*এখন সারাবছরই এডিস মশা দেখা যাবে
*পিরোজপুরে বৃদ্ধি পাচ্ছে রোগীর সংখ্যা
*আরো ৪ জনের মৃত্যু
বিশেষ প্রতিবেদক : ঢাকা ও বরিশালে ডেঙ্গু আক্রান্ত চার রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে ঢাকায় ৩জন ও বরিশালে ১ জন। জানা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজে (ঢামেক) বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে রিফাত (১০) নামে এক শিশু মারা যায়। এ নিয়ে ঢামেকে ডেঙ্গু রোগে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২ জনে। সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে প্রতি ঘণ্টায় হাসপাতালগুলোতে একশর বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছেন বলে মনে করা হচ্ছে। সারাদেশের মতো পিরোজপুরেও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সংখ্যা। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে পিরোজপুরে ৬৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সনাক্ত করেছেন চিকিৎসকেরা। এদের মধ্যে অনেকেই ভালো হয়ে বাড়িতে ফিরে গেছেন।
পরিস্থিতি এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে বাংলাদেশে এখন সারাবছরই এডিস মশা দেখা যাবে। এই মুহূর্তে মশা কমানো খুব কঠিন। মানুষ সচেতন না হলে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের হার কমবে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুসারে, গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীসহ সারাদেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ২ হাজার ৩৪৮ জন অর্থাৎ গড়ে প্রতি ঘণ্টায় ৯৮ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, তারা মাত্র ৪০টি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তির তথ্য পাচ্ছেন। সব হাসপাতালের তথ্য পেলে প্রতি ঘণ্টায় ডেঙ্গু রোগী ভর্তির সংখ্যা সেঞ্চুরি ছাড়িয়ে যাবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাক্তার আবুল কালাম আজাদ বলেন, গত কয়েকদিন যাবত রাজধানীসহ সারাদেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধে একাধিক মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ডেঙ্গু প্রতিরোধে গৃহীত বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণের ফলে খুব শিগগিরই ডেঙ্গু পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।
তিনি বলেন, অতিরিক্ত গরম আবহাওয়া ও অতিবৃষ্টিতে ডেঙ্গু মশার প্রজনন কমে। গত কয়েকদিন যাবত যে গরম আবহাওয়া বিরাজ করছে তা অব্যাহত থাকলে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে যাবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুসারে ১ জানুয়ারি থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশের হাসপাতালে প্রায় ৩০ হাজার ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হন। তাদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২১ হাজার ৯২১ জন। বর্তমানে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৭ হাজার ৯৬৮ জন।
গত ২৪ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি ২ হাজার ৩৪৮ জন ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৮৩, মিটফোর্ডে ১০৪, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ৩৮, শহীদ সোহরাওয়ার্দীতে ৮৬, বারডেমে ১৯, বিএসএমএমইউয়ে ৪৩, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ২৬, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১২১, বিজিবি হাসপাতালে ৭, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ৪২ ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ৪৮ জন ভর্তি হন। এছাড়া বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ৪৬১ ও ঢাকা ছাড়া দেশের অন্যান্য বিভাগে ১ হাজার ৬৪ জন ভর্তি হন।
ঢাকা শহর ব্যতীত ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন জেলায় ২৭৩, চট্টগ্রাম বিভাগে ২৩১, খুলনা বিভাগে ১৬৪, রংপুর বিভাগের ৬৬, রাজশাহী বিভাগের ১০৬, বরিশাল বিভাগে ১২৪, সিলেট বিভাগে ৩২ ও ময়মনসিংহ বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে মোট ৬৮ জন ভর্তি হন।
