যুবলীগ নেতাদের ক্যাসিনো বাণিজ্য

অপরাধ আইন ও আদালত এইমাত্র জাতীয় রাজধানী

নজরদারিতে সম্রাট
আতঙ্কে মদদ দাতারা
মুখ খুলছেন খালেদ-শামীম-ফিরোজ
কেউ পার পাবেন না : ওবায়দুল কাদের
চুনোপুটি-রাঘববোয়াল, কাউকেই ছাড় নয় : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

মহসীন আহমেদ স্বপন : দেশজুড়ে বিভিন্ন ক্লাবে পুলিশি অভিযান চলার কারণে বন্ধ করা হচ্ছে জুয়ার আসরগুলো। গত বুধবার গ্রেফতার হয়েছেন ফকিরাপুলের ইয়াংমেনস ক্লাবের মালিক ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। সেই ক্লাবে ২৪ ঘণ্টাই চলত রমরমা ক্যাসিনোবাণিজ্য। তারই ধারাবাহিকতায় গত রোববার রাজধানীর মতিঝিলে ক্লাবপাড়ায় মোহামেডান ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, দিলকুশা স্পোটিং ক্লাব ও ভিক্টোরিয়া ক্লাবে অভিযান চালায় পুলিশ। এসব অভিযানে বেরিয়ে আসছে একের পর এক ক্যাসিনো ব্যবসায়ীদের নাম ও পরিচয়।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ফকিরাপুলের ইয়াংমেনস ক্লাবটি ছাড়াও মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় মোহামেডান, আরামবাগ, দিলকুশা, ওয়ান্ডারার্স, ভিক্টোরিয়ায় ক্যাসিনো ছিল। এর মধ্যে ইয়াংমেনস ক্লাবে ক্যাসিনো চালাতেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। বাকি পাঁচটি ক্লাবে ক্যাসিনো চালাতেন ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট। তবে সম্রাট নিজে সরাসরি ক্যাসিনো দেখাশোনা করতেন না। এসব ক্যাসিনো পরিচালনায় সাত যুবলীগ নেতার নাম এসেছে।
এই সাতজনের দুজন এসেছেন ফ্রিডম পার্টি থেকে, দুজন বিএনপি থেকে, একজন জাতীয় পার্টির এবং একজন ছিলেন হোটেল বয়। তবে সাতজনের মধ্যে একজনই শুরু থেকে যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বাকি ছয়জনই যুবলীগে অনুপ্রবেশকারী।
তারা হলেন- যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, সহসভাপতি এনামুল হক আরমান, সহসভাপতি সোহরাব হোসেন স্বপন, সহসভাপতি সরোয়ার হোসেন মনা, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোমিনুল হক সাঈদ, সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া ও নির্বাহী সদস্য জাকির হোসেন।
তাদের হাত ধরেই মতিঝিলের ক্লাবপাড়াসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ক্যাসিনোবাণিজ্য ছড়িয়ে পড়ে।
ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি সম্রাটকে এখন ক্যাসিনো সম্রাট বলা হচ্ছে। ১৯৯১ সালে যুবলীগে নাম লেখান সম্রাট। নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন যুবলীগ মহানগর কমিটির সাবেক সভাপতি থাকাকালীন সম্রাট যুবলীগ মহানগর কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক হন। পরে ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি হন তিনি। রাজউকে বাবার চাকরিসূত্রে কাকরাইলের সার্কিট হাউস সড়কের সরকারি কোয়ার্টারে থাকতেন সম্রাট। সে সময় তার চাচাতো ভাই শরীফ সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হলে রাজনীতির মাঠে সম্রাটের পরিচিতি বেড়ে যায়। সেখান থেকেই সম্রাটের উত্থান।
রাজধানীতে ক্লাব বিজনেসের আড়াতে অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনার অভিযোগে যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাটেকে গ্রেফতার প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এ (দুর্নীতি ও মাদকবিরোধী) অভিযান শুরু হলো এক সপ্তাহ হলো। এই সময়ের মধ্যে কি সবাই গ্রেফতার হবেন? যাদের নাম আসছে পর্যায়ক্রমে সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। মঙ্গলবার সচিবালয়ে সমসাময়িক ইস্যুতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
