বিশেষ প্রতিবেদক: চলতি বছরের মাঝামাঝিতে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হলে ঢাকার দুই সিটির মশার ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কয়েক মাস মশক নিধনে জোরেশোরে মাঠে নামে দুই সিটি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এখন আবার সেই আগের মতোই ঢিলেঢালা মশা ওষুধ ছিটানোর কর্মসূচি। আবার এলাকা ভেদে ওষুধ ছিটাতেও ‘কম বেশি’ তারতম্য আছে। আর এটি ধনী-দরিদ্র বিবেচনায় বৈষম্য কিনা সে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।
সরেজমিনে দেখা যায়, দুই সিটিরই উন্নত এলাকাগুলো তুলনামূলক পরিচ্ছন্ন। ফলে সেখানে মশক প্রজননের সুযোগ কম। আর নি¤œাঞ্চল বা তুলনামূলক দরিদ্র মানুষের বাস রয়েছে এমন এলাকায় মশার উপদ্রব বেশি। অপচ্ছিন্নতার কারণে এখানে সব ধরনের মশার প্রজনন উপযোগিতা রয়েছে।
নগর কর্তৃপক্ষ মশক নিধনে কাজ করলেও নি¤œাঞ্চল অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত দরিদ্ররা বাস করেন এমন এলাকাগুলোতে তাদের কার্যক্রম দেখা যায় নামমাত্র। অন্যদিকে মশার উপদ্রব কম থাকার পরেও মশককর্মীদের তৎপরতা বেশি উন্নত এলাকায়। ফলে নাগরিক সেবা দিতে নগরের বাসিন্দাদের দুই চোখে দেখা হচ্ছে বলে অভিযোগ এসব এলাকার বাসিন্দাদের।
গত জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে মহামারি আকার ধারণ করে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু। এই চার মাসে সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় কয়েক লাখ মানুষ। এদের অধিকাংশ চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেও প্রাণ হারান তিন শতাধিক মানুষ। সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে ঢাকায়। যদিও সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় এক লাখ আর মৃতের সংখ্যা ১৩৩ জন।
পরিস্থিতি যখন চরমে পৌঁছায়, তখন নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয় মশক নিধনে। বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ডেঙ্গু। কিন্তু একেবারে নির্মূল হয়েছে এমনটা বলা যাচ্ছে না। এখনো রাজধানীসহ সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর দেখা মিলছে। মাঝে মধ্যে ঘটছে প্রাণহানিও। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৩০১ জন। এর মধ্যে ঢাকার ৪১টি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১৯২ জন এবং অন্য বিভাগে ১০৯ জন।
তবে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমলেও শীতের শুরুতে উপদ্রব বেড়েছে কিউলেক্স মশার। কুয়াশা এবং ছায়াযুক্ত পরিবেশে প্রজনন উপযোগিতা পায় ডেঙ্গু। ফলে কর্তৃপক্ষ আগাম সতর্ক না হলে পুরো শীতকাল মশার উপদ্রব চরমে পৌঁছতে পারে।
সারা বছরের জন্য মশক নিধন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। সে অনুযায়ী কাজও চলছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে এর সুফল নিয়ে। নগরের উন্নত এলাকাগুলোতে করপোরেশনের কর্মীদের কর্মযজ্ঞ চোখে পড়লেও অনুন্নত এলাকাগুলোতে মশককর্মীদের দেখা নেই। ফলে এসব এলাকার বাসিন্দাদের ভোগান্তি এখন চরমে।
মোহাম্মদপুরের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের রামচন্দ্রপুর খাল এলাকায় কিউলেক্স মশার উপদ্রব এখন মাত্রাতিরিক্ত। সন্ধ্যার পর ভোগান্তি চরমে পৌঁছায়। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খাল এলাকায় মশককর্মীদের শেষ কবে দেখা গিয়েছিল তা তারা নিজেরাও বলতে পারেন না।
স্থানীয় বাসিন্দা বকুল মিয়া বলেন, মশার ওষুধ তো ছিটাতে দেখি না। এই দিকে মাস খানেক আগে একবার দেখছিলাম, তারপর আর কেউ আসে নাই। সন্ধ্যার পর মশার কামড়ে বাইরে আসা যায় না। কয়েল না জ¦ালাইলে তো ঘরেও থাকন যায় না।
নিলিমা আক্তার নামের অপর একজন বলেন, মাসে মশা তাড়াতে আমার খরচ ১১০০ টাকার বেশি। আমাকে যদি এত টাকা খরচ করতে হবে, তাহলে সিটি করপোরেশনের কাজ কী?