পিরোজপুরে বৃদ্ধি পাচ্ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা : সারাদেশের মতো পিরোজপুরেও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সংখ্যা। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে পিরোজপুরে ৬৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সনাক্ত করেছেন চিকিৎসকেরা। এদের মধ্যে অনেকেই ভালো হয়ে বাড়িতে ফিরে গেছেন।
বর্তমানে পিরোজপুর জেলা হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে ৯ জন রোগী। সনাক্ত হওয়া রোগীদের অধিকাংশই ঢাকা থেকে আক্রান্ত হয়ে এসেছেন বলে জানিয়েছেন তাদের স্বজন ও চিকিৎসকেরা।
তবে ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে আতঙ্কিত না হয়ে, হাসপাতালে এসে যথাযথভাবে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক। এছাড়া রোগীদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে বলেও জানান তিনি।
এছাড়াও সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে জেলা প্রশাসনসহ সিভিল সার্জনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে।
এখন সারাবছরই এডিস মশা দেখা যাবে : পরিস্থিতি এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে বাংলাদেশে এখন সারাবছরই এডিস মশা দেখা যাবে। এই মুহূর্তে মশা কমানো খুব কঠিন। মানুষ সচেতন না হলে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের হার কমবে না।
শুক্রবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার এসব আশঙ্কার কথা জানান। মশা নিয়ে জাপানের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন তিনি। মশার ওপর বিভিন্ন ধরণের গবেষণাও রয়েছে তার।
কবিরুল বাশার জানান, সিটি করপোরেশনের সঙ্গে পাঁচবছর মেয়াদী মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে। সেটির অনুমোদন পেলে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। পাশাপাশি এডিস মশা চেনার উপায়, কিভাবে ডেঙ্গু জ্বর এড়ানো সম্ভব ইত্যাদি নিয়েও বিস্তারিত আলাপ করেছেন তিনি।
অধ্যাপক বাশার বলেন, এডিস মশা কামড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বোঝার উপায় নেই। ভাইরাসবাহিত এডিস মশা কামড়ানোর ৩/৪দিন পর জ্বর আসে। এর আগে, কোনোভাবেই বোঝার উপায় নেই এডিস মশা কামড় দিয়েছে। এই মুহূর্তে যারা বাসে ট্রেনে লঞ্চে, এমনটি প্লেনে যাচ্ছেন তাদের জন্য ঝুঁকি রয়েছে। কারণ পোকা-মাকড়ের বিস্তার পরিবহনের মাধ্যমেই হয়।
এডিস মশা সাধারণত কখন বেশি কামড় দেয় এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এডিস মশা গভীর অন্ধকার পছন্দ করে না, হালকা আলো পছন্দ করে। যে কারণে দিনেই এডিস মশা বেশি কামড়ায়। রাতের উজ্জ্বল আলোতেও কামড়াতে পারে, তবে ঝুঁকি সারাদিনই বেশি থাকে।
পরিস্থিতি এখন যেমন দাঁড়িয়েছে, তাতে বাংলাদেশে এখন সারাবছরই এডিস মশা দেখা যাবে। এই মুহূর্তে মশা কমানো খুব কঠিন। তবে ডেঙ্গু জ্বর কমতে অক্টোবর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে জনগণ সম্পৃক্ত হলে, সিটি করপোরেশন সক্রিয় থাকলে আগেও কমতে পারে, বলেন এই গবেষক।
মশা নিয়ন্ত্রণ, কমানো বা নিধন করার বিষয়ে অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ড্রেনে কার্পজাতীয় মাছ ছেড়ে কিউলেক্স মশা কমানো যেতে ডারে। তবে এডিস মশা নয় কমানোর জন্য ওষুধ ব্যবহারে টাইম ও ফ্রিকোয়েন্সি প্রয়োজন। প্রতি ৭দিন অন্তর লার্ভিসাইড, ৭ দিন অন্তর অন্তর অ্যাডাল্টিসাইড দিতে হবে। সেখানে এক মাস পর পর দিলে তা কমবে না। একটা নিয়মিত বিরতিতে মশা নিধনের ওষুধ ছিটাতে হবে। মশার জীবন চক্রের ভিত্তিতে ওষুধ ছেটাতে হবে। একটি মশা লার্ভা থেকে পূর্ণাঙ্গ হয়ে বেঁচে থাকার সময় ৭দিন। এর মধ্যেই ওষুধ ছেটাতে হবে।
