এইচ এম মেহেদী হাসান
ছাত্রলীগের ইতিহাস বাংলাদেশের ইতিহাস। শনিবার ৪ জানুয়ারী বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম প্রধান ও ঐতিহাসিক মাইলফলকের নাম বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। সারাবাংলার ছাত্র ও তারুণ্যের হৃদয়ের উত্তাপে জড়ানো অকুতোভয় এই সংগঠনের অভ্যুদয় নিশ্চিতভাবেই উপমহাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে অবিস্মরণীয় অধ্যায়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের কাটাছেঁড়ায় অস্তিত্ব সংকটে পড়ে শ্যামলা-সুফলা এই পূর্ব বাংলা। ধর্মান্ধ পাকিস্তানের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধের এই পুণ্যভূমিতে। ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি এবং আধিপত্যের আস্ফালন প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে পূর্ব বাংলার নাম পাল্টে রাখা হয় পূর্ব পাকিস্তান। মূলত পূর্ব বাংলার মাটির বর্ণাঢ্য গৌরবগাথা ক্ষত-বিক্ষত করতেই এমন অপচেষ্টা। অবশ্য জাতিসত্তায় সংশয় জাগানিয়া এমন কা- সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি বাংলার মানুষ, বিশেষ করে শিক্ষার্থী ও তরুণ সমাজ। দেশ ভাগের ছুতোয় দখলদার ইংরেজদের কুটিল মারপ্যাঁচে ভারতবর্ষ খ-িত হয় ভারত ও পাকিস্তান নামে আলাদা দুই রাষ্ট্রে। যে স্বপ্ন নিয়ে এই পূর্ব বাংলার মানুষ পাকিস্তানে যুক্ত হয়েছিল, সেই স্বপ্ন যে অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়বে তা মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই আঁচ করে নেয় ছাত্রসমাজ। প্রতিবাদের প্রথম আগুন ঝলসে ওঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের মধ্য দিয়ে। মেধাবী ও প্রগতিশীল ছাত্রসমাজের সম্মিলিত প্রয়াসে গড়ে ওঠা এই প্লাটফর্ম থেকেই পরবর্তীকালে ভাষা, স্বাধীনতা ও পূর্বাপর আন্দোলন-সংগ্রামের প্রেক্ষাপট প্রণীত হয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের একটি সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিল। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা-পরবর্তী ঘটনাপরিক্রমায় তাঁর এ পরিকল্পনার বিষয়টি স্পষ্ট হয়। দুরদর্শী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে সরকারবিরোধী শক্তির অনুপস্থিতিকে কাজে লাগান। শিক্ষার্থীদের সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েও ছাত্রলীগ শুরু থেকেই জাতীয় স্বার্থ ও জাতিগত মর্যাদা রক্ষায় একের পর এক লড়াই সংগঠিত করে তোলে এবং প্রতিটি পদক্ষেপ নেতৃত্ব জুগিয়েছে সামনে থেকে, ফলে ছাত্রসমাজ শুধু নয়, সাধারণ মানুষও সমর্থন জুগিয়েছে ছাত্রলীগের প্রতি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রলীগ যে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ক্ষেত্র নির্মাণে তা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। বলে রাখা ভালো ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত করা হয়। ১৯৪৮ সালের পর ছাত্রলীগ গণমানুষের অধিকার আদায়ের প্রতিটি আন্দোলন ও সংগ্রামে ঐতিহাসিক অবদান রেখেছে। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সার্বজনীন এবং সর্ববৃহৎ গণআন্দোলন সংগঠিত হয়েছে ১৯৫২ সালে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ও সাধারণ ছাত্রসমাজ মায়ের ভাষা রক্ষার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যায়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে ছাত্রলীগের সেই সংগ্রামের সাফল্যগাথা রচনা করেছে বাংলার মুক্তিকামী মানুষ, ছাত্রজনতা। কিন্তু এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নি¤œ বেতনভোগী কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের যৌক্তিক সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার মূল্য বঙ্গবন্ধুকে শোধ করতে হয়েছে শিক্ষাজীবনের ইতি টেনে।