ওয়ার্ডের এই অংশে মশক নিধন কর্মীদের কর্ম বন্টনের দায়িত্ব রয়েছেন করপোরেশনের একজন সুপারভাইজার। সালাউদ্দিন নামের ওই কর্মীকে ফোন করা হলে তিনি জানান, পরদিন ওষুধ দেয়া হবে। কিন্তু এরপর এক সপ্তাহের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও মশক কর্মীর দেখা মেলেনি। অন্যদিকে খাল সংলগ্ন এলাকায় শেষ কবে ওষুধ ছিটানো হয়েছিল জানতে চাইলে তার ‘উত্তর দিতে পারেননি’ এই সুপারভাইজার।
একই চিত্র শেকেরটেক ও আদাবর এলাকায়। মূল সড়ক ও আবাসিক এলাকায় মশক কর্মীদের নিয়মিত দেখা মেলে। কেবল তাদের দেখা পান না এলাকায় বেড়িবাধ ও খাল সংলগ্ন এলাকার মানুষ।
আদাবর সুনিবিড় হাউসিং এলাকার বাসিন্দা মো. মুনসুর বলেন, আমি মনসুরাবাদে চাকরি করি। সেখানে ওষুধ দেয়। কিন্তু আমাদের এদিকে দেয় না। আমরা তো কাউরে বিচার দিতে পারব না। তাই তারা আমাদের এদিকে ওষুধ দেয় না। আর ওই এলাকায় না দিলে তো তাগো চাকরি থাকবে না।
ঢাকা উত্তরের খিলক্ষেত এলাকায় বিমানবন্দর সড়কের পাশে কোনো আবাসিক স্থাপনা না থাকলেও সেখানে মশক কর্মীদের কর্মযজ্ঞ দেখা মেলে। কাজের ব্যস্ততা দেখা যায় খিলক্ষেতের নামিদামি এলাকায়। কিন্তু এই এলাকার ভেতরের অংশে তাদের প্রবেশ করতে দেখা যায় না।
হাবিবুর রহমান নামের এক বাসিন্দা জানান, দীর্ঘ দিন ধরে মশক নিধন কর্মীদের দেখা পাওয়া যাচ্ছিল না। অন্যদিকে মশার উপদ্রবে অতিষ্ট হয়ে উঠেছেন খিলক্ষেতের জোয়ার সাহারা খাপাড়া মসজিদ এলাকা। বাধ্য করপোরেশনের ওয়েবসাইট থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত মশক নিধন কর্মীকে ফোন করেন। এক সপ্তাহের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও সুহারা মেলেনি বলে জানিয়েছেন এই ভুক্তভোগী।
তিনি বলেন, আমি গত সোমবার মশক নিধন কর্মীকে ফোন করি। তিনি আমাকে বলেন বৃহস্পতিবার ফোন করতে। বৃহস্পতিবার ফোন করার পরে বলেন ওষুধ অন্য জায়গায় ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে। এরপর সোমবার ফোন করি। তারপরেও কারও দেখা নেই। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিন্নাত আলীকে বিষয়টি অবগত করলে তিনি সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন বলে জানান হাবিবুর।
খিলক্ষেতের মতো একই অবস্থা মগবাজার, মধুবাগ, রেলগেট, মীরবাগ, মীরেরটেক মোহাম্মদপুরের নবীনগর, সাত মসজিদ হাউজিং, চাঁদ উদ্যান, দয়াল হাউজিং, রায়েরবাজার, মিরপুরের দিয়াবাড়ি, মাজার রোড, কালসি, শেওরাপাড়া খাল, তুরাগের ধউর, উত্তরার উত্তরখান, দক্ষিণ খান, মা-া-মুগদা খাল, কুড়িল, কামরাঙ্গীর চর, পুরাণ ঢাকার ইসলামবাগ, সোয়ারিঘাট, বাবুবাজার সহ বিভিন্ন এলাকা।
এসকল এলাকায় মশক নিধন কার্যক্রমে নিযুক্ত কর্মকর্তাদের অনেকেরই গাফেলতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিয়মিত মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনার কথা থাকলেও বাস্তবে তার দেখা নেই এব এলাকায়। করপোরেশনের ওয়েবসাইটে দেয়া নাম্বারে ফোন করে মশক কর্মীদের ফোন করা হলেও এদের দেখাও মিলছে না।