ওবায়দুল কাদের বলেন, সবকিছু তো যাচাই-বাছাই করতে হবে। আর যারা গ্রেফতার হয়েছেন এবং যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তারা কি কম অপরাধী? তাদের ক্রিমিনাল অফেন্স (ফৌজদারি অপরাধ) কি সাধারণ কোনো অপরাধ? কাজেই এখানে কেউ পার পাবেন না। আমি এটা বলতে পারি, কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। যারা গা-ঢাকা দিয়েছে তাদের রেহাই নেই হুশিয়ার করে ওবায়দুল কাদের বলেন, অভিযান মাত্র শুরু হয়েছে। কিছু কিছু বিষয় আছে যা সরকার ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো দেখছে এবং খোঁজ খবর নিচ্ছে। আবার অনেকে তো গা-ঢাকা দিয়েছেন, তাদের খুঁজে বের করতে হবে। তাদের অনেককে নজরদারিতে রাখা হয়েছে এবং যারা নিজেদের আড়াল করে রেখেছে, তাদের খোঁজা হচ্ছে, কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
যুবলীগের আলোচিত নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট গা-ঢাকা দিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে ওবায়দুল কাদের বলেন, আমি জানি না কে কে গা-ঢাকা দিয়েছেন। আমি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। তারা গা-ঢাকা দেয়াদের খুঁজছেন। যারা গা-ঢাকা দিয়েছেন তারা কোথায় যাবেন?
চুনোপুটি-রাঘববোয়াল, কাউকেই ছাড় নয় : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, অপরাধীরা কে কোথায় আছে সেটি বড় কথা নয়, বড় কথা হলো কে কতটুকু অপরাধ করেছে। চুনোপুটি-রাঘববোয়াল বলতে কিছু বুঝি না। যারা অপরাধ করবে তারেদকেই শাস্তি পেতে হবে। অপরাধে জড়িত হওয়ায় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যকেও ছাড় দেওয়া হয়নি। তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
বিভিন্ন অপরাধে রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার ও ঢাকা শহরের ক্যাসিনোগুলোয় অভিযানের ফলে অপরাধীরা দেশের বাইরে চলে যেতে পারেন, এ জন্য কোনো সতর্কতা জারি করা হয়েছে কি না- জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রেড অ্যালার্ট জারি করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি।
বিমানবন্দরেও বিশেষ কোনো সতর্কতা জারি করা হয়নি বলে জানান তিনি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, অবৈধ ব্যবসা ও টেন্ডারবাজির মতো অপকর্মের বিরুদ্ধে সরকারের এই অভিযান চলছে। যেখান থেকেই তথ্য আসছে সেই তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। গডফাদার বা গ্র্যান্ডফাদার বলতে আমরা কাউকে চিনি না। অপরাধ যে করবে তাকেই শাস্তি পেতে হবে।
অন্যদিকে রিমান্ডে মুখ খুলতে শুরু করেছেন গ্রেফতারকৃত যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, এস এম গোলাম কিবরিয়া ওরফে জিকে শামীম ও কৃষক লীগ নেতা কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজ। আর অবৈধভাবে ক্যাসিনো ও জুয়ার বোর্ড পরিচালনার অভিযোগে এখনো পুলিশের নজরদারিতে রয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। যুবলীগ নেতা খালেদ ও জিকে শামীমকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। অপরদিকে ফিরোজকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ধানমন্ডি থানা পুলিশ। মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, যুবলীগ নেতা খালেদ ও জিকে শামীম রিমান্ডের প্রথম দিন নিজেদেরকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করার চেষ্টা করেছিলেন। পরবর্তীতে তথ্য প্রমাণ তাদের সামনে উপস্থাপন করা হলে তারা নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে নেন। ঐ দুই নেতা জানিয়েছেন, তাদের অবৈধ কর্মকা-ের পেছনে রয়েছেন প্রভাবশালী নেতারা। তাদের আশ্রয় প্রশ্রয়েই তারা নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারিত করেছেন।