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনটি ইতিহাসে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন বলে পরিচিত। বহু রাজনীতিক ও ইতিহাসবিদ যুক্তফ্রন্ট গঠনের এই প্রসঙ্গটিকে আগের বছর ছাত্র সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক যুবফ্রন্ট গঠনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। তারা বলতে চেষ্টা করেন, ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ নেতৃত্বাধীন এই জোট গঠনের ঘটনাই নাকি পরের বছর সাধারণ পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রেরণা জুগিয়েছে। কিন্তু এ তুলনা কেবল ভুলই নয়, ইতিহাসের বিকৃতিও বটে। কারণ গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট ছিল ছাত্রলীগের নেতৃত্বে এই ভূখ-ের তরুণ প্রজন্মকে সাম্প্রদায়িক শক্তির কবল থেকে মুক্ত করার ঐতিহাসিক এক পদক্ষেপ। যে জোট গঠিত হয়েছিল সময়ের প্রয়োজনে। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছে ক্ষমতালোভী ষড়যন্ত্রকারী চক্রের ইন্ধনে। যারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছিল, সেই চক্রান্তকারীদের। বঙ্গবন্ধুর অভূতপূর্ব সাংগঠনিক দক্ষতা ও অক্লান্ত পরিশ্রমে ওই নির্বাচনের আগে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ যে অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছিল, তার সামনে মুসলিম লীগের মতো অজনপ্রিয় দলের টিকতে পারার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। বিরোধীদের ভয় ছিল, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতে যায়, তাহলে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায়ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একচ্ছত্র প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হবে। সেই ভয় থেকেই মুসলিম লীগ থেকে স্বার্থের গোলমালে নেতারা রাতারাতি কৃষক শ্রমিক প্রজা পার্টি নামে দল প্রতিষ্ঠা করলেন। ছত্রছায়া হিসেবে বেছে নেওয়া হলো একে ফজলুল হককে। নতুন করে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে শেরে বাংলার আগমন ঘটল এর মধ্য দিয়ে। তখনও পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনে তাকে নিয়ে মোহ ছিল। এই আবেগকে কাজে লাগাতে চেয়েছে স্বার্থান্বেষী মহল। দুঃখজনক হলেও সত্যি, শেরে বাংলার মতো মহান রাজনীতিবিদ বুঝে কিংবা না বুঝেই সেই ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়েন। মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিবুর রহমান ওই দলের সঙ্গে জোট বাধার পক্ষপাতি ছিলেন না। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে ২১ দফা দাবি জনগণের সামনে তুলে ধরতে সবচেয়ে জরুরি ভূমিকা পালন করেছে ছাত্রলীগ।
পাকিস্তানের তখনকার গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ আঁচ করেছিলেন, পূর্ব বাংলায় যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামের সূত্রপাত ঘটে ছাত্রসমাজের উদ্যোগের মধ্য দিয়ে। বিশেষ করে ছাত্রলীগ যেন বাড়তে না পারে সে জন্য নানা উদ্যোগ নেন। অবশ্যই প্রতিটি উদ্যোগই ছিল অনৈতিক, অবৈধ এবং বেআইনিও। ছাত্রলীগই যেহেতু সব আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে, তাই ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ওপর ১৯৫৪ সালের পর ব্যাপক নির্যাতন শুরু হয়। বিশেষ করে ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আগে দমন-পীড়নের মাত্রা বাড়ে। ওই বছরের আয়োজনে যেন ছাত্র-জনতা জমায়েত হতে না পারে সেজন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু অশুভ শাসন কখনও শুভ উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে না- এ কথা আরও একবার প্রমাণ হয় ১৯৫৫ সালের ‘শহীদ দিবসে’। এই দিনের আনুষ্ঠানিকতা ঠেকাতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার নজিরবিহীন চাপ প্রয়োগ করে। সেদিন ২১ ফেব্রুয়ারি ভোরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে ফেলে পুলিশ। চলে ব্যাপক ধরপাকড়। তবে জাতিগত ঐক্যের এই পবিত্র দিনে আবারও গণজোয়ার ঘটিয়ে বিক্ষিপ্ত বাঙালিকে তাদের আদর্শে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালায় ছাত্রলীগের নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। যদিও তখন ছাত্রলীগের অধিকাংশ শীর্ষ নেতাই কারাবন্দী কিংবা পলাতক। তার পরও সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নেতাকর্মীদের