না পেয়ে মানবেতর দিন যাপন করছেন তারা।
কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি বেড়ে ৯ উপজেলার ৬ লাখ মানুষ বন্যার কবলে পড়েছেন। বেশিরভাগ বসতবাড়ি ডুবে গেছে। ঘরহারা মানুষ গবাদি পশু নিয়ে বাঁধ, রাস্তাঘাট, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ঠাঁই নিয়েছেন। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে কলেরা, ডায়রিয়াসহ নানা পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি বেড়ে বিপদসীমার ১৬৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, মাদারগঞ্জ ও মেলান্দ উপজেলাসহ ৬ উপজেলার ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ৩ শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তলিয়ে গেছে ১৪ হাজার হেক্টর জমির ফসল। রেল লাইনে পানি উঠে যাওয়ায় ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে।
বগুড়ার সারয়িাকান্দি, সোনাতলা, ধুনটে বন্যার পানি বেড়ে তলিয়ে গেছে ফসলি জমি ও পুকুরের মাছ। লাখো মানুষ নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। বানভাসি মানুষের কাছে এখনো পৌঁছায়নি ত্রাণ সহায়তা।
সিরাজগঞ্জের ৫ উপজেলার নিচু ও চর এলাকা ডুবে যাওয়ায় মানুষ বাঁধের উঁচু স্থানে অবস্থান নিয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে ২০৫ মেট্রিকটন জাল ও দুই হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।
শরীয়তপুরে পদ্মার পানি বেড়ে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে নড়িয়া উপজেলার ঘরিষার ও নশাশন ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম। তলিয়ে গেছে মোক্তারচরের বেশিরভাগ রাস্তাঘাট।
প্রবল স্রোতে ফেরি চলাচল ব্যাহত : প্রবল স্রোতে পদ্মায় পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। দ্বিগুণ সময় লাগাছে পারাপারে। ফলে পদ্মার দুই পাড়ে আটকে আছে কয়েকশ যাত্রীবাহী যানবাহন।
গত বুধবার থেকে পাটুরিয়ায় আটকে পড়েছে কয়েক পণ্যবোঝাই ট্রাকসহ বাস ও প্রাইভেটকার। আজ বৃহস্পতিবার সকালে ঘাটে আটকে থাকা যানবাহনের পরিমাণ আরও বেড়েছে।
বিআইডাব্লিউটিসির আরিচা ঘাট ব্যবস্থাপক সালাহ উদ্দিন জানান, পদ্মায় প্রবল স্রোতের কারণে নৌরুটের সবগুলো ফেরি চলাচল করতে পারছে না। কয়েকটি ফেরি স্রোতের প্রতিকূলে চলতে গিয়ে ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা দিয়েছে। যানবাহনে চাপ বেশি থাকায় সাধারণত জরুরি ছাড়া সাধারণ ট্রাক পারাপার বন্ধ রাখা হয়েছে।
গাইবান্ধায় ভয়াবহ রূপ নিয়েছে বন্যা, ৫ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি : গাইবান্ধায় জেলা প্রতিনিধি জানান, গাইবান্ধায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। আজও বন্যার পানিতে একের পর এক ব্রিজ, কালভার্ট ও পাকা রাস্তা ভাঙছে। গত কয়েক দিনে গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সবগুলো বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে জেলার ৭ উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম। জেলা প্রশাসক ও জেলা দায়রা জজের বাসভবনের সামনেও হাঁটু পানি। গাইবান্ধা পৌরসভার প্রায় সবগুলো ওয়ার্ড ২ থেকে ৩ ফুট বন্যার পানিতে নিমজ্জিত। ট্রেন চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছে জেলার পানিবন্দি ৫ লক্ষাধিক মানুষ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার দুপুরে ফুলছড়ির ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপৎসীমার ১৫০ সেন্টিমিটার, ঘাঘট নদীর পানি শহরের নতুন ব্রিজ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৯৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি কমে বিপৎসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সরেজমিনে জানা যায়, জেলার বন্যাকবলিত ৭ উপজেলার ৪০০টি গ্রামের প্রায় ৫ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যা কবলিত এলাকার অনেক মানুষ তাদের ঘরবাড়ি, গবাদিপশু নিয়ে আশেপাশের উঁচু স্থান ও আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। পানির তীব্র স্রোতে ঘাঘট রক্ষা বাঁধসহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধগুলোর বিভিন্ন পয়েন্টে ধস নেমেছে। ফলে জেলার ফুলছড়ি, সাঘাটা, সদর ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
বন্যাকবলিত এলাকার মানুষজন সব থেকে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন গবাদিপশু নিয়ে। গবাদি পশুর থাকা এবং খাবার চরম সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়া সংকট সৃষ্টি হয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির। চরাঞ্চল ও নদী বেষ্টিত চারটি উপজেলার বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইতোমধ্যে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। এতে ২৪৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ৮৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফুলছড়ি উপজেলার তিনটি ও সদর উপজেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এছাড়া ৩৫টি বিদ্যালয়ে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। তবে জেলা প্রশাসন জানিয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৮ জন।
পানির চাপে সদর উপজেলার বাদিয়াখালীতে রেললাইন ধসে পানির নিতে নিমজ্জিত হওয়ায় সান্তাহার, লালমনিরহাট, রংপুর রেলপথে গাইবান্ধার ওপর দিয়ে সকল ট্রেন চলাচল দুইদিন থেকে বন্ধ আছে। তবে সান্তাহার থেকে গাইবান্ধার বোনারপাড়া রেলওয়ে স্টেশনের বিভিন্ন লোকাট ট্রেন চলাচল করছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সাঘাটা উপজেলার অর্ধশত গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে সাঘাটা উপজেলার সঙ্গে গোবিন্দগঞ্জ হয়ে বগুড়ার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পাকা সড়কসহ কয়েকটি কালভার্ট ধসে দ্রুতগতিতে বিভিন্ন উপজেলায় পানি প্রবেশ করছে।
এ বিষয়ে সাঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উজ্জ্বল কুমার ঘোষ বলেন, বন্যা ভয়বহ রূপ নিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ত্রাণ সহায়তাসহ বিভিন্ন সহায়তায় আমরা পাশে আছি।
সাঘাটা উপজেলা এলজিইডি কর্মকর্তা মো. ছবিউল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সাঘাটায় বেশ কয়েকটি কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গাইবান্ধা-সাঘাটা পাকা রাস্তা তলিয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন স্থানে গর্তের সৃষ্টি হচ্ছে।
জেলার বানভাসি মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে জানতে চাইলে গাইবান্ধার সিভিল সার্জন এবিএম আবু হানিফ বলেন, বন্যাকবলিত এলাকায় জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ১০৯টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। এর মধ্যে বন্যাকবলিত সব উপজেলায় কাজ করছে ৬১টি টিম।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর গাইবান্ধার উপ-পরিচালক এসএম ফেরদৌস জানান, এ জেলায় রোপা আউশ ৯৭৭ হেক্টর, পাট ২ হাজার ৪৩৯ হেক্টর, রোপা আমন বীজতলা ৪৬১ হেক্টর, বিভিন্ন ধরনের সবজি ২৪৭ হেক্টর, পান ৩ হেক্টর এবং তিল ২৫ হেক্টরসহ মোট ৪ হাজার ১৫২ হেক্টর জমি পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ক্ষতিগস্ত কৃষকদের তালিকা করে বিস্তারিত পরে জানানো হবে।
গাইবান্ধা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আব্দুল দাইয়ান জানান, জেলার চার উপজেলার বন্যা কবলিত এলাকার ১ হাজার ৯৫৫টি পুকুরের ৪৯৯ মেট্রিক টন মাছ ভেসে গেছে। ভেসে যাওয়া মাছের মূল্য ধরা হয়েছে ৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এছাড়া ২৪ লাখ টাকার ১৯ লাখ মাছের পোনা ভেসে গেছে।
গাইবান্ধার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মোছা. রোখছানা বেগম জানান, বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে ত্রাণ সহায়তা প্রদান অব্যহত আছে। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোর জন্য এখন পর্যন্ত ৫৮৫ মেট্রিক টন চাল, নগদ ৯ লাখ টাকা ও ২ হাজার শুকনো খাবারের প্যাকেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়া নতুন করে আরও এক হাজার মেট্রিক টন চাল, ১০ লাখ টাকা এবং পাঁচ হাজার শুকনো খাবারের প্যাকেট বরাদ্দ চেয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরে চিঠি পাঠানো হয়েছে। বানভাসিদের জন্য ১২৪টি আশ্রয় কেন্দ্র খুলে দেয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা তিন লাখ ৫৮ হাজার ৬১৮ জন।