ঢাকায় মশা এবং ডেঙ্গু ছড়িয়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ১২৩ প্রজাতির মশা রয়েছে। একেকটি মশার চরিত্র একেক রকম। অ্যানোফ্লিক্স মশা ম্যালেরিয়া ছড়ায়। এডিস ছড়ায় ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া কিউলেক্স মশা ছড়ায়। কিউলেক্স মশার সংখ্যাই ঢাকায় সবচেয়ে বেশি। কিউলেক্স ড্রেন-ডোবায় হয়। এডিস মশা হয় জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে, দুটোর চরিত্র আলাদা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিও ভিন্ন। ১৯৫৩ সালের পর এবছরই ফেব্রুয়ারি মাসে এত বৃষ্টিপাত হলো। যার ফলে বছরের শুরুতেই একটা বড় কমিউনিটির এডিস মশার জন্ম হয়েছে। জুন মাস নাগাদ এই এডিস মশার কমিউনিটি আরও বড় হয়ে উঠেছে। এডিস মশার ঘনত্বের মাত্রা ২০ ছাড়িয়ে গেলে এই মশাবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ে। এবার সেটাই হয়েছে এবং সে কারণে ঢাকায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে।
তবে এডিস মশা কামড়ালেই ডেঙ্গু জ্বর হবে তা নয় এমনটা জানিয়ে এই গবেষক বলেন, এডিস মশা ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করলেই তা ডেঙ্গু ছড়াবে। ডেঙ্গুবাহী জীবাণু বহন করে না এমন এডিস মশা কামড়ালেও ডেঙ্গু হবে না।
সাধারণ লোকেরা কিভাবে এডিস মশা চিনতে পারবে জানতে চাইলে কবিরুল বাশার বলেন, বাড়ির আশপাশে জমে থাকা পানিতে ছোট ছোট পোকামাকড় নড়তে থাকলেই বুঝতে হবে সেটি এডিস মশার লার্ভা। এডিস মশার গায়ে ও পায়ে সাদাকালো ডোরাকাটা দাগ থাকে। গায়ে ডোরাকাটা দাগ অন্য মশারও রয়েছে। তবে পায়ে ডোরাকাটা একমাত্র এডিস মশারই।
পায়ে ডোরাকাটা দাগ পেলেই নিঃসন্দেহে বলে দেওয়া যাবে এটি এডিস মশা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, অন্য কোনো মশার পায়ে ডোরাকাটা দাগ থাকে না। মানুষ সচেতন হয়ে একযোগে যদি বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার করে তবেই এটা বন্ধ হবে।
ডেঙ্গুতে আরো ৪ জনের মৃত্যু : ঢাকা ও বরিশালে ডেঙ্গু আক্রান্ত চার রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে ঢাকায় ৩জন ও বরিশালে ১ জন।
জানা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজে (ঢামেক) বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে রিফাত (১০) নামে এক শিশু মারা যায়। এ নিয়ে ঢামেকে ডেঙ্গু রোগে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২ জনে।
রিফাতের বাবার নাম খোরশেদ, বাড়ি জামালপুর। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, প্রবল জ্বরে আক্রান্ত রিফাতকে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা রাতে ঢামেকে ভর্তি করা হয়। রাত সাড়ে ১২টায় সে মারা যায়। স্বজনরা তার লাশ নিয়ে গেছেন।
এদিকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে (শেবাচিম) হাসপাতালে মজিবর রহমান (৫৫) নামে ডেঙ্গু আক্রান্ত এক রোগী মারা গেছেন। তিনি বরগুনা রাইফেলস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক।
শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন হাসপাতালের পরিচালক ডা. বাকির হোসেন।
তিনি জানান, মজিবর রহমান বরগুনা থেকে ডেঙ্গু ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে মুমূর্ষু অবস্থায় শেবাচিম হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে, রাত ২টার দিকে তার মৃত্যু হয়। এ নিয়ে এ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত মোট তিনজনের মৃত্যু হলো।
এছাড়াও ডেঙ্গুতে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে সাউথ পয়েন্ট স্কুল এন্ড কলেজের ছাত্র মেহরাব হোসেন ও বাড্ডায় রুবেল নামের এক ব্যক্তির মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে।
স্থাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডেঙ্গুতে মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩৪ হাজার ৬৬৬ জন। চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২৫ হাজার ৭৮২ জন। বর্তমানে দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ভর্তি থাকা রোগীর সংখ্যা ৮ হাজার ৭৬৫ জন। এরমধ্যে রাজধানীর সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ৫ হাজার ১৪০ জন। রাজধানীর বাইরে সারাদেশে ভর্তি থাকা রোগীর সংখ্যা তিন হাজার ৬২৫ জন।