মহসীন আহমেদ স্বপন : ঈদ এলেই এদেশে জালনোট ও অজ্ঞান পার্টি চক্রের সদস্যরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ইতিমধ্যে বাজারে ছাড়া হয়েছে লাখ লাখ টাকার জাল নোট। আরো জালনোট ছড়াতে সক্রিয় রয়েছে অন্তত ১০টি চক্র। তারা ৫শ টাকার চেয়ে এক হাজার টাকার জালনোট বাজারে ছড়িয়ে দিতে তৎপরতা চালাচ্ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ইতিমধ্যে ১০ জন জাল নোট কারবারিকে গ্রেপ্তারের পর এসব তথ্য জানতে পেরেছে। শিগগির ওসব চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে পুলিশ বিভাগ আশাবাদী। ওসব চক্রকে ধরার জন্য গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। পুলিশ বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
যাত্রীবেশে বাস-ট্রেনে উঠে প্রথমে শকুনের মতো শিকার খোঁজে। এরপর বন্ধু সেজে সর্বনাশের ফন্দি আঁটে। নব্বই টাকার একটি চেতনা নাশক ট্যাবলেট দিয়ে সর্বস্ব লুট করে সটকে পড়ে অজ্ঞান পার্টির প্রতারকরা। মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি প্রশাসনের তৎপরতা ছাড়া অজ্ঞান পার্টিকে ঘায়েল করা যাবে না বলে মত সংশ্লিষ্টদের।
ঈদের মতো উৎসব পার্বণে পথ চেয়ে থাকা স্ত্রী-সন্তানদের কাছে উপার্জিত অর্থ পৌঁছানোর আগেই তা লুটে নেয় রাস্তাঘাটে ওৎ পেতে থাকা অজ্ঞান পার্টির প্রতারকরা। বিভিন্ন যানবাহনে উঠে যাত্রীদেরকে টার্গেট করে প্রথমে ভাব বিনিময়। পরে কৌশলে সখ্যতা গড়ে তোলার পর সুযোগ বুঝে দ্রব্য প্রয়োগ করে সর্বস্ব লুটে নেন তারা, এমনটাই জানান এক প্রতারক।
নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে টানা পঁচিশ বছর প্রতারণা পেশায় থাকা এই মানুষটির দাবি, রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে উত্তরের বিভিন্ন জেলায় শতাধিক সদস্য অজ্ঞান পার্টির সাথে যুক্ত। মূলত চেতনা নাশক ওষুধ দিয়ে সহজ সরল মানুষগুলোকে শিকারে পরিণত করে এই চক্র।
এক প্রতারক বলেন, ঈদের আগেই ভালো কাজ হয়। তাই ঈদকে সামনে রেখেই আমরা এই কাজে নেমে যাই। অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের ব্যবহৃত চেতনা নাশক ওষুধ কখনো প্রাণহানিও ঘটায়। কোন ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ফার্মেসিগুলোতে চেতনা নাশক বিক্রি বন্ধের দাবি চিকিৎসকদের। পুলিশ বলছে, প্রতারকরা এসব ওষুধ সংগ্রহ করে ঢাকা থেকে। রংপুর স্বাস্থ্য বিভাগের সাবেক পরিচালক ডা. অমল চন্দ্র সাহা বলেন, ‘আমরা সরাসরি মেডিসিনের দোকানে গিয়ে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই মেডিসিন পেয়ে থাকি। এই জিনিসটা বন্ধ করতে হবে। গাইবান্ধা পুলিশ সুপার আব্দুল মান্নান বলেন, তারা ঢাকা থেকে উঠে এখানে এসেই সহজ সরল মানুষের সাথে প্রতারণার সুযোগ নেয়।
প্রতি বছর ঈদ-পূজোয় ঢাকা রংপুর-মহাসড়কের গাইবান্ধা অংশে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায় বাড়ি ফেরা অনেক মানুষকে। তবে সড়ক-মহাসড়ক ও রেলপথে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে নি:স্ব হওয়া মানুষের সুনির্দিষ্ট কোন পরিসংখ্যান নেই পুলিশ বিভাগের কাছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এখন পর্যন্ত তিন ধরনের জাল নোটের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। তার মধ্যে ‘ওয়াশ নোট’ নামের জাল নোট বেশি টাকায় বিক্রি করা হয়। এটি বানাতে ব্যবহার করা হয় প্রকৃত ১০০ টাকার নোট। ওই নোটকে রাসায়নিক দিয়ে সাদা করে প্রিন্টারের মাধ্যমে ৫০০ টাকার নোট জাল করা হয়। এক লাখ টাকা মূল্যমানের জাল ‘ওয়াশ নোট’ বিক্রি হয় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকায়। আর্ট পেপারে তৈরি জাল ১০০টি এক হাজার টাকার নোট তারা চক্রের সদস্যদের কাছে ২৪-২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে। খসখসে কাগজে তৈরি এক লাখ টাকা মূল্যমানের জাল নোট ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। দীর্ঘদিন ধরেই একাধিক চ্রক বাংলাদেশি জাল নোট তৈরি করে তা বাজারজাত করে আসছে। ওই জাল টাকা চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় বাজারজাত করা হয়।
সূত্র জানায়, জালনোট চক্রগুলো জাল নোট তৈরি করে নির্দিষ্ট কয়েকজন সদস্য দিয়ে আসল টাকার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে বাজারে ছাড়ে। রাজধানীতে যে ১০টি জাল টাকা চক্র কাজ করছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হুমায়ূন কবীর চক্র। হুমায়ূন কবীর একসময় পুলিশে কনস্টেবল পদে চাকরি করতো। ১৯৯৪ সালে চাকরি পাওয়ার পর তিনি বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। অবশেষে ২০০৩ সালে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তারপর নানা ব্যবসা করতো হুমায়ূন। একপর্যায়ে রাজশাহী এলাকার একটি জাল নোট তৈরির চক্রের সঙ্গে সে জড়িয়ে পড়ে। শুধু তা-ই নয়, এরপর গড়ে তোলে জাল নোট তৈরির চক্র। ওই সময় থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত হুমায়ূন কবীরকে পুলিশ, র্যাব ও ডিবি পাঁচবার গ্রেপ্তার করেছে। প্রতিবারই সে জামিনে বেরিয়ে এসে আবারো জাল নোটের কারবারে জড়িত হয়। সর্বশেষ ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে তাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। কিন্তু চার মাস পর জামিনে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে আবারো জাল নোটের কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। তাার রয়েছে ৮-১০ জনের একটি দল, যারা টাকা বানানো ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত।
এদিকে জাল নোট কারবারে জড়িত অপরাধীদের বিষয়ে কাজ করা ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার উপ-কমিশনার মশিউর রহমান জানান, কোরবানির ঈদ এলেই জাল টাকা চক্রের সদস্যরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। আমাদের কাছে খবর আছে জাল নোট ছড়াতে কয়েকটি চক্র কাজ করছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করা হচ্ছে।