মহসীন আহেমদ স্বপন : নীলনদের কন্যা কায়রোকে বলা হয় ‘বাতাসের শহর’। এইভাবে নামকরণ করা হলে বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী শহর ঢাকার বর্তমান নাম হবে ‘দূষিত বাতাসের শহর’। শীতের উতলা হাওয়ায় উড়ে আসা ধূলিকণার কারণে এই দূষণের মাত্রা এখন আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইটভাটা, যানবাহন আর কল-কারখানার চিমনি ছুঁয়ে বের হওয়া বিষাক্ত ধোঁয়ার বলয়। এই বিষ বলয়ের প্রভাবে রাজধানীর বাসিন্দারা এখন ঠিক মতো নিঃশ্বাসও নিতে পারছে না! স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে কয়েক কোটি সাধারণ মানুষ।
দেশি-বিদেশি বেসরকারি গবেষণা সংস্থাগুলো জানাচ্ছে, গত এক দশকে ঢাকায় দূষণের মাত্রা ৮৬ শতাংশ বেড়েছে। এই দূষণের কারণ হিসেবে জনসংখ্যার অতি ঘনত্ব ও অপরিকল্পিত নগরায়ণকে দায়ী করছেন তারা। ঘনবসতি বিবেচনায় ঢাকাকে বলা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত।
বৃহস্পতিবার বিকেলেও এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা ছিল ২০৪। পরিবেশ অধিদফতর বাতাসে দূষণের এই মাত্রাকে আনহেলদি বা অস্বাস্থ্যকর হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবে এই মাত্রা চলতি মাসে আরও ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। চলতি মাসের প্রথম দিনে দূষণের মাত্রায় দুনিয়ার সব শহরকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল ঢাকা। সেদিন বাতাসে দূষণের মাত্রা ছিলো ৩১৫। বাতাসের গুণমান সূচক বা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স অনুসারে যেটি ছিলো ভয়াবহ অস্বাস্থ্যকর।
এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (একিউআই) সূচক অনুযায়ী, ৩০০-৫০০ সূচকে থাকা শহরগুলো বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। আর ২০০-৩০০ খুবই অস্বাস্থ্যকর এবং এটি জরুরি স্বাস্থ্য সতর্কাবস্থার সূচক। ঢাকায় এখন রোজকার বায়ু দূষণমান এই দু’টি সূচকেই উঠানামা করে। এই সূচকে ০-৫০ পর্যন্ত বায়ু মানকে সন্তোষজনক বা ঝুঁকিহীন বলা হয়।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, কয়লা, ও বিবিধ জ্বালানি পোড়ানোর ফলে ক্ষতিকর কণার সৃষ্টি হয়। ইটভাটা, শিল্প কারখানার ধোঁয়া, যানবাহনের ধোঁয়ার কারণে এসব ক্ষতিকর ক্ষুদ্রকণা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে সরাসরি ফুসফুসে ঢুকে মানুষের রক্তকণিকায় মিশে যায়। এর ফলে নানা জটিল রোগের সৃষ্টি হয়। এসব রোগ স্বল্পসময়ে মৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়।
দূষণের মাত্রার ভয়াবহ এই বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে ঢাকার চারপাশে সচল থাকা ইটভাটা, রাস্তাঘাটের ধূলা আর যানবাহনের অতি আধিক্যকে দায়ী করেছেন পরিবেশ অধিদফতরের বায়ুমান বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, ঢাকার চারপাশে এত বেশি ইটভাটা যে এদের ধোঁয়ার কারণে নির্মল বাতাস পাওয়া এখন অসম্ভব। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অপরিকল্পিত খোঁড়াখুড়ি, মেট্রোরেলের ধূলা আর গাড়ির ধোঁয়া। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ করতে হলে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরকিল্পনা করে এগোতে হবে। দায়িত্বশীল প্রতিটি বিভাগকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তাহলে ঢাকার বাতাসকে বিশুদ্ধ করা সম্ভব।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, ঢাকায় ধূলা সবচেয়ে বড় সমস্যা। রাস্তা খোঁড়াখুড়ির কারণের এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। বাতাসের সঙ্গে মিশে যাওয়া ধূলার কণাগুলো নিঃশ্বাসের সঙ্গে মানুষের ফুসফুসে গিয়ে জমা হচ্ছে। যেখানে কার্বন, সালফেট, নাইট্রেটসহ সীসার মতো বিপজ্জনক পদার্থের উপস্থিতিও পাওয়া যাচ্ছে। এটি এখনি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে কিছুদিন পর ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়তে হবে আমাদের।
এই পরিবেশবিদ আরও জানান, ইট ভাটায় নি¤œমানের কয়লা পোড়ানো, রাস্তাঘাট মেরামত ও সংস্কার কার্যক্রমের আওতায় অপরিকল্পিতভাবে খোঁড়াখুড়ি, ভাঙাচোরা রাস্তায় যানবাহন চলাচল, ভবন নির্মাণ বা ভাঙার সময় মাটি, বালু, ইটসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী রাস্তা-ফুটপাতে ফেলে রাখা, মেশিনে ইট ভাঙ্গা, এবং যানবাহনের ধোঁয়ার পাশাপাশি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিষাক্ত ধোঁয়া বায়ু দূষণের অন্যতম উৎস।’ তবে দূষণ বন্ধ করতে পরিবেশ অধিদফতর নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে বলেও জানান তিনি।
অধিদফতরের মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত পনের দিনে ঢাকার পার্শ্ববর্তী পাঁচটি জেলায় ভ্রাম্যমাণ আদালদের মাধ্যমে ১৬টি অভিযান চালিয়ে অবৈধ ইটভাটার মালিকদের ২ কোটি ৪ লাখ টাকা জরিমানা ও ৫৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ঢাকার বাতাসকে এই ইটভাটাগুলোই সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বিষাক্ত করছে বলে জানিয়েছেন বিভাগটির পরিচালক রুবিনা ফেরদৌস। একই অভিযোগে মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকারী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকেও তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট বিভাগের পরিচালক রুবিনা ফেরদৌস বলেন, ইটভাটার ধোঁয়া ঢাকাকে সবচেয়ে বেশি নাজুক করে তুলেছে। এজন্য অবৈধ ইটভাটাগুলোকে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। তাদের মোটা অংকের জরিমানা করা হচ্ছে। এছাড়া আমরা মেট্রোরেলের ঠিকাদারদেরও জরিমানা করেছি। এভাবে যদি অভিযান পরিচালনা করা যায় তাহলে ঢাকার পরিবেশ আবারও স্বাস্থ্যকর করে তোলা সম্ভব।
রুবিনা ফেরদৌস আরও বলেন, নির্মাণকাজে প্রচুর ধূলা হচ্ছে কারণ দেশের প্রচলিত আইন কেউ মানছে না। দূষণ নিয়ন্ত্রণে ওই আইনের তদারকি বাড়াতে হবে। সারা দেশের ইটভাটাগুলোতে আধুনিকায়ন করতে হবে। ঢাকার বড় রাস্তাগুলোতে সকাল-বিকাল পানি ছিটাতে হবে। আবর্জনা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বৈজ্ঞানিক উপায়ে করতে হবে। যত্রতত্র ময়লা ও প্লাস্টিক পদার্থ পোড়ানো যাবে না।
বায়ু দূষণের সূচকে নভেম্বরে ঢাকা সবার ওপরে জায়গা করে নিলেও গত পনের দিনের এই অভিযানে বাতাসের মান কিছুটা উন্নত হয়েছে বলেও জানিয়েছেন রুবিনা ফেরদৌস। দূষণ সূচকে ঢাকার অবস্থান এখন চতুর্থ। সবার ওপরে রয়েছে মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাটোর। এরপরই আছে ভারতের রাজধানী দিল্লি। বৃহস্পতিবার এ দুটো শহরে দূষণের মাত্রা ছিলো ২৮৭ ও ২৫৪।
তবে ঢাকার বাতাসে মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান পিএম ২.৫ শনাক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, পিএম ২.৫ শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগ ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এর কারণে ফুসফুসের ক্যান্সারও হতে পারে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত পিএম ২.৫ নিঃসরণে চীন ছিল শীর্ষে। গত দুই বছরে চীনকে টপকে ওই দূষণকারী স্থানটি দখল করে নিয়েছে ভারত। এরপরই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান।
পরিবেশ অধিদফতরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, শুষ্ক মৌসুমে যে নির্মাণকাজগুলো হচ্ছে, তাতে সকাল ও বিকেল দুই বেলা নির্মাণসামগ্রী, বিশেষ করে বালু ও ইট পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু রাজধানীর বেশির ভাগ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের নির্মাণসামগ্রী যত্রতত্র ফেলে রেখে ধূলা সৃষ্টি করছে।
ধুলায় ধূসর বন্দরনগরী : চট্টগ্রাম নগরীতে বাতাসে বস্তুকণা মিশে সৃষ্ট দূষণের পরিমাণ গত তিন বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ইতোমধ্যে বায়ু দূষণের জন্য ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ শহরের তালিকায় উঠে এসেছে চট্টগ্রামের নাম। পরিবেশ অধিদফতর বলছে, বায়ু দূষণের এই হার কোনোভাবেই আর বাড়তে দেওয়া যাবে না। বাড়লে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
বাতাসে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি বস্তুকণা ছড়ানোর জন্য একসময় লোহা ও সিমেন্টের কারখানাগুলোকে দায়ী করা হতো। কিন্তু এখন সেই মাত্রা আশংকাজনক হয়ে ওঠার জন্য মূলত দায়ী করা হচ্ছে চট্টগ্রাম নগরী ও আশপাশের এলাকায় চলমান সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পকে। পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, পাইপলাইন বসানোর জন্য চট্টগ্রাম নগরী জুড়ে ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ি এবং সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন সড়ক উন্নয়ন, আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর বহুতল ভবন নির্মাণের কারণে দূষণ ক্রমাগত বাড়ছে।
চট্টগ্রামের পরিবেশ অধিদফতরের দূষণের মাত্রা নির্ধারণকারী গবেষণাগারের পরিচালক মোহাম্মদ নূরুল্লাহ নুরী বলেন, আমরা গবেষণায় দেখেছি, যেসব জায়গায় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ হচ্ছে, বড় আকারের খোঁড়াখুঁড়ি যেখানে হচ্ছে, সেখানকার বাতাসে দূষণের পরিমাণ বেশি। কারখানার মতো সেখানেও প্রলম্বিত বস্তুকণা বাতাসে পাওয়া যাচ্ছে। এ কারণে চলতি বছরে দূষণের পরিমাণ আমরা বলছি যে, অতীতের রেকর্ডে এরকম দূষণ আর হয়নি।
পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (মেট্রো) সংযুক্তা দাশগুপ্তা বলেন, কারখানাগুলোকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করছি, তাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা যাচ্ছে। কিন্তু উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে আমরা সেটা করতে পারছি না। বিশেষত রোড কনস্ট্রাকশনের কাজটা আমাদের খুবই ভোগাচ্ছে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে ফিটনেসবিহীন গাড়ি। সেগুলো থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া বাতাসের সঙ্গে মিশছে এবং দূষিত করছে।
সারা বিশ্বে প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ধুলিকণার পরিমাণ ০-৫০ মাইক্রোগ্রাম ভালো, ৫১-১০০ মধ্যম, ১০১-১৫০ সতর্কাবস্থা, ১৫১-২০০ অস্বাস্থ্যকর, ২০১-৩০০ খুব অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১-৫০০ অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
চট্টগ্রামে পরিবেশ অধিদফতরের গবেষণাগার থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম নগরীতে বাতাসে গড়ে ধুলার পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ২৩২ মাইক্রোগ্রাম। ২০১৮ সালে ছিল ২৫৫ থেকে ২৬০ মাইক্রোগ্রাম। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত গড়ে ধুলার পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৩০৯ মাইক্রোগ্রাম।
বুধবার চট্টগ্রাম নগরীতে বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে ২৮২ মাইক্রোগ্রাম ধুলিকণা পরিমাপ করা হয়, যা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর বলছে পরিবেশ অধিদফতরের ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট (সিএএসই) প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদ ও খুলশীর ফয়’সলেকের দুটি মনিটরিং স্টেশন থেকে বায়ু দূষণের পরিমাপ করা হয়। সম্প্রতি নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানার নাসিরাবাদ এলাকায় আরও একটি স্টেশন চালু করেছে পরিবেশ অধিদফতর।
পরিচালক নূরুল্লাহ নুরী বলেন, খুলশী এলাকায়ও বাতাসে এমনভাবে প্রলম্বিত বস্তুকণা পাওয়া যাচ্ছে, যা আমরা অতীতে দেখিনি। সেখানে দিনের মধ্যে কিছুটা সহনীয় থাকে। কিন্তু রাত ১২টার পর দেখা যাচ্ছে, ২২০ থেকে ২৩০ মাইক্রোগ্রাম পাওয় যাচ্ছে। অথচ সেখানে ১৫০ মাইক্রোগ্রামের বেশি হওয়ার কথা না। এটা নিয়ে জরিপ করে আমরা দেখেছি, রাত ১২টার পর থেকে খুলশীতে ট্রাক চলাচল বেড়ে যায়। মাটিবোঝাই ট্রাক চলে, কালো ধোঁয়া থাকে। এর বাইরে নগরীর বিভিন্ন জায়গায় ৪০০ থেকে ৮০০ মাইক্রোগ্রাম ধুলিকণাও বাতাসে পেয়েছি।
নুরী আরও জানান, এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম নগরীতে বাতাসে সবচেয়ে বেশি বস্তুকণা মিশছে চেরাগি পাহাড়, জামালখান, সাগরিকা ও কালুরঘাট এলাকায়। চেরাগি পাহাড় ও জামালখানে ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। আর কালুরঘাট আরাকান সড়ক ও সাগরিকায় সিটি করপোরেশন সড়ক সম্প্রসারণ ও সংস্কার করছে।
সহকারী পরিচালক সংযুক্তা দাশগুপ্তা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার পরিবেশ অধিদফতরের টিম সাগরিকা ও কালুরঘাট এলাকায় পরিদর্শনে গিয়ে বায়ু দূষণের প্রমাণ পেয়েছে। সিটি করপোরেশনকে বায়ুতে ধুলার মানমাত্রা বেশি পাবার কথা জানিয়ে বৃহস্পতিবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাদের দূষণ রোধে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।
এর আগে, গত ৪ ডিসেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বায়ূ দূষণ রোধে করণীয় নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) সহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করেছে। এতে বড় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরুর আগে পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া চলমান প্রকল্পের কাজের সময় পানি ছিটিয়ে ধুলা যাতে উড়তে না পারে সেই ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
নুরুল্লাহ নুরী বলেন, বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে অর্থাৎ যেসব প্রকল্প একেবারে নতুন করে শুরু হবে, সেগুলোর কাজ শুরুর আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেওয়ার বাধ্যবাধতকতা আছে। কিন্তু সরকারি প্রকল্প হওয়ায় এই শর্ত মানছে না কোনো সংস্থা। সরকারি কাজ হওয়ায় আমরা সরাসরি কোনো অ্যাকশনেও যেতে পারছি না। তারপরও আমরা বৈঠকে বলেছি যে, উন্নয়ন কাজের জন্য যে পরিমাণ দূষণ ইতোমধ্যে হয়েছে, এটা অনেক বেশি। এটাকে আর বাড়তে দেওয়া যাবে না। আর বেশি হলে আমরা জরিমানা করব।
পানি সরবরাহের পাইপালাইন বসানোর জন্য চট্টগ্রাম নগরী জুড়ে খোড়াখুড়ির জন্য সমালোচনা চলছে চট্টগ্রাম ওয়াসার বিরুদ্ধে। সম্প্রতি বায়ূ দূষণের বিষয়টি আলোচিত হয়ে ওঠায় এবং পরিবেশ অধিদফতর কঠোর হওয়ায় গত কয়েকদিন ধরে ওয়াসা তাদের খোঁড়া গর্তের আশপাশে পানি ছিটাতে শুরু করেছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেছেন, সড়কে যানবাহনের আধিক্য এবং যানজটের কারণে পানি ছিটানো যাচ্ছে না।
সরকারি উন্নয়ন কর্মকা-ের পাশাপাশি মেয়র বায়ূ দূষণের জন্য দায়ী করছেন বহুতল ভবন নির্মান কাজকেও। গত ৩ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে মেয়র বলেন, চট্টগ্রাম শহরে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকা- হচ্ছে। সেবা সংস্থাগুলো করছে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে আমরাও করছি। নগরবাসীর অনেকেও নির্মাণকাজ করছেন। সমস্যা হচ্ছে, সবাই নির্মাণ সামগ্রীগুলো রেখেছেন উন্মুক্ত স্থানে। এজন্য বায়ূ দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা যাতে সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়, সেজন্য সবাইকে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি। ম্যাজিস্ট্রেটকে বলেছি, সময় বেঁধে দিতে। এর মধ্যে সামগ্রী সরিয়ে না নেয়, তাহলে জরিমানা করব। আইন প্রয়োগ করা গেলে দৃশ্যমান পরিবর্তন আসবে।
চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদ, বাদামতলীর মোড়, বিমানবন্দর সড়কের বিভিন্ন অংশ, বহদ্দারহাট থেকে কালুরঘাট, অলঙ্কার মোড়, এ কে খান, জামালখান, বাকলিয়া, শাহ আমানত সেতুর শহরের প্রান্তসহ বিভিন্ন এলাকায় ধুলার কারণে পথে নেমে অস্বত্বিতে পড়তে হচ্ছে লোকজনকে। বিশেষ করে গণপরিবহনের যাত্রীদের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে।
চিকিৎসকদের মতে, বাতাসে ভয়াবহ দূষণের চরম শিকার হচ্ছেন শিশুরা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ প্রণব কুমার চৌধুরী বলেন, শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। দূষিত বায়ূ এবং বেশির ভাগ সংক্রামক রোগের জীবাণু তাদের নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করছে। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, অ্যাজমা, ব্রংকিউলাইটিস, ঘন ঘন জ্বর-সর্দি-কাশি, কানের প্রদাহ, বসন্ত এমনকি যক্ষ্মাও ছড়াচ্ছে দূষিত বায়ূ। এছাড়া শিশুদের দৈহিক বৃদ্ধির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া রুদ্ধ হচ্ছে। তাদের বুদ্ধিবৃত্তিও নষ্ট হচ্ছে। আমরা বোধহয় পরিণামটা বুঝতে পারছি না। এর পরিণাম কিন্তু ভয়াবহ।