জিরো টলারেন্স নীতিতে কঠোর প্রধানমন্ত্রী
মহসীন আহমেদ স্বপন : দলের বিশৃঙ্খলা ও প্রশাসনের নানা দুর্নীতি রোধে আরও কঠোর হচ্ছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুর্নীতি, অপরাধের বিরুদ্ধে তার সরকারের জিরো টলারেন্স নীতিতে টালমাটাল অনেকেই। বিশেষ করে ছাত্রলীগ, যুবলীগের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার অ্যাকশনের পর আতঙ্কে আছেন সরকার দলীয় নেতা-কর্মী ও এমপি, মন্ত্রীরা।
বালিশ দুর্নীতি, পর্দা দুর্নীতি, নুসরাত হত্যাকা-, রিফাত হত্যাকা-সহ নানা ইস্যুতে সরকারের ইমেজ যখন প্রশ্নবিদ্ধ তখন দলের মধ্যে চালানো শুদ্ধি অভিযানকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। তারা বলেন, টানা তিন মেয়াদে দল ক্ষমতায় থাকায় অনেক অনুপ্রবেশকারী যেমন দলে ভিড়েছেন, তেমনি অনেকে অবৈধপথে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। দলের প্রয়োজনেই এদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান প্রয়োজন ছিল। প্রধানমন্ত্রী জিরো টলারেন্স নীতির কারণে ইমেজ বেড়েছে আওয়ামী লীগের।
এ দিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন অপকর্ম, দুর্নীতি ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে ছাত্রলীগ, যুবলীগের পর আওয়ামী লীগের অনেকেই নজরদারিতে আছেন। সঠিক সময়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও হুঁশিয়ার দেন তিনি। শুক্রবার সকালে রাজধানীর ধানম-িতে দলীয় সভাপতির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, অপকর্ম করলে দলের লোকদেরও ছাড় দিচ্ছেন না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কাদের বলেন, দল ও সরকারের ভাবমূর্তি যারা ক্ষুণ্ন করছে তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী অপকর্মের ব্যাপারে দলীয় কর্মীদেরও কোনো ছাড় দিচ্ছেন না। বিএনপি এটা পারেনি বলে বিষোদগার করছে।
সম্প্রতি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশে দেশের অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রক, মাফিয়া, গডফাদারদের বিরুদ্ধে ‘অ্যাকশনে’ নেমেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। সেই অ্যাকশনে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া র্যাবের হাতে আটক হয়েছে। খালেদের আটকের পর মানুষ রাজধানীতে অবৈধ ক্যাসিনো সাম্রাজ্য, বিত্তবৈভবের চিত্র দেখতে পেয়েছেন।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, অপরাধ করলে ছাড় নেই, সে যে দলেরই হোক না কেন- শেখ হাসিনার এই স্পষ্ট ম্যাসেজ পোঁছে দেওয়া হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। চলমান শুদ্ধি অভিযানের আগে গ্রাউন্ড ওয়ার্কটাও সেড়ে নেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর কাছে অন্যতম অভিযোগ ছিল ঢাকায় অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িয়েছেন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতারা। বিপুল টাকা পাচার হচ্ছে বিদেশে। এমনকি খুনোখুনিতে লিপ্ত হয়েছেন। মে থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রাপ্ত বিভিন্ন অভিযোগেরও সত্যতা নানা সোর্স থেকে যাচাই করেন। কিছু অভিযোগের সত্যতাও পান। এরপর আগস্ট মাস পর্যন্ত অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। শোকের মাস শেষ হলে অ্যাকশনে নামার নির্দেশ দেন তিনি।
দলীয় শুদ্ধি অভিযানের শুরুটা হয় আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে দিয়ে। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সন্তানের মতো স্নেহ করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। ছাত্রলীগকে ইতিবাচক ধারায় ফেরাতো বিগত সম্মেলনে তিনি অনেক যাচাই বাছাইয়ের পর ছাত্রলীগের দায়িত্ব তুলে দেন শোভন-রাব্বানীর হাতে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বাস ভেঙে বিভিন্ন অনিয়মে জড়ান তারা। বিশেষ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠায় দু’জনকেই পদ থেকে সড়িয়ে দেন শেখ হাসিনা।
