অনুপ্রবেশকারীর তালিকা প্রকাশ
মহসীন আহমেদ স্বপন
টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে দলকে সুসংগঠিত ও হাইব্রিডমুক্ত করতে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা প্রকাশ করেছে দলটি। বিগত সময়ে অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা করতে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের বার বার তাগাদা দিয়েও কাজ হয়নি। পরে বাধ্য হয়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও নিজস্ব টিমের তত্ত্বাবধানে দলে অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা প্রস্তুত করে তা প্রকাশ করেছে। স্বাধীনতা বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থি, নানা ধরণের অপরাধ মুলক কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত অসাধু, সুবিধাবাদী প্রকৃতির অন্তত সহা¯্রাধিক নেতা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন অঙ্গসহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন ইউনিটের কমিটিতে স্থান করে নিয়েছেন।
প্রায় ৫ হাজার অনুপ্রবেশকারী ও বিতর্কিত নেতার তালিকা হওয়ায় বেশ শঙ্কায় আছেন অনেক নেতা। কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূলের এসব নেতা নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন।
তালিকায় কারা আছেন, তাদের ভবিষ্যৎ কী, আগামী কমিটিতে থাকতে পারবেন কিনা, তাদের বিরুদ্ধে কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা, প্রাথমিক সদস্যপদ থাকবে কিনা- এসব জানতে দলটির নীতিনির্ধারকদের কাছে ছুটছেন সংশ্লিষ্ট নেতারা।
আর যারা তালিকাভুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন- তারা নিজেদের নাম বাদ দিতে চালাচ্ছেন নানা তৎপরতা। তবে তাদের এসব চেষ্টা পুরোপুরি নিষ্ফল হবে বলে মন্তব্য করেছেন দলটির একাধিক শীর্ষ নেতা। তারা জানান, এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে হাইকমান্ড। এমনকি তালিকায় যাদের নাম এসেছে, তাদের কেউ প্রভাবশালী নেতা হলেও ক্ষমা নেই।
নীতিনির্ধারকরা আরও জানান, তালিকাভুক্ত পাঁচ হাজার নেতার মধ্যে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী রয়েছেন দেড় হাজার এবং বিতর্কিত দুই হাজার নেতা। এছাড়া সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনে অনুপ্রবেশকারী ও বিতর্কিত নেতার সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। এসব নামের তালিকা এখন ৮ বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের হাতে।
বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দলটির সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুপ্রবেশকারী ও বিতর্কিত নেতাদের তালিকা তৈরি করেছেন। তালিকাভুক্ত নেতারা নতুন কোনো কমিটিতে পদ পাবেন না। পাশাপাশি নিষিদ্ধ থাকছেন জাতীয় ও তৃণমূল কাউন্সিলে। চলতি মাস থেকে এসব পদক্ষেপ কার্যকর হচ্ছে।
আরও জানা গেছে, যেসব বিষয় বিবেচনা করে অনুপ্রবেশকারী ও বিতর্কিতদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- বিএনপি-জামায়াত-শিবির থেকে যারা এসেছেন, চিহ্নিত টেন্ডার, চাঁদাবাজ, মাদক ব্যবসায়ী ও ভূমিদস্যু, যাদের ভাবমূর্তির সংকট আছে, নেতিবাচক রাজনীতির জন্য যারা জনবিচ্ছিন্ন এবং খুন-ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত।
গণভবন সূত্রে জানা গেছে, মূল দল এবং অঙ্গ-সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর অনেক স্থানেই অনুপ্রবেশকারীরা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে উঠলে তাদের বিষয়ে দলীয়ভাবে এবং একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে খোঁজ নেন খোদ আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপরই তালিকা তৈরি করা হয়।
জানা গেছে, দীর্ঘ ছয় মাস ধরে কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব টিম এই অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা তৈরি করে। বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের সম্পাদকম-লীর বৈঠকে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। দলের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের হাতে তালিকা দিতে নিদের্শ দেন।
আওয়ামী লীগের কোনো কমিটিতেই যেন বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারীরা স্থান না পায় সেজন্য তালিকা করা হয়েছে। তালিকাটি কেন্দ্র থেকে শুরু করে জেলায় জেলায় নেতাদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
জানা যায়, ২০০৮ সালের পর শুরু হয় আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ। এর ধারাবাহিকতায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এর সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। একইভাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগে যোগদানের হিড়িক পড়ে। এর অধিকাংশই ছিল বিএনপি-জামায়াত-শিবির ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির লোকজন। অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও এমপি-মন্ত্রীর হাত ধরে এই অনুপ্রবেশ ঘটে।
এই ব্যাপারে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ বলেছেন, বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের একাধিক সহযোগী সংগঠন ও আওয়ামী লীগে অন্তত এক হাজার নেতাকর্মী বিভিন্ন দল থেকে আওয়ামী লীগের অনুপ্রবেশ করেছে। যারা মূলত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। এরা আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করে নানা ধরণের অপরাধ মুলক কর্মকান্ড করেছে। এই কারণে দলের ভাবমুতি ক্ষুন্ন হয়েছে। তাই এই এক হাজার অনুপ্রকেশকারী নেতাদের দল থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনুপ্রবেশকারী নেতাদের চিন্থিত করা হয়েছে।
চলচি মাসে শুলু হওয়া আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের সম্মেলনেও তারা অংশ নিতে পারবে না। এই বার্তা ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সহযোগী সংগঠন গুলোর নেতাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে। অনুপ্রবেশকারী নেতারা কোনো ভাবে যাতে কাউন্সিলর ডেলিগেট হতে না পারে সে দিকেও নজর রাখা হচ্ছে।
উল্লেখ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে নিজের দলে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন। বিভিন্ন ধরণের অপরাধ ও অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি মূলক ব্যাবস্থা নেয়া হচ্ছে। বাদ পড়ছেন না এমপি ও প্রভাবাশালী নেতারাও। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর এই উদ্যোগ ইতিমধ্যে দেশে বিদশে প্রসংশিত হয়েছে।