বিশেষ প্রতিবেদক : এক সময় বলা হতো দেখতে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট। বদলে গেছে সদরঘাটের সেই পরিচিত নামটি। সাবেক নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের আমলেই বদলে গিয়েছিল ঢাকা নদীবন্দরের সেই দূর্নামটি। তিনি প্রায় সময়ই গর্ব করে বলতেন দেখতে হলে ফিটফাট চলে আসুন সদরঘাট। আচমকা দেখলে মনে প্রশ্ন জাগবে এটি কি ঢাকার সদরঘাট, না অন্য কোনও স্থান? এই বদলের মূল কারণ, চিরচেনা সদরঘাটে এখন আর নেই হকারদের উৎপাত। নেই ফেরিওয়ালাদের দৌরাত্ম্য। সদরঘাটের বিআইডব্লিউটিএ ভবনের পাশে গড়ে ওঠা পাকা, সেমিপাকা দোকানগুলোও ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেখানে করা হয়েছে বাগান। সদরঘাটের ত্রিসীমানার কোথাও নেই ভাসমান কোনও দোকান। বুড়িগঙ্গা নদীও এখন ঝামেলামুক্ত। নৌকায় করে পাউরুটি, আনারস আর ফল বিক্রেতাদের ভাসমান দোকানও নেই। ভাসমান এসব দোকান একসময় লঞ্চগুলোকে ঘিরে রাখতো। মাইকিং করে এসব ভাসমান দোকানে পণ্য বিক্রি হতো।
শুধু তা-ই নয়, সকালে লঞ্চ থেকে নেমে সদরঘাট থেকে বের হলেই দেখা যেতো টঙ্গী, মিরপুর, গাজীপুর, চিটাগাং রোডগামী বাস ঘাটের প্রবেশপথের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। আর এতে তৈরি হওয়া যানজটে সবকিছু থমকে থাকতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। যাত্রী পৌঁছে দিতে বা নিতে আসা নিজস্ব পরিবহন কোনোভাবেই ঘাট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারতো না। এমন পরিস্থিতিতে যাত্রীর ব্যাগ হারিয়ে যাওয়া, পকেটমারি হওয়া, ভিড়ে নিকটজনকে হারিয়ে ফেলার ঘটনাও ঘটতো অহরহ। সদরঘাটের এই দৃশ্যপটও বদলে গেছে। এসব বাস এখন আর দেখা যায় না। বর্তমানে সদরঘাটের সামনের রাস্তায় যতদূর চোখ যায় সবকিছু পরিষ্কার। দূরে কোনও নিকটজন দাঁড়িয়ে থাকলেও চেনা যায় সহজে। রিকশা, সিএনজি এমনকি নিজস্ব গাড়িগুলো এসে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যাত্রী নামিয়ে বা উঠিয়ে সর্বোচ্চ ২/১ মিনিটের মধ্যেই ঘাট এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। নেই কোনও জটলা।
জানা গেছে, মাত্র কিছু দিনের ব্যবধানে সদরঘাটে এ পরিবর্তন হয়েছে। বিভিন্ন মহল থেকে সদরঘাট সম্পর্কে নানা ধরনের অভিযোগ প্রাপ্তি এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে সদরঘাটের এসব অনিয়ম নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সদরঘাট পরিদর্শন করেন। নিজের চোখে দেখেন সেখানকার অনিয়ম ও বিআইডব্লিউটিএ’র গুটিকয়েক কর্মচারীর নৈরাজ্য। এরপরই তিনি সিদ্ধান্ত দেন সদরঘাটকে যাত্রীবান্ধব করতে হবে। তার নির্দেশে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তাদের নিরলস পরিশ্রমে আজকের সদরঘাটের পুরনো দৃশ্যপট বদলে গেছে বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম খান।
ভেতরে বাইরে কোথাও হকার নেই। দোকানপাটও নেই। নেই কোনও ফল বা পানির দোকান। তবে সদরঘাটের সামনের সড়কের অপরপ্রান্তে ১৫ ফুট প্রস্থের ফুটপাত দখল করে স্থায়ী যেসব দোকান বানানো হয়েছে, তা এখনও রয়েছে। সেখানে ফুটপাত বলতে যেটুকু অবশিষ্ট আছে তার প্রস্থ হবে ২ থেকে ৩ ফুট। বাকিটায় গড়ে উঠেছে অস্থায়ী ইমারত। আর সেখানেই চলছে হকারদের বাণিজ্য।
পিরোজপুর থেকে আসা জাকারিয়া হোসেন জানান, ২৫ বছর ধরে সদরঘাট হয়ে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি আবার কর্মস্থল রাজধানীতে এসেছি। কিন্তু এবার দেখে মনে হচ্ছে অন্য কোনও দেশের ঘাট। চিরচেনা সদরঘাটের এমন পরিবর্তন যে সম্ভব, তা চোখে না দেখলে কাউকে বোঝানো যাবে না। সদরঘাটে হকার থাকবে না, জঞ্জাল থাকবে না, ভেতরের দোকানপাট তুলে দেওয়া হবে তা কল্পনায়ও ভাবিনি। যাত্রী হিসেবে সরকারের এ পদক্ষেপে আমরা খুশি। তিনি জানান, সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হচ্ছে সদরঘাটের সামনের রাস্তাটি এখন পুরোপুরি ফাঁকা, যেকোনও ধরনের জঞ্জাল বা যানজটমুক্ত। ঈদের সময় বাসস্ট্যান্ড (ভিক্টোরিয়া পার্ক) ছেড়ে বিভিন্ন রুটের বাস সদরঘাটের সামনে এসে অসহনীয় যানজট তৈরি করে। এবার সেটা দেখছি না। এখন দেখার বিষয় এ পরিবেশ কতদিন থাকে।
এ প্রসঙ্গে বিআইডব্লিউটিএ’র যুগ্ম পরিচালক আরিফ হোসেন জানিয়েছেন, আশা করছি কয়েক দিনের মধ্যে ১৫ ফুট প্রস্থের ফুটপাতটিও পথচারীদের জন্য উন্মুক্ত করা যাবে। স্থাপত্য নিদর্শন আহসান মঞ্জিলের সামনের রাস্তাটিও জঞ্জালমুক্ত করা হবে। সেখানে এখন হাজার হাজার টন ময়লা আবর্জনার স্তূপ পড়ে আছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ আবর্জনা থেকে আহসান মঞ্জিলকে মুক্ত রাখতে টিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে রেখেছেন। তিনি জানান, সদরঘাট কেন্দ্রিক একটি বড় সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে নানা অনিয়ম করে এসেছে। এসব অনিয়ম দূর করতে গিয়ে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছি, এখনও হচ্ছি। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের ওপর মহলের সহযোগিতা ও সমর্থন আমাদের কাজকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। আশা করছি সদরঘাটের চিরচেনা চেহারা প্রতিদিন বদলাবে।
এ প্রসঙ্গে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জানিয়েছেন, সদরঘাট হবে যাত্রীবান্ধব। এর জন্য যা প্রয়োজন তা-ই করা হবে। আর যে পরিবর্তন দেখেছেন তা সম্ভব হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরলস পরিশ্রমের কারণে। আশা করছি সদরঘাট হবে সাধারণ মানুষের কাছে দর্শনীয় স্থান। আমরা সেভাবেই গড়ে তোলার জন্য কাজ করছি।
এই পরিবর্তন সম্পর্কে বাংলাদেশ লঞ্চ মালিক সমিতির সহ-সভাপতি ও পারাবাত লঞ্চের মালিক শহীদুল ইসলাম ভূইয়া বলেন, আগের যেকোনও সময়ের তুলনায় সদরঘাটের পরিবেশ এখন অনেক ভালো এবং উন্নত। এমন সদরঘাটই তো আমরা চেয়েছি। ঘাটে শৃঙ্খলা ফেরায় যাত্রীরাও খুশি। সরকার লঞ্চ মালিকদের কাছে যে সহযোগিতা চাইবে আমরা তা দেবো।