আজকের দেশ রিপোর্ট : ভারত ও মিয়ানমার সংলগ্ন সীমান্ত দিয়ে মাদক চোরাচালানের রুটেই দেশে ঢুকছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। আর মাদকের সঙ্গেই সেসব অস্ত্রের বেচাকেনা চলছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়।
অভিজাত এলাকায় মাদক সিন্ডিকেটের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। আর প্রতিটি মাদক কারবারি চক্র আধিপত্য বিস্তার করতে সঙ্গে রাখছে আগ্নেয়াস্ত্র। সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজের পাশাপাশি মাদক কারবারিরা এখন অস্ত্র বেচাকেনায় প্রধান ভূমিকা রাখছে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও সীমান্তের কয়েকটি সূত্র জানায়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম ও নাগাল্যান্ডে গড়ে ওঠা অবৈধ অস্ত্র তৈরির কারখানা থেকে সীমান্ত পেরিয়ে আসছে অস্ত্রের চালান।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যশোরের র্শাশা, বেনাপোল, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ, সাতক্ষীরার ভোমরা এলাকা দিয়েই বেশি অস্ত্র আসছে। এসব রুট দিয়ে ফেনসিডিল, হেরোইনের সঙ্গে ইয়াবাও আসছে।
অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্বভাগে চট্টগ্রাম থেকে পাহাড়ি সীমান্ত পেরিয়ে টেকনাফ পর্যন্ত ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে আসছে ভারী অস্ত্র। একই রুটে দেদার পাচার হয়ে আসছে ইয়াবা ও আইস। গোয়েন্দারা এই অস্ত্র ও মাদক পাচারের অন্তত ৩২টি রুট চিহ্নিত করেছেন।
চিহ্নিত মাদক ও অস্ত্র কারবারিরা ছাড়াও স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতা ও প্রভাবশালীরা ঝুঁকছেন অবৈধ অস্ত্রের কারবারে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী নজরদারি শেষে অস্ত্র উদ্ধারে গিয়ে একই সঙ্গে পাচ্ছে মাদকের চালান। আবার মাদক কারবারিদের ধরতে গিয়ে পাওয়া যাচ্ছে অস্ত্রের চালান। মাদক আর অস্ত্র চোরাচালানে এমন যোগসূত্র পেয়ে নজরদারি জোরদার করেছেন পুলিশ, র্যাব ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) গোয়েন্দারা।
ডিএনসির মহাপরিচালক আব্দুস সবুর মণ্ডল বলেন, ‘মাদক কারবারিদের কাছে অস্ত্র আছে। অথবা মাদক কারবারিরাও এই কারবারটি করে—এমন তথ্য আমরা আগেই পেয়েছি। আমাদের সদস্যরা নিরস্ত্র হয়েও অনেক অস্ত্রধারীকে গ্রেপ্তার করেছে। এ অবস্থায় সরকার আমাদের অস্ত্র দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।’
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্র অবৈধ কারবারে ব্যবহার করা হয়। তবে মাদকের সঙ্গে এর যোগসূত্র আমরা বেশি পাই। অন্যতম হোতারা তাদের কারবার ও প্রভাব ধরে রাখতে বা শক্তির জানান দিতে সঙ্গে অস্ত্র রাখে।
অনেক সময় গোলাগুলির ঘটনাও ঘটে। আবার আমরা অস্ত্রের খবর পেয়ে অভিযানে গিয়ে মাদকও পাই। তাই মাদক কারবারিদের কাছে অস্ত্র থাকতে পারে এমনভাবে এলিট ফোর্স হিসেবে কৌশল নিয়েই আমরা অভিযান পরিচালনা করি। নজরদারিও অব্যাহত রাখছি।’
ডিবির সূত্র জানায়, যশোরের শার্শার বেনাপোলের অগ্রভুলোট, পুটখালী, দৌলতপুর, সাদীপুর, রঘুনাথপুর, ঘিবা ও শিকারপুর সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র পাচার হয়ে আসছে।
গত ১ সেপ্টেম্বর শার্শা উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আকুল হোসেনকে আটটি পিস্তল ও চার সহযোগীসহ ঢাকায় গ্রেপ্তার করে ডিবি। তিনি ২০১৪ সাল থেকে ঢাকায় দুই শতাধিক চোরাচালানের অস্ত্র বিক্রি করেছেন। তাঁর চক্রের সদস্যরা মাদকের চালান নিয়ে আসে ঢাকায়।
এর আগে ১৭ আগস্ট রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে দুটি পিস্তল, আট রাউন্ড গুলি, দুটি ম্যাগাজিনসহ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি জানিবুল ইসলাম জোসিসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। ডিবি সূত্র জানায়, জোসি কয়েক বছর ধরেই অস্ত্র ও মাদকের কারবার করে আসছিলেন। শিবগঞ্জ সীমান্তের একটি চক্রের কাছ থেকে এগুলো সংগ্রহ করে ঢাকায় এনে বিক্রি করতেন তিনি।
সূত্রগুলো জানায়, ভারতের কারখানায় তৈরি হওয়া বিভিন্ন ধরনের পিস্তলের সঙ্গে উগনি কম্পানির রিভলবার, মাউজার পিস্তল, ইউএস তাউরাস পিস্তল, ইতালির প্রেটো বেরেটা পিস্তল, জার্মানির রুবি পিস্তল, ইউএস রিভলবার, আমেরিকান নাইন এমএম পিস্তল, মেঘনাম কম্পানির পয়েন্ট থ্রি-টু বোরের রিভলবার পাচার হয়ে আসছে বেশি।
সম্প্রতি র্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া মডেল পিয়াসা সিন্ডিকেটের মিশু হাসান ও তাঁর সহযোগীদের মাদকের সঙ্গে অস্ত্রের বড় কানেকশন পেয়েছেন তদন্তকারীরা। ৩ আগস্ট মিশু ও তাঁর সহযোগী জিসানকে ১৩ হাজার ইয়াবা ও একটি বিদেশি পিস্তল, ছয় রাউন্ড গুলিসহ গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের কাছে একটি ভিডিও ক্লিপ পাওয়া যায়, যাতে দেখা যায় জিসান, সৌরভ ও শুভ ওরফে কিলার শুভ নামে তিনজন অজ্ঞাত স্থানে স্নাইপার রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এমনকি মডেল পিয়াসার হাতে দেখা গেছে অত্যাধুনিক উজি গান। এই অস্ত্রটির অনুমোদন নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলছে।
র্যাব ও ডিএনসির একাধিক সূত্র জানায়, ঢাকার অভিজাত এলাকায় ‘হাউস পার্টি’র নামে বসছে মাদক ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের আড্ডা। এসব পার্টিতে মিলিত হওয়া প্রায় সবার কাছেই অস্ত্র রয়েছে। আইসসহ মাদক বিক্রেতারাও সঙ্গে অস্ত্র রাখছেন। তাঁদের কয়েকজন হাইপ্রফাইল হওয়ায় বৈধ অস্ত্রও রাখেন। তবে সঙ্গে অবৈধ অস্ত্রও কিনছেন তাঁরা। মিশু, জিসানের মতো কয়েকজন মাদক বিক্রেতা এসব অস্ত্রের জোগান দেন।
র্যাবের তথ্য মতে, ২০২০ সালে ৬৯৮টি অস্ত্র ও সাত হাজার ২৪৯টি গুলি উদ্ধারের ঘটনায় ৫৪৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। চলতি বছরের তিন মাসে ১২২টি অস্ত্র ও দুই হাজার ৯৫৬ রাউন্ড গুলি উদ্ধার হয়।