ধনী শ্রেণী মানুষের বাসের জায়গাগুলির বিপরীতে ঢাকার নি¤œাঞ্চল এবং তুলনামূলক দরিদ্র মানুষের এলাকায় মশক নিধনের কার্যক্রম নামমাত্র বলে প্রকারান্তরে স্বীকার করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ আহমেদ। জনবল কম থাকার কারণে এমনটি হতে পারে বলে তার ভাষ্য।
তিনি বলেন, নতুন অঞ্চলগুলোতে আমাদের জনবল কম। আমরা প্রতি ওয়ার্ডে ১০ জন করে নতুন করে লোক নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। এতে করে সমস্যা অনেকটাই কমে আসবে।
তবে বলে রাখা ভাল, নতুন যে ওয়ার্ডগুলো রয়েছে, তার অধিকাংশই জলজভূমি। সেখানে মশার উপদ্রব এবং প্রজনন সুবিধাও বেশি। সব কিছু মাথায় রেখে আমরা কাজ করছি।
ডিএসসিসির কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি বলেন, শুকনা মৌসুমের শুরুতে আমরা কিউলেক্স মশা নিধনে কাজ শুরু করেছি। অক্টোবরের শুরুতে আমরা একটা জরিপ করেছিলাম। আমাদের রুটিন কাজ চলছে। এ ছাড়া জরিপের ওপর ভিত্তি করে আমাদের কাজ চলছে।
অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মমিনুর রহমান মামুন জানান, মশক নিধন কার্যক্রমে সকল নাগরিক সমান সুবিধা পাবে। নিয়মের বাইরে কাউকে বেশি আর কাউকে কম সুবিধা দেয়ার অভিযোগ প্রমাণ হলে কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তিনি বলেন, ওয়ার্ডভিত্তিক চলমান কার্যক্রমে প্রতিটি দলে ১৭ থেকে ১৮ জন করে লোক দেয়া হয়েছে। তারা পূর্বে শনাক্ত করা মশার প্রজনন স্থল ধ্বংসে কাজ করছে। কোথাও অনিয়ম পাওয়া গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বর্তমানে প্রতিটি ওয়ার্ডকে দশ ভাগে ভাগ করে মশক নিধনে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কিউলেক্স মশার উপদ্রপ অনেকটা বেড়েছে। যেমন কল্যাণপুর খাল বিভিন্ন স্থানে জলাশয়ে জমা কচুরিপানা থেকে কিউলেক্স মশার উপদ্রপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে বিষয়টি অবগত করা এবং তা পরিষ্কার করতে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু কোনো সংস্থায় এগিয়ে আসেনি।
ডিএনসিসির এ কর্মকর্তা জানান, সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিয়ে এসব কচুরিপানা পরিষ্কার করা হচ্ছে। আর এতে যে পরিমাণ টাকা খরচ হবে, তা পরিশোধ করতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে বিল পাঠানো হবে।
গত মঙ্গলবার থেকে উড়ন্ত মশা মারতে ফগিং কার্যক্রমে জোর দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, চলমান কার্যক্রম শেষে আবারও কিউলেক্স এবং ডেঙ্গু দমনে নতুন অভিযান করা হবে। এবিষয়ে একটি পরিকল্পনা স্বল্প সময়ের মধ্যেই মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হবে।