শোভন-রাব্বানীর ঔদ্ধত্যকে মনস্টার তথা দৈত্যের সঙ্গেও তুলনা করেন তিনি। ছাত্রলীগের ৭২ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম সভাপতি সেক্রেটারিকে একসঙ্গে অপসারণ করা হল।
অন্যদিকে, যুবলীগ নেতাদের নিয়েও একগাদা অভিযোগ ছিল প্রধানমন্ত্রীর টেবিলে। এক বৈঠকে যুবলীগ নেতাদের নিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এরা শোভন-রাব্বানীর চেয়েও খারাপ।
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াসহ ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ, তাঁতি লীগ, কৃষকলীগে কমপক্ষে ২০০ নেতা-কর্মীর নামের তালিকা আছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। যারা ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। রাজনীতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তারা অন্যায়, দুর্নীতি, অনিয়মের মধ্যদিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। সরকারের ইমেজকে মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে তারা।
এমনকি চাঁদাবাজির টাকায় ঘটা করে শেখ হাসিনার জন্মদিন পালনে মাসব্যাপী কর্মসূচি পালন নিয়েও যুবলীগের ওপর ক্ষুব্ধ হন আওয়ামী লীগ সভাপতি। দলের কার্য নির্বাহী সংসদের বৈঠকে সে ক্ষোভের কিছুটা তিনি প্রকাশও করেন। এরপরই যুবলীগের বিরুদ্ধে প্রশাসনের অভিযান শুরু হয়।
গণভবন সূত্রে জানা গেছে, বুধবার রাজধানীতে যুবলীগ নেতাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা অবৈধ ক্যাসিনোগুলোতে র্যাবের অভিযান গুরুত্ব দিয়ে মনিটর করেছেন সরকারপ্রধান। সেই সঙ্গে পরবর্তী নির্দেশনাও পৌঁছে দিয়েছেন সংশ্লিষ্টদের কাছে। ক্যাসিনোতে কাজ করা বিদেশিদের যারা দেশে এনেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর শুক্রবার রাজধানীর নিকেতনের অফিস থেকে ৬ দেহরক্ষীসহ যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমকে আটক করেছে র্যাব। দেহরক্ষীদের মধ্যে প্রধান দেহরক্ষী শহীদুল মুরাদ কামাল ও জাহিদের পরিচয় পাওয়া গেছে। নিকেতন ৪ নম্বর রোডের ১১৪ নম্বর ভবনে জিকেবি কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড শামীমের বাণিজ্যিক কার্যালয়। জিকে শামীম যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায় বিষয়ক সম্পাদক।
ক্যাসিনোর সঙ্গে যারা জড়িত বিদেশি, তারা আসলো কিভাবে, তারা ভিসা পেল কিভাবে, তাদের বেতন দেওয়া হয় কিভাবে, ক্রেডিট কার্ডে না ক্যাশে। কে ভিসা দিয়ে আনলো সমস্ত কিছু তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
অনেকটা হুট করেই মাথার ওপর থেকে শেখ হাসিনার আশীর্বাদর ছায়া সরে যাওয়ায় দুর্নীতি, অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। এ যাত্রায় নিজেদের বাঁচাতে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কাছে তদবির করছেন তারা। কিন্তু ততটা ভরসা পাচ্ছেন না। এতদিন যাদেরকে নিয়মিত মাসোহারা পৌঁছে দিতেন প্রশাসনের তারাও এখন দূরত্ব বজায় রাখছেন।
এদিকে চলমান শুদ্ধি অভিযান আরও জোরদার করার ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার গণভবনে তিনি বলেন, ছাত্রলীগ যুবলীগকে ধরেছি। একে একে সব ধরব। সামাজিক যেসব অসঙ্গতি এগুলো দূর করতে হবে। এই ক্যাসিনো নিয়ে মারামারি খুনোখুনি টলারেট করব না।
তিনি আরও বলেন, আমি কষ্ট করে সব কিছু করছি দেশের জন্য, দেশের উন্নয়ন করছি, এর ওপর কালিমা আসুক সেটা আমি কোনোভাবে হতে দেব না। আমি কাউকেই ছাড়ব না। যদি কেউ বাধা দেয় তাকেও ছাড়া হবে না।