বিশেষ প্রতিবেদক : বেনাপোল স্থল বন্দর যেন বৈধ পন্যের আড়ালে অবৈধ পন্য পাচারের নিরাপদ এবং সুরক্ষিত ট্রানজিটে পরিনত হয়েছে, এ অভিযোগ খোদ বৈধ ব্যাবসায়ী ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট মালিকদের।
আমদানিকারকদের অভিযোগ, সরকারের মোটা অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দিতে বেনাপোল বন্দরে তৎপর একটি সিন্ডিকেট। গ্রুপটি দুই দেশের বন্দর এলাকায় শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে।
দেশের সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর বেনাপোল দিয়ে ভারত থেকে আমদানি করা বৈধ পণ্যের ট্রাকের মধ্যে কোটি কোটি টাকার অবৈধ মালপত্র আনার অভিযোগ উঠেছে।
আমদানিকারকদের অজান্তে একটি সিন্ডিকেট ভারতীয় ট্রাকচালকদের ব্যবহার করে এসব পণ্য আনছে বলে অভিযোগ করেছে ব্যবসায়ীদের সংগঠন সিঅ্যান্ডএফ।
আমদানিকারকদের অভিযোগ, সরকারের মোটা অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দিতে বেনাপোল বন্দরে তৎপর একটি সিন্ডিকেট।
এই গ্রুপটি দুই দেশের বন্দর এলাকায় শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে। তাদের আনা অবৈধ পণ্যের কারণে হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাধারণ আমদানিকারকরা।
ব্যবসায়ীরা জানান, অবৈধ পথে পণ্য আনতে না পেরে মহলটি এখন কাজে লাগাচ্ছে ভারতীয় ট্রাকচালক ও তাদের সহকারীদের। এসব চালক ও সহকারীরা টাকার বিনিময়ে ভারত থেকে আনা বৈধ পণ্যের ট্রাকে করে আনছে নানা অবৈধ পণ্য।
অবৈধ ব্যবসাটি পরিচালনার জন্য বেনাপোলের অপর পাশে ভারতের পেট্রপোল বন্দর এবং বনগাঁ এলাকায় গড়ে উঠেছে একাধিক শক্তিশালী গ্রুপ। বনগাঁ এবং আশপাশের এলাকা বিশেষ করে চাঁদপাড়া, মসনন্দপুর, গোবরডাঙ্গা, গাইঘাটা অঞ্চলের অনেক ট্রাকচালক ও তাদের সহকারীরা এ চক্রের সঙ্গে জড়িত।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজল গণমাধ্যম কে জানান, আমদানি পণ্যবাহী ট্রাক বাংলাদেশে ঢোকার আগে বনগাঁ কালিতলা পার্কিংয়ে ২০ থেকে ২৫ দিন অবস্থান করে।
পার্কিং এলাকায় নজরদারি না থাকায় বনগাঁভিত্তিক চোরাচালান চক্রটি পণ্যবাহী ট্রাকচালকদের সঙ্গে সমঝোতা করে আমদানি করা বৈধ মালপত্র ভর্তি গাড়িতে উঠিয়ে দিচ্ছে শাড়ি, থ্রি-পিস, কসমেটিক্স, ওষুধসহ মদ ও ফেনসিডিলের মতো মাদকদ্রব্য।
তার অভিযোগ, ভারতের ট্রাকচালকরা বেনাপোল বন্দরে ঢোকার পর মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এ দেশের চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
পরে সেড ইনচার্জদের সহযোগিতায় কৌশলে অবৈধ পণ্যগুলো বন্দরের নির্দিষ্ট সেডে নামানো হয়। সেখান থেকে রাতের অন্ধকারে বন্দর থেকে পণ্যগুলো বের করে নিয়ে যায় চক্রটি।
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট নেতার আরও অভিযোগ, মাঝে মাঝে ভারত থেকে আসা ট্রাকের পাশে অন্য ট্রাক রেখেও অবৈধ মালপত্র আনলোড করে নেয় চক্রটি। বন্দর থেকে পণ্য বের করে নেয়ার জন্যও এখানে রয়েছে আরেকটি চক্র।
অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মহসিন মিলনের অভিযোগ, চোরাচালানি এই চক্রের কারণে এখন পণ্য আনতে আতঙ্কে থাকেন আমদানিকারক এবং সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা। তাদের পণ্যের মধ্যে আনা এসব অবৈধ মালপত্রের বিষয়ে কিছুই জানেন না আমদানিকারকরা। তবে ধরা পড়লে লাইসেন্স বাতিল হয় আমদানিকারকদের।
অথচ প্রত্যেকবারই অবৈধ পণ্য আটকের সময় ট্রাক রেখে পালিয়ে যান ভারতীয় ট্রাকচালক ও সহকারীরা।
আমদানি পণ্যের ট্রাকে অবৈধ মালপত্র পাওয়ায় সম্প্রতি পাঁচ সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টে সাময়িকভাবে বাতিলও করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
গত ২৭ জুলাই এয়ার এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান ভারত থেকে ৩০০ কার্টন ব্লিন্ডার আমদানি করেন। সিন্ডিকেটের সদস্যরা ভারত থেকে সেই ট্রাকে ২৭ কার্টন শাড়ি, থ্রি-পিস, ওষুধ ও প্রসাধনসামগ্রী তুলে দেয়। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ট্রাকটি বন্দরে ঢোকার সময় আটক করে।
অবৈধ পণ্য পাওয়ায় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক আনোয়ার এন্টারপ্রাইজের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের লাইসেন্স সাময়িক বাতিল করে।
শুধু বাংলাদেশে অবৈধ পণ্য আসছে না ভারতেও বিভিন্ন পণ্য নিয়ে যাচ্ছে চক্রটি। বাংলাদেশ থেকে স্বর্ণ, ডলার ও ইলিশসহ বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী পাচার করে চক্রটি।
এসব মালপত্র নিয়ে এরই মধ্যে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে একাধিক চালক আটক হয়েছেন।
ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অফ কমার্সের সাব কমিটির পরিচালক মতিয়ার রহমান গণমাধ্যম কে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে একটি চক্র বেনাপোল বন্দরকে ঘিরে চোরাচালান ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এদের কারণে হয়রানির শিকার হচ্ছে সাধারণ আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ব্যবসায়ীরা। আমরা এই চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রশাসনকে জানিয়েছি।’
বেনাপোল বন্দরের উপপরিচালক মামুন তরফদার বলেন, ‘এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে বন্দরের কোনো কর্মকর্তা জড়িত কি না আমার জানা নেই। তবে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
বেনাপোল কাস্টম কমিশনার মো. আজিজুর রহমান গণমাধ্যম কে বলেন, ‘সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বৈধ পণ্যের সঙ্গে যেসব অবৈধ মালপত্র আমরা আটক করেছি, তা নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।
সিন্ডিকেটের কথা আমরা শুনেছি। ভারতীয় কাস্টমসের সঙ্গে বৈঠক করে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’