কর্মসূচি পালন ঠেকাতে পারেনি। সরকারের নির্দেশে ছাত্রলীগসহ অন্যান্য সংগঠনের এত নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছিল যে, কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ঢাকার লালবাগ কেল্লায় তৎকালীন পুলিশ সদর দপ্তরে তাঁবু খাটিয়ে বন্দীদের আটকে রাখা হয়েছিল। কেবল ছাত্র নয়, গ্রেফতার করা হয়েছিল অন্তত দেড়শ ছাত্রীকেও। তাতেও ছাত্রী জনতার আবেগ দমানো যায়নি। পুলিশি নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি স্কুলছাত্ররাও। তারুণ্যের বুকে দেশ ও ভাষার প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা নিশ্চিতভাবেই ছাত্রলীগের নেতৃত্বে চলমান ধারাবাহিক আন্দোলন কর্মসূচির মধ্য দিয়েই বিকশিত হয়েছে। শাসকের চোখ রাঙানি তাতে বাদ সাধতে পারেনি। বরং ছাত্র-তরুণের এমন অটল অবস্থান ব্যাপক আলোড়ন তোলে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গভর্নর শাসন রদ করে আবারও যুক্তফ্রন্টকে সরকার গঠনের আহ্বান জানায় কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু এই সরকার থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগকে দূরে রাখতেও সর্বোচ্চ চক্রান্তের আশ্রয় নেয় তারা। এদিকে ১৯৫৫ সালে কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আবারও আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ বছর আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়।
১৯৬০-১৯৬৩ সাল মেয়াদে শেখ ফজলুল হক মনির সুযোগ্য নেতৃত্বে ছাত্রলীগ ঐতিহ্যের পুনরুত্থান ঘটায় এবং আন্দোলনে উত্তাল করে তোলে পূর্ব বাংলার আকাশ-বাতাস। ১৯৬২ সালের পুরোটাই ছিল আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে মুখর। ১৯৬২ সাল বাংলার ইতিহাস বিখ্যাত হয়ে আছে শিক্ষা নীতিবিরোধী আন্দোলনের জন্য। এই আন্দোলন কর্মসূচির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চরিত্রের নাম শেখ হাসিনা। আজকের প্রধানমন্ত্রী, বিশ্বের সফল রাষ্ট্রনায়ক দেশরতœ শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কর্মকা-ে সক্রিয় অংশগ্রহণ ১৯৬২ সালে কুখ্যাত শরিফ শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তিনি তখন আজিমপুর গার্লস স্কুলের ছাত্রী। অবশ্য পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জাতীয়তাবাদী ও প্রতিবাদী চেতনার চর্চা শুরু হয়েছিল আগেই। ১৯৬০ সালে তিনি যখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী, তখন ‘সামাজিকপাঠ’ বিষয়ে এক ক্লাস পরীক্ষায় ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নিয়ে একটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে নিজের ভাবনা তুলে ধরেন এবং তাদের অগণতান্ত্রিক বিষয়গুলো উল্লেখ করে এর প্রতিবাদও জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্কুল কর্তৃপক্ষ শেখ হাসিনাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে অভিভাবককে ডেকে পাঠায়। তাঁর বাবা আজন্ম প্রতিবাদ সংগ্রামের প্রতীক হয়ে ওঠা শেখ মুজিবুর রহমান তখন সামরিক সরকারের বুকে আতঙ্ক তোলা এক নাম হয়ে কারাবন্দী। গৃহশিক্ষক পরিমল কান্তি সাহা শেখ হাসিনার অভিভাবক হিসেবে সেদিন স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করেন। শেখ হাসিনা তাতে দমে যাননি। বাবার সূত্রে পারিবারিকভাবেই বড় হয়েছেন রাজনৈতিক আবহে। সেই আবহ কিন্তু আনন্দ বা উদযাপন মুখর ছিল না। অত্যাচারী শাসকদের রোষের মুখে বারবার কারাবরণ করতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে, আন্দোলন সংগ্রামে দীর্ঘ দিবস রজনী কেটেছে রাজপথ থেকে রাজপথে ঠিকমতো স্ত্রী সন্তানদেরও সময় দিতে পারেননি। পিতা মুজিবের এমন দুঃসহ জীবন সংগ্রাম দেখেও শেখ হাসিনা নিরুৎসাহিত হননি। বরং দেশ ও জাতির কল্যাণে বাবার এমন ত্যাগ তাঁকে আন্দোলিত করেছে, প্রাণিত করেছে। তাই তো এখনও বাবার অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে অবিচল বন্ধুর পথ পেরিয়ে চলেছেন শেখ হাসিনা। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ছিলেন নিজের বিশ্বাসের প্রতিনিধি, অকুতোভয়। মত প্রকাশে কখনও ভীত হননি তিনি। স্পষ্টভাষী এবং সজ্জন ছিলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ যদি বোনা হয়ে থাকে ১৯৫২ সালে, তবে সেই বীজ মাটি ফুঁড়ে দৃশ্যমান হয়েছিল ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে তাঁর প্রণীত ছয় দফার মাধ্যমে। তাঁর রাজনৈতিক তীক্ষè দৃষ্টি দিয়ে বাঙালির মনোভাব বুঝতে পেরেই সেদিন অনেক রাজনৈতিক সহকর্মীর আপত্তিও সত্ত্বেও বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা প্রণয়ন করেছিলেন। বাঙালির এই মুক্তির সনদ ৬ দফার প্রতিটি শব্দের সঙ্গে মিশে আছে ছাত্রলীগের ঘাম ঝরানো ইতিহাস। এই ৬ দফা বঙ্গবন্ধু আর কারও হাতে নয়। তিনি তাঁর প্রিয় ছাত্রলীগের হাতেই এই ৬ দফাকে বাঙালির প্রতিটি ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তুলে দিয়েছিলেন অক্ষরে অক্ষরে। ৬ দফা প্রণয়নের পর থেকে ছাত্রলীগের অলিখিত গঠনতন্ত্রই হয়ে ওঠে এটি। যে কোনো মূল্যে ৬ দফা বাস্তবায়নই হয়ে ওঠে ছাত্রলীগের মূল লক্ষ্য। ৬ দফার প্রশ্নে পূর্ব বাংলার জনগণের এমন মারমুখী একরোখা মনোভাবকে ভিন্ন খাতে পরিচালিত করার জন্য ১৯৬৮ সালের শুরুর দিকে আইয়ুব খান তার কিছু দোসর এবং পাকিস্তানি পরামর্শদাতার পরামর্শে নতুন এক ইস্যু সামনে নিয়ে আসে। ৬ দফা প্রণয়ের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে এবং ছাত্রলীগ প্রতিটি ক্যাম্পাসে যেভাবে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে, তা দেখে ক্ষমতাসীনরা ঘাবড়ে গেল। সেই জনপ্রিয়তা থেকে আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগকে হটানোর জন্য নানা ফন্দি আটতে থাকে তারা। তাদের হাতে তখন একটি পথই খোলা ছিল আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে ধ্বংস করে দেওয়া। আর তা হলে যাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের পেছনে বাংলার আপামর জনতা এক হয়েছে, সেই প্রাণভোমরা শেখ মুজিবুর রহমানকে শেষ করে দেওয়া। ১৯৬৬ সালের মাঝামাঝি থেকেই তিনি ছিলেন অন্ধকার কারাগারে। ৬ দফা প্রণয়নের পরপরই তাঁকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে কারাগারে আটক করা হয়। আইয়ুব খানের গোয়েন্দা বাহিনীর প্রতিবেদন এবং রাজনীতির বিচার-বিশ্লেষণ যখন কোনোভাবেই তাকে কোনো প্রকার সুখের খবর দিতে পারছিল না, তখনই মাথা মোটা আইয়ুব খান ১৯৬৫ সালের ভারত আক্রমণের মতো আরেক মাথা মোটা সিদ্ধান্ত নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে একটি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দিয়ে তাকে সামরিক আদালতে হত্যা করতে চাইল। যেই মামলাটি পরে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে ব্যাপক পরিচিতি পায়।
শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার দেখিয়ে বিচার কার্যক্রম শুরু করলে ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিচার প্রক্রিয়া প্রকাশ্যে করার দাবি জানানো হয়। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বুঝতে আর বাকি রইলো না আসন্ন যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তাদের সদা প্রস্তুত হয়েই থাকতে হবে। পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর মরণকামড় হানার জন্যই পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠী শেখ মুজিবকে হত্যার নীলনকশা করছে। ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বুঝতে পারে যে, এই মামলায় শেখ মুজিব দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি কেবল পূর্ব বাংলার জনগণের লালিত স্বাধীনতারও মৃত্যু ঘটবে। এই উপলব্ধি থেকেই ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের নেতারা সিদ্ধান্ত নেন, আপাতত অন্যান্য কর্মসূচি কিছুটা শিথিল করে যেভাবেই হোক বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করা। প্রাথমিক পরিকল্পনা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের মামলা মোকাবেলা করার জন্য আইনগত কৌঁসুলি নিয়োগ দেওয়া হয়। যার জন্য ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নেতৃত্বে কৌঁসুলির ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য চাঁদা উঠানো হয়। চাঁদা উঠানোও মূল উদ্দেশ্য ছিল না। মূলত চাঁদা উঠানোর মাধ্যমে নিজেদের মধ্যকার যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করাই ছিল আসল লক্ষ্য। ১৯৬৮ সালের সে সময়কার ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস ঘাটতে গেলে বারবার জগন্নাথ কলেজের ছাত্রলীগের অসামান্য অবদান উঠে আসে। জগন্নাথ কলেজ ছাত্রলীগের আহ্বানে শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা মামলায় জড়ানোর প্রতিবাদে ধর্মঘট পালিত হয়। ১১ দফা, গণঅভ্যুত্থান, নির্বাচন ও যুদ্ধের প্রস্তুতিতে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল ইতিহাসের তাৎপর্য ঘটনা।
ছাত্রলীগ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করত, যারা ৬ দফায় বিশ্বাস করে না,তারা ১১ দফাও মানে না। কারণ ১১ দফার মধ্যেই ৬ দফা আছে। ৬ দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন অর্জন এবং ১১ দফা বাস্তবায়ন প্রচেষ্টাই ছিল ছাত্রলীগের ধ্যানজ্ঞান। সে সময় ১১ দফার প্রতি মওলানা ভাসানীর বিরোধিতাকে ছাত্রলীগ রাজনীতির নামে সুবিধাবাদ বলেই মনে করত। জাতীয়তাবাদী ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমেই গণতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্যে ছাত্রলীগ জীবনবাজি রেখেছিল।
১৯৬৯ সালে আগরতলা মামলায় পিতা শেখ মুজিব যখন কারান্তরীণ, তখন কন্যা শেখ হাসিনা রাজপথে প্রত্যক্ষ আন্দোলনের পাশাপাশি জেলগেটে পিতার সঙ্গে দেখা করে যাবতীয় দিকনির্দেশনা নিয়ে আসতেন ও ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বারবার বৈঠক করে আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণ করতেন। আন্দোলন-সংগ্রামের সরঞ্জাম ক্রয়ের জন্য যে টাকা -পয়সা খরচ হতো বিশেষ করে ছাত্রলীগ নেতাদের খরচের বিষয়টি শেখ হাসিনা তাঁর মা বেগম মুজিবকে জানাতেন। বেগম মুজিব কারাগারে বন্দি শেখ মুজিবের অনুপস্থিতি বুঝতেই দিতেন দিতেন না ছাত্রনেতাদের। তিনি নিজের সোনা গহনা বিক্রি করে, বাজারের খরচ বাঁচিয়ে আঁচলে বেঁধে রাখা ছাত্রলীগ নেতাদের হাতে তুলে দিতেন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত আন্দোলন-সংগ্রামের উত্তাল দিনগুলোতে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ওপর জেল-জুলুমের মাত্রা যখন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে, তখন কেউই নিজের ঘরে ঘুমাতে পারতেন না। মাথায় গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে বহুদিনে আত্মগোপনকারী ছাত্রনেতাকর্মীরা ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘর্মাক্ত শরীরে ৩২ নম্বর বাড়িতে গভীর রাতে ঢুকলে বেগম মুজিব সর্বাগ্রে সাবান, গামছা, তেল এগিয়ে দিতেন গোসলের জন্য। তারপর নিজের হাতে রান্না করে মায়ের স্নেহে পাশে বসে খাওয়াতে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তাঁর এমন অপার্থিব মমতা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের পুরোদমে চাঙ্গা রাখত। ছাত্রলীগের নেতৃত্বাধীন ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের প্রথম কর্মসূচি ছিল ১৭ জানুয়ারি। ছাত্রলীগ ১৯৬৯ সালের ১৭ থেকে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ১১ দফা সপ্তাহ পালনের ঘোষণা দেয়। ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি তোফায়েল আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক আসম আবদুর রব এক যৌথ বিবৃতিতে শত শহীদের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক ১১ দফা রচনার পটভূমি ও ১১ দফা বাস্তবায়নের জন্য ছাত্রলীগকে অবিরাম আপসহীন সংগ্রামের নির্দেশনা দেন। ছাত্রলীগের ঘোষণা অনুযায়ী সারাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট, চিত্র প্রদর্শনী, ছাত্রসভা, শোভাযাত্রা, শোক মিছিল, সাইকেল শোভাযাত্রা, কর্মীসভা, দাবি দিবস পালন করা হয়। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যখন বুঝতে পারে যে, পূর্ব পাকিস্তানে তাদের শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের পরিণতি খুব খারাপের দিকে যাচ্ছে, তখন তারা নতুন করে প্রজন্মের মগজধোলাই করার জন্য মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি নামে একটি নতুন পাঠ্যবিষয় সংযুক্ত করে। স্কুল ছাত্রছাত্রীরা তখন এই বিষয় বাতিলের জন্য আন্দোলন শুরু করে সব ছাত্রসংগঠনের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। ছাত্রলীগ স্বাধিকার তথা স্বাধীনতার জন্য বৃহৎ আন্দোলন নিয়ে থাকায় প্রথমে ছাত্রদের এই প্রস্তাবে মৌন সমর্থন দিলেও পরে ঢাকা নগর ছাত্রলীগের মাধ্যমে স্কুলছাত্রদের এই আন্দোলনকে সর্বদলীয় রুপ দিয়ে গভ.ল্যাবরেটরি স্কুলের মেধাবী ছাত্র মোস্তাক আহমেদ ও আজিমপুর গার্লস স্কুলের কৃতি ছাত্রী রোজীকে যথাক্রমে আহবায়ক এবং যুগ্ম আহ্বায়ক করে মাধ্যমিক স্কুল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে দেওয়া হয়। পরে পুরান ঢাকার সর্বস্তরের স্কুলে এই আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নবাবপুর হাইস্কুলের ছাত্র আবু বকরকেও যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়। এ সময় ছাত্রলীগের নগর কর্মীরা ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে এ আন্দোলনের বিরাট অংশ ছাত্রলীগের ভাগে চলে আসে এবং এর ফলে স্কুলগুলোতে বিশেষ করে মেয়েদের স্কুল সংগঠন গড়ে তোলা হয়। আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করলে ছাত্রসমাজের চাপে পাকিস্তানি শাসকচক্র এই বই প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। এই আন্দোলনের সফলতা ছাত্রলীগকে এনে দেয় এক বিরাট সাফল্য। ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে সীমিত পরিসরে ঘরোয়া রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের অনুমতি দেয় ইয়াহিয়া সামরিক সরকার। ৩০ মার্চ অপর এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের অধীনে ৭ ডিসেম্বর সমগ্র পাকিস্তানে নির্বাচনের ঘোষণা দেন। এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রাণশক্তি ছাত্রলীগ নির্বাচনী প্রচার ও গণসংযোগে নেমে পড়ে। এর আগের বছরের গণঅভ্যুত্থানের ফলে ছাত্রলীগ সাধারণ মানুষের আপনজনে পরিণত হয়েছিল। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ছাত্রলীগ ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে স্বাধিকারের প্রশ্নে গণভোট হিসেবে গ্রহণ করে দেশের আনাচে কানাচে নির্বাচনী প্রচারে নেমে পড়ে। দেশের যেসব এলাকার আসনগুলো অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং সংবেদনশীল ছিল সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে ছাত্রলীগ নেতাদের নির্দেশনা দিয়ে পাঠাতেন। অনেক সময়ে স্থানীয় সমস্যার কারণে সরাসরি প্রার্থীর পক্ষে প্রচার করা সম্ভব ছিল না। সেসব ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এককভাবে নৌকার প্রার্থীর পক্ষে, স্বাধিকারের পক্ষে প্রচার চালাতেন। ৬ দফা এবং ১১ দফা মানুষের কাছে তুলে ধরতেন। ৪ জুন বঙ্গবন্ধু আসন্ন নির্বাচনে অংশ নিতে দেশবাসীকে আহ্বান জানান। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্বপাকিস্তানের ১৬২ টির মধ্যে ১৬০টি আসনে জয়লাভ করেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী। ৭টি সংরক্ষিত মহিলা আসন মিলিয়ে আওয়ামী লীগের মোট আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬৭টি। আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের ১৩৮টি আসনের মধ্যে ৮৭টি আসনে জয় পায় পিপলস পার্টি। প্রাদেশিক নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৮৮টি আসনে জয়লাভ করে। এই ভূমিধস বিজয় সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া এবং ভুট্রোদের সব হিসাব ওলটপালট করে দেয়। তাদের ধারণা ছিল, আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে জিতলেও পুরো পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না এবং বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি বানানোর টোপ দিয়ে ৬ দফা থেকে সরিয়ে আনা যাবে। কিন্তু নির্বাচনী ফলে তাদের বাসনা ভেস্তে গেল। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের সব নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য এবং প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের ৬ ও ১১ দফার প্রতি অবিচল থাকার শপথবাক্য পