নিজস্ব প্রতিনিধি : পিবিআই মানিকগঞ্জ জেলার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ১৬ (ষোল) ঘন্টা একটানা দুটি সেলো মেশিনের সাহায্যে খালের পানি সেচে নিহত ভিকটিম আব্দুর রহিম মিয়া (৪২) হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত বিভিন্ন আলামত উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী মোঃ বিল্লাল হোসেন সহ ৩ জনকে।
গত ০৫/০৬/২০২৩, রাত অনুমান ৮ টার সময় আব্দুর রহিম মিয়া (৪২), পিতা-মৃত খবির উদ্দিন, মাতা-জুলেখা বেগম, গ্রাম-কাকনা থানা-দেীলতপুর, জেলা-মানিকগঞ্জ কাকনা বাজার থেকে নিজ বাড়িতে ফিরে না আসলে অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাকে না পেয়ে গত ০৭/০৬/২০২৩ খ্রিঃ তারিখে তার পরিবার এ সংক্রান্তে একটি নিখোঁজ জিডি করেন যা দৌলতপুর থানার জিডি নং-৪৬৬, তাং-০৭/০৬/২০২৩ ।
একই তারিখ বিকাল অনুমান ৫ টার সময় কাকনা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠ ও আশপাশ এলাকায় দূর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় লোকজন উক্ত বিদ্যালয়ের পিছনের খালের আশেপাশে খোাঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে বিদ্যালয়ের প্রাচীর দেওয়ালের পশ্চিম পাশের্^ বাঁশঝাড় সংলগ্ন খালের পাড়ে নিখোঁজ আব্দুর রহিম মিয়া (৪২) এর লাশ সনাক্ত হয়।
পরবর্তীতে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দৌলতপুর থানা পুলিশকে অবহিত করলে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করে। অতঃপর উপরোক্ত ঘটনায় নিখোঁজ ব্যক্তির সহোদর মেঝোভাই মোঃ মিন্টু মিয়া অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মানিকগঞ্জ জেলার দৌলতপুর থানার মামলা নং-০৩, তারিখ-০৮/০৬/২০২৩ ধারা-৩০২/২০১/৩৪ পেনাল কোড দায়ের করেন।
অ্যাডিশনাল আইজিপি পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার. বিপিএম (বার), পিপিএম এর সঠিক তত্ত্বাবধান ও দিক নির্দেশনায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, পিবিআই, মানিকগঞ্জ জেলা এম, কে, এইচ, জাহাঙ্গীর হোসেন পিপিএম এর সার্বিক সহযোগিতায় মামলাটির পিবিআই, মানিকগঞ্জ জেলার একটি চৌকশ টিম ছায়া তদন্তের এক পর্যায়ে গত ৮ জুন উক্ত মামলাটির তদন্তভার স্ব-উদ্যোগে গ্রহণ করে। তদন্তভার গ্রহণের পরপরই গত ৮ জুন ঘটনা সংক্রান্তে সন্দিগ্ধ মোঃ আশিক হোসেন@ মনির (২৫), পিতা-মোঃ মালেক মিয়া, মাতা-মরিয়ম আক্তার, সাং-কাকনা, থানা-দৌলতপুর, জেলা-মানিকগঞ্জকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে তার দেয়া তথ্য মতে অপর সন্দিগ্ধ শাহিনুর ইসলাম@সহোন (৪০), পিতা-মৃত নুর মোহাম্মাদ, মাতা-মৃত জয়মালা, গ্রাম-কাকনা, থানা-দৌলতপুর জেলা-মানিকগঞ্জ তার নিজ বাড়ি হতে একই তারিখে আটক করা হয়।
পরবর্তীতে একই তারিখে আটককৃত সন্দিগ্ধ শাহিনুর ইসলাম@সহোন (৪০) এর দেয়া তথ্যমতে অন্যতম সন্দিগ্ধ ও ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী মোঃ বিল্লাল হোসেন (৩৮), পিতা-মৃত আজিমুদ্দিন, মাতা-আনোয়ারা বেগম, সাং-কাকনা, থানা-দৌলতপুর, জেলা-মানিকগঞ্জকে আটক করা হয়।
ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃতরা ঘটনার সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করলে তাদেরকে উক্ত মামলায় গ্রেফতার করা হয়।
অভিযুক্তদের দেয়া তথ্যমতে গত ৮ জুন আনুমানিক ৩ টার সময় হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত বিভিন্ন আলামত (বিষের বোতল, চেতনা নাশক ঔষুধ মিশ্রিত কোমল পানীয় গিয়ারের বোতল) কাকনা উচ্চ বিদ্যালয়ের পিছনের বাশঝাড় হতে ও ফায়ার সার্ভিস মানিকগঞ্জ জেলার ডুবুরি দলের সহায়তায় কাকনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিছনের খাল হতে উদ্ধার করা হয়। হত্যাকান্ডের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলামত আনুমানিক ০২ ঘন্টা যাবত পিবিআই জেলা পুলিশের সদস্য, ডুবুরি দল ও স্থানীয় ব্যক্তিদের সহায়তায় কাকনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিছনের খাল হতে উদ্ধারের চেষ্টা করা হয়।
খালে পানি বেশি থাকায় ও নোংরা পরিবেশ থাকায় তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার করা সম্ভবপর হয় নাই। পরবর্তীতে আলামত উদ্ধারের বিষয়ে পিবিআই মানিকগঞ্জ জেলা কর্তৃক দুটি সেলো মেশিন ভাড়া করে উক্ত খালের পানি সেচের ব্যবস্থা করা হয়।
গত ৮ জুন বিকাল ৪ টা থেকে ৯ জুন সকাল সাড়ে ৮ টা পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ১৬ ঘন্টা সেচের পর খালের পানি পরিপূর্ণভাবে সেচে ঘটনা সংক্রান্তে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলামত জিসিস্টের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।
উল্লেখ্য যে, হত্যাকারীরা আব্দুর রহিমকে হত্যার পর হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত পলিথিনে মোড়ানো বিষের বোতল ও ডিসিস্টের মোবাইল ফোন কাকনা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন খালে ফেলে দেয়।
হত্যাকান্ডের কারণ স্বরুপ জানা গেছে, নিহত ভিকটিম আব্দুর রহিম মিয়া (৪২) একজন অত্যন্ত দরিদ্র, নিরীহ ও অসহায় প্রকৃতির লোক ছিলো। কাকনা বাজারে বিভিন্ন দোকানদার ও বাজারে আগত লোকজনের ফরমায়েশ এর কাজ কর্ম করতেন। যেমন দোকানে দোকানে বোতল ও কলসী দ্বারা পানি দেওয়া, গ্যাস সিলিন্ডারার সহ বিভিন্ন গ্রাহকের বাজার বাড়িতে বাড়িতে পৌছে দেওয়ার কাজ করে যে টাকা রোজগার হতো তা দিয়ে তার স্ত্রী(বাক প্রতিবন্ধী) ও ছোট ছোট ২ ছেলে এবং ১ মেয়ে নিয়ে জীবনযাপন করতো। ডিসিস্ট বিভিন্ন সময় বিশেষ করে রমজান মাসে এলাকার চাকরিজীবী সহ বিভিন্ন পেশার স্বচ্ছল প্রকৃতির লোকদের কাছে ঈদ শুভেচ্ছা কার্ডের মাধ্যমে আর্থিক সাহায্য চাইতো।
এলাকাবাসী তাকে টাকা পয়সা ও ধান-চাল দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করতো। এভাবে সে বিগত কয়েক বছরে কিছু টাকা জমা করে। উক্ত টাকা সে এলাকার বিভিন্ন লোকজনের কাছে বিভিন্ন মেয়াদে লাভের উপর দিতো। যারা টাকা নিতো তারা লাভ সহ সমুদয় টাকা পরিশোধ করে দিতো। কাকনা বাজারের দোকানদার সহ আশেপাশের লোকজন ডিসিস্টের টাকা সুদে লাগানোর বিষয়ে জানতো।
ডিসিস্ট এর প্রতিবেশী কাকনা গ্রামের চা বিক্রেতা মোঃ বিল্লাল হোসেন (৩৮) ডিসিস্ট এর নিকট থেকে লাভের উপর টাকা নিয়ে তার ২য় স্ত্রী (নুপুর) কে বিদেশে (সৌদি আরব) পাঠায় (টাকার অংক জানা য়ায়নি)। উল্লেখ্য যে, ডিসিস্ট আব্দুর রহিম ও হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী বিল্লাল হোসেনের মাঝে টাকা পয়সা লেনদেনের বিষয়টি তাদের দুইজনের ভিতর সীমাবদ্ধ ছিল মর্মে জানা যায়।
ডিসিস্টের স্ত্রী জন্মগত ভাবে বাক প্রতিবন্ধি (বোবা) হওয়ায় সে সু স্পষ্টভাবে এ বিষয়ে কোন তথ্য দিতে পারে নাই।পরবর্তীতে ডিসিস্ট রহিম মিয়া চা বিক্রেতা মোঃ বিল্লাল হোসেন এর নিকট টাকা ফেরৎ চেয়ে বারবার তাগদা দিতে থাকে।বিল্লাল হোসেন ডিসিস্ট আব্দুর রহিম এর টাকা ফেরৎ না দেওয়ার চিন্তায় হতেই তার নিকট আত্মীয় পেশাদার খুনি শাহিনুর ইসলাম @ সহোন (৪০) ও বেকার ছেলে মোঃ আশিক হোসেন @ মনির (২৫) কে টাকার বিনিময়ে আব্দুর রহিমকে হত্যার পরিকল্পনা করে। উক্ত পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই এই হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়।
হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী মোঃ বিল্লাল হোসেন তার প্রতিবেশী আত্মীয় পেশাদার খুনি শাহিনুর ইসলাম@সহোন ও অভিযুক্ত আশিক হোসেন@মনিরকে টাকার বিনিময়ে একটা কাজ করে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। তারা কাজের কথা জিজ্ঞাসা করলে আব্দুর রহিমকে হত্যা করার কথা জানায়। কারণ জিজ্ঞাসা করলে জানান যে, আব্দুর রহিম বেশি বেড়ে গেছে, ওর কাছে টাকা থাকলেও ধার দিতে চায় না আবার পাওনা টাকার সুদের জন্য চাপাচাপি করে। উভয়ে মোঃ বিল্লাল হোসেনের প্রস্তাবে রাজি হয়।
ঘটনার দিন অর্থাৎ গত ৫ জুন বিকাল অনুমান ৫ টার দিকে পেশাদার খুনি শাহিনুর ইসলাম@সহোন (৪০) মিল ঘরে বসে পরিকল্পনা মতে অভিযুক্ত শাহিনুর ইসলাম@সহোন (৪০) অভিযুক্ত মোঃ আশিক হোসেন@মনির (২৫)কে কাকনা বাজার হতে ডারবি সিগারেট ও গিয়ার (সফট ড্রিংস) আনার জন্য ২০০ টাকা দেয়।
আশিক কাকনা বাজারের হুমায়ুন এর দোকান হতে ৪ টি ডারবি সিগারেট ও একটি গিয়ার (কোমল পানীয়) কিনে নিয়ে আসে। শাহিনুর ইসলাম@সহোন (৪০) তখন অভিযুক্ত মোঃ আশিক হোসেন@মনির (২৫) এর হাতে সাদা কাগজে মোড়ানো ১০ টি ঘুমের ট্যাবলেট দেয়। অভিযুক্ত মোঃ আশিক হোসেন@মনির (২৫) ঘুমের ট্যাবলেট গুলো গ্যাস লাইটার দিয়ে গুড়া করে গিয়ারের বোতলে মিশায়।
অভিযুক্ত মোঃ আশিক হোসেন@মনির (২৫) আব্দুর রহিমকে বাজারে রহমান ডাক্তারের দোকানের সামনে পেয়ে তার হাত ব্যথা ঝাড় ফু দিয়ে দিতে বলে। আব্দুর রহিম অভিযুক্ত মোঃ আশিক হোসেন@মনির (২৫) এর হাতে ফু দিয়ে দেয়।
তখন অভিযুক্ত মোঃ আশিক হোসেন@মনির (২৫) প্রস্তাব করে তার হাত টিপে দিলে ১০০ টাকা দিবে। আব্দুর রহিম রাজি হলে মোঃ আশিক হোসেন@মনির (২৫) তাকে ঘটনাস্থলে নিয়ে যায়। সেখানে যাওয়ার পর আব্দুর রহিমকে প্রথমে একটি সিগারেট খেতে দেয়। তারপর আব্দুর রহিমকে ঘুমের ট্যাবলেট মিশানো গিয়ারের বোতলটি দেয়।
আব্দুর রহিম সম্পূর্ণ গিয়ারটি (কোমল পানীয়) খায় এবং সেখানে আনুমানিক ৫/৭ মিনিট অভিযুক্ত মোঃ আশিক হোসেন@মনির (২৫) এর শরীর টিপার পরে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। অভিযুক্ত মোঃ আশিক হোসেন @ মনির (২৫) অভিযুক্ত শাহিনুরকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার কথা জানায়।
পরে অভিযুক্ত মোঃ আশিক হোসেন@মনির (২৫) ঘটনাস্থল হতে চলে আসে। তারপর রাত অনুমান ১১ টার দিকে অভিযুক্ত মোঃ আশিক হোসেন@মনির (২৫) ও শাহিনুর ইসলাম@সহোন (৪০) দুই জন একত্রে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখে আব্দুর রহিম অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।
অভিযুক্ত শাহিনুর ইসলাম @ সহোন (৪০) হ্যান্ড গ্লাভস পড়ে দুই হাত দিয়ে আব্দুর রহিম এর নাক ও মুখ চেপে ধরে। অভিযুক্ত মোঃ আশিক হোসেন @ মনির (২৫) হাত চেপে ধরে।
কিছুক্ষণ পর আব্দুর রহিম নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়। আব্দুর রহিম এর মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর অভিযুক্ত শাহিনুর একটি বিষের বোতল হতে ডিসিস্ট এর মুখে বিষ ঢেলে দেয়।
তারপর তারা ডিসিস্ট ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি, বিষের বোতল ও হ্যান্ড গ্লাভস পাশর্^বর্তী খালে ফেলে দিয়া ঘটনার বিস্তারিত মূলপরিকল্পনাকারী মোঃ বিল্লাল হোসেনকে জানিয়ে বাড়ি চলে যায়।
হত্যাকান্ড সংঘটনের পরের দিন সহোন মূল পরিকল্পনাকারী বিল্লালের কাছে টাকা চাইলে বিল্লাল অভিযুক্ত সহোনকে ১০,০০০ টাকা দিয়ে বাকী টাকা পরে দিবে মর্মে অঙ্গীকার করে। সহোন উক্ত ১০,০০০ টাকা হতে অভিযুক্ত মনিরকে ৫০০০ টাকা প্রদান করে।