মামলা সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ওরা যাদের নাম বলেছেন, তাদের নাম দেখে তারা নিজেরাই বিস্মিত হয়েছেন। সবার কাছে এসব নেতাদের একটা ক্লিন ইমেজ আছে। অথচ এরাই খালেদ ও শামীমকে পরেক্ষাভাবে সহায়তা করেছেন। বিনিময়ে পেয়েছেন মোটা অংকের টাকা। ঐ কর্মকর্তা বলেন, রাজধানীতে ক্যাসিনো এবং চাঁদাবাজি যারা নিয়ন্ত্রণ করত, তাদের অনেক নামই গ্রেফতারকৃতরা প্রকাশ করেছেন। পর্যায়ক্রমে তাদেরকে গ্রেফতার করা হবে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, আসামিরা অন্য পাঁচটি মামলার মত আসামি না। ফলে এদের দেওয়া তথ্যগুলো যেমন পর্যাপ্ত যাচাইয়ের প্রয়োজন রয়েছে, তেমনি যাদের নাম বলেছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে গেলে আরো কিছু কর্মপদ্ধতি ঠিক করতে হবে।
কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজের ব্যাপারে ধানমন্ডি থানার ওসি আব্দুল লতিফ বলেন, শফিকুল আলম ফিরোজ থানায় রয়েছেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তিনি এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট ধানমন্ডির থানা পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ফিরোজ জানিয়েছেন, জুয়ার সাথে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। ক্লাবের সভাপতি হিসেবে জুয়ার টেবিল তিনি ভাড়া দিয়েছেন।
তিনি জানান, কলাবাগান ক্লাবের রামির টেবিল চালাতেন সাদেক নামে একজন। তাকে সহযোগিতা করতেন সাজু। এক পর্যায়ে তার কাছে সাদেকের ঠিকানা চাওয়া হয়। এসময় ফিরোজ জানান, সাদেক ধানমন্ডি থাকেন। তবে বাসার ঠিকানা তিনি জানেন না বলে জানান।
পুলিশ কর্মকর্তারা সাদেকের মোবাইল নম্বর চাইলে ফিরোজ তা সরবরাহ করেন। ক্যাসিনো সম্পর্কে ফিরোজ জানান, সেখানে প্রতিদিন বাকারা খেলা হতো। কিন্তু এখন সেটা চলে না। ভাড়া বাকি থাকায় কারবারিদের বিদায় করে দেওয়া হয়েছে। ভাড়া বাকি থাকায় তাদের জিনিসপত্র এখনো ক্লাবে রয়ে গেছে।
গুলশান থানায় অস্ত্র ও মাদক আইনে দায়ের করা দুই মামলায় গত বুধবার পুলিশ সাত দিনের রিমান্ডে নেয় খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে। অপরদিকে গত শনিবার জি কে শামীমকে অস্ত্র ও মাদক আইনের মামলায় ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। একই দিন ধানমন্ডি থানায় দায়ের করা অস্ত্র ও মাদক মামলায় পুলিশ ১০ রিমান্ডে নিয়েছে কৃষক লীগ নেতা ও কলাবাগান ক্রীড়াচক্র ক্লাবের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজকে।
সম্রাট নজরদারিতে: সূত্র জানিয়েছে, গ্রেফতারকৃত আসামি এবং প্রাপ্ত তথ্য মতে ঢাকায় অবৈধভাবে ক্যাসিনো ও জুয়ার বোর্ড পরিচালনার অভিযোগে এখনো পুলিশের নজরদারিতে রয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। যে কোনো সময় তাকে গ্রেফতার করা হতে পারে। তবে কোনো অবস্থায় সম্রাট ও তার সহযোগিতারা যাতে দেশত্যাগ না করতে পরে সে ব্যাপারে দেশের সব বিমান বন্দর ও সীমান্তে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্তক থাকতে বলা হয়েছে।
ক্যাসিনোর সরঞ্জাম বিমান বন্দরে পার করে দিতেন শীর্ষ কাস্টমসর গোয়েন্দা কর্মকর্তা: জুয়ার বোর্ডসহ ক্যাসিনোর প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম গত কয়েক বছরে দেশে প্রবেশ করেছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর দিয়ে। ক্যাসিনোর সরঞ্জাম যাতে নির্বিঘেœ বের হতে পারে তা তদারকি করতেন কাস্টমসের গোয়েন্দা শাখার এক শীর্ষ কর্মকর্তা। তার নির্দেশেই বিমান বন্দরের এক শ্রেণির কর্মকর্তা ক্যাসিনোর সরঞ্জাম বিমানবন্দর পার করে দিয়েছে। বিষয়টি গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করছে।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *