গোলাম মওলা রনি (সাবেক সংসদ সদস্য)।
গোলাম মওলা রনি : বঙ্কিমের বিষবৃক্ষ পড়ি কিশোর বয়সে। রবীন্দ্রনাথের চোখের বালিও পড়েছি একই সময়ে। অষ্টম অথবা নবম শ্রেণীর একজন ছাত্রের পক্ষে বিষবৃক্ষ অথবা চোখের বালির মতো উঁচুমার্গের সাহিত্যকর্ম যতটুকু অনুধাবন সম্ভব আমি হয়তো ততটুকুই বুঝেছিলাম। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে আমার কিশোর বয়স যৌবন পেরিয়ে যখন বার্ধক্য ছুঁই ছুঁই করছে তখন পুরো দেশকালই বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। মানুষের বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কের প্রতি সুতীব্র আকর্ষণ ও সেই আকর্ষণের পরিণতিকে সাহিত্যরসে টইটম্বুর করে বঙ্কিম এবং রবীন্দ্রনাথ বিষবৃক্ষ ও চোখের বালিতে যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তার দ্বিতীয় নজির বাংলা সাহিত্যে নেই। মানুষ কেন একাধিক সম্পর্কে জড়ায় তা নিয়ে আদিকাল থেকে গবেষণা চলছে। কিন্তু সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সম্পর্কগুলো জটিল থেকে এত জটিলতর হচ্ছে যে, অতীতের কোনো কিছু দিয়েই বর্তমানকে সামাল দেয়া যাচ্ছে না।
রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতায় আমিও লাবণ্যের প্রেম কিংবা ক্লিওপেট্রার জীবনে মার্ক অ্যান্টনিওর আগমন নিয়ে প্রেমের যে সূত্র এতকাল জেনে এসেছি, তা ২০২৩ সালে এসে মেলানো যাচ্ছে না। বর্তমান জমানাতে যেকোনো সম্পর্কের সাথে অর্থ ও ক্ষমতার একটি যোগসাজশ রয়েছে। অন্য দিকে অর্থ ও ক্ষমতা যদি বৈধ হয় তবে সম্পর্কের রসায়ন একরকম হয় আর অবৈধ অর্থবৃত্তের মালিক মালিকিনরা যে সম্পর্কই তৈরি করেন না কেন তা শেষ পর্যন্ত বিষবৃক্ষে রূপান্তরিত হয়ে যায়।
আজকের নিবন্ধে আমি পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করব এবং নিজের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা ও দার্শনিকতা দিয়ে শিরোনামের যথার্থতা ব্যাখ্যা করব। বিষবৃক্ষ উপন্যাসে নারী-পুরুষের বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক এবং অসম সম্পর্কের যে উদাহরণ বঙ্কিম দিয়েছেন, তা হালআমলে ডালপালা বিস্তার করে এতটা বিস্তৃত ও বিকৃত হয়েছে যা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
অসম যৌন সম্পর্ক, বিকৃত শারীরিক সম্পর্ক, বহুবিয়ে, বিয়েবিচ্ছেদ, সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন করে নারী-পুরুষের নিঃসঙ্গ জীবন বেছে নেয়া, জীবনের সব সম্ভাবনা নিজ হাতে নিঃশেষ করে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হওয়া থেকে শুরু করে খুন-খারাবির মতো ঘটনা কেন ঘটছে তা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা ছাড়া বিষবৃক্ষের বিস্তার রোধ সম্ভব নয়।
বর্তমান সমাজে নারী-পুরুষের সম্পর্কে কিভাবে বিষ ঢুকে পড়ছে তার কিছু বাস্তব উদাহরণ না দিলে পাঠকরা বিষয়গুলো অনুধাবন করতে পারবেন না। প্রথমেই ইমরুল চৌধুরীর (ছদ্মনাম) কাহিনী বলি। গ্রামবাংলার নিতান্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান ইমরুলের ডাকনাম ছিল কালু মিয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর আর্থিক অনটনে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের এক নিম্নবিত্ত পরিবারে লজিং মাস্টারি করতে গিয়ে ছাত্রীর সাথে প্রণয় ও বিয়ে। পরে সরকারি চাকরির সুবাদে অঢেল অর্থবিত্তের মালিক হয়ে ঢাকার অভিজাত ক্লাবগুলোতে আড্ডা মারতে গিয়ে মাদক, জুয়া ও বহু নারীতে আসক্ত হয়ে পড়েন।
পথের কাঁটা স্ত্রীকে তালাক দিয়ে উঁচুতলার ডিভোর্সি এক মহিলাকে বিয়ে করেন এবং সপরিবারে মদ জুয়ায় আসক্ত হয়ে মানসিক ভারসাম্য ও সরকারি চাকরি- দুটোই হারান। সংসারে অভাব দেখা দিলে কালু মিয়া একদিন আত্মহত্যার চেষ্টা করতে গিয়ে নিজে আহত হন এবং স্ত্রীকেও আহত করেন। তারপর থানা-পুলিশ মামলা-মোকদ্দমার কবলে পড়ে কোথায় যে হারিয়ে যান তার হদিস কেউ জানে না।
কালু মিয়ার পর আপনাদের সোনা মিয়ার গল্প বলব। সোনা মিয়াও দরিদ্র পরিবারের সন্তান। হালালভাবে ব্যবসায়-বাণিজ্য করে অঢেল অর্থবিত্তের মালিক বনে যান। তার সীমাহীন কর্তৃত্বপরায়ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিজের ব্যাপারে অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাস, নিজেকে সৎ পরিশ্রমী ও সফল প্রমাণ করার নিরন্তর চেষ্টা ও আশপাশের লোকজনকে উঠতে-বসতে অপমান এবং ছোট করার অভ্যাসের কারণে নিজ পরিবারে সোনা মিয়া খুবই বিরক্তিকর প্রাণীতে পরিণত হন।
স্ত্রী, সন্তান, ভাইবোনদের সাথে সম্পর্কের বিষ তৈরি হয়ে যায়। তিনি এক দিকে দু’হাতে অর্থ বিলিয়ে আপনজনদের মন জয়ের চেষ্টা করেন; অন্য দিকে অমানবিক ব্যবহারে সবাইকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করতে থাকেন। পরিবারের বিষময় পরিবেশ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বন্ধু-বান্ধবদের আড্ডায় জড়িয়ে পড়েন এবং নাস্তিকদের কবলে পড়ে ধর্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন।
উল্লিখিত অবস্থায় সোনা মিয়ার জীবনে এক ভারসাম্যহীন পরিবেশ তৈরি হয়ে যায়। এক দিকে মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ অন্য দিকে নাস্তিকতাবাদ। নিজে সৎ ও চরিত্রবান হওয়া সত্ত্বেও অসৎ এবং চরিত্রহীনদের সঙ্গ লাভের জন্য পাগলপারা হয়ে পড়েন। নিজের বিশ্বাসের কারণে মদ জুয়া নারীসঙ্গ ইত্যাদি কুকর্মের সাথে জড়ানোর মতো সাহস সোনা মিয়ার হয়নি।
কিন্তু যারা ওসব কর্ম করে তাদের কাছ থেকে আদি রসাত্মক রগরগে কাহিনী শোনার জন্য তিনি বিপুল অর্থ ব্যয় করে পাঁচতারকা হোটেলে আড্ডা বসান। পরে আবার অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে দুই হাতে দান-খয়রাত করতে শুরু করেন। এভাবে বছর পাঁচেক চলার পর সোনা মিয়ার ব্যবসায় লাঠে ওঠে। তার সুখের পাখিরা চলে যায়- আর পরিবারের লোকজন আগের মতো টাকাপয়সা না পেয়ে তার সাথে উঠতে-বসতে খারাপ আচরণ শুরু করে। ফলে সোনা মিয়া প্রকৃতির উল্টো প্রতিশোধের কবলে পড়ে অর্ধ-উন্মাদ হয়ে সামাজিক ও পারিবারিক চূড়ান্ত অশান্তির মধ্যে প্রতিদিন নিজের মৃত্যু কামনায় হাপিত্যেশ করতে থাকেন।
কালু মিয়া-সোনা মিয়ার জীবনের সাথে ধলা মিয়ার জীবনের কোনো মিল খুঁজে পাবেন না। আজকের নিবন্ধে ধলা মিয়ার বিষময় জীবন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে নিবন্ধের ইতি টানব। ধলা মিয়া তার জীবনে বিরাট একটি সময় বারবার ফেল করেছেন। শিক্ষা-দীক্ষা-নম্রতা-ভদ্রতা-পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে ধলা মিয়ার ফেল করার ঘটনা তাকে একসময় জীবনের প্রতি বিরাগ ও হতাশ করে তোলে।
তিনি যখন হতাশার সাগরে ডুবতে বসেছিলেন ঠিক সেই সময় প্রভাবশালী এক বয়স্ক মহিলার নজরে পড়েন এবং জীবনের সব ফেল করার রেকর্ড মাটিচাপা দিয়ে সফলতার নতুন অধ্যায়ের সন্ধান পেয়ে যান। তার পর অর্থ-অপরাধ ও অপকর্মের বিশাল এক নেটওয়ার্ক তৈরি করে অন্ধকার জগতের ডনে পরিণত হন। ধলা মিয়ার চরিত্রের প্রধান বিষ হয়ে দাঁড়ায় পরের ধনের প্রতি লোভ ও ছলেবলে কৌশলে অন্যের ধন হরণের মধ্যে তৃপ্তি লাভের অভিলাষ।
ধলা মিয়া অন্যের ধন-সম্পদ হরণের পাশাপাশি অন্যের স্ত্রী হরণের মাস্টারমাইন্ড হয়ে পড়েন। ফলে তার দাম্পত্য ও সংসার জীবনের বিষসমূহ কোনো সাধারণ বিষ নয়; বরং জটিল ও বিকৃত বিষে পরিণত হয়ে যায়। নিজের কুপ্রবৃত্তির সাধে রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং অঢেল অবৈধ অর্থ তাকে রীতিমতো নরপশু বানিয়ে ফেলে।
ভণ্ডামি-চালাকি-প্রতারণার হাজারো নিত্যনতুন স্টাইল আবিষ্কার করে ধলা মিয়া অপরাধের যে সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন সেখানে ইবলিশ শয়তানের শয়তানি বৃদ্ধি নিতান্ত বালখিল্য মনে হতে পারে। ফলে শয়তানির জগতে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ধলা মিয়ার উত্থান জ্যামিতিক হারে ঘটতে থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার জীবনে শুরু হয় বিপর্যয়। সারা দুনিয়া তার জন্য বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। মাশরেক থেকে মাগরেব পর্যন্ত প্রতিটি ভূখণ্ডে তিনি পালানোর জন্য এক টুকরো জায়গা খুঁজতে থাকেন। কিন্তু তার সৃষ্ট মানুষরূপী ইবলিশরা তার জন্য দুনিয়াকে বিষময় বানিয়ে ফেলেন। ফলে ধলা মিয়ার কাছে মৃত্যুই হয়ে ওঠে নিরাপদ আশ্রয়।
আমরা আজকের আলোচনার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। এবার শিরোনাম প্রসঙ্গে নিজের মন্তব্য পেশ করে নিবন্ধের ইতি টানব। আমার মতে, মানুষ যখন নিজের সীমা অতিক্রম করে কোনো চিন্তা শুরু করে ঠিক তখনই তার মস্তিষ্কে বিষ তৈরি হয়ে যায়। বিষাক্ত চিন্তার ফলে মনের মধ্যে এক ধরনের লালসা তৈরি হয় যা মস্তিষ্কের বিষের চেয়েও মারাত্মক। লালসার কবলে পড়া মানুষটি একসময় ভোগের লিপ্সায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তার সেই লিপ্সাগুলো সাধারণত ইন্দ্রিয়জাত হয়ে থাকে। নিজের ইন্দ্রিয়জাত লিপ্সাগুলো বাস্তবায়নের জন্য যে অন্ধকার জগত বেছে নেয় এবং অজ্ঞানতাকে হাতিয়ার বানিয়ে নির্বুদ্ধিতার গাড়িতে আরোহণ করে বসে। তারপর নিজের কাম-ক্রোধ হাতিয়ারকে কাজে লাগিয়ে নিজের জন্য একের পর এক বিষবৃক্ষ তৈরি করতে থাকে। তার তৈরি করা বিষবৃক্ষ প্রথমে তাকে বিষাক্ত করে তারপর তার আত্মীয়-পরিজন এবং পরবর্তীকালে তার আকার-আকৃতি অনুযায়ী দেশ-কাল-সমাজ ও রাষ্ট্রকে বিষময় করে তোলে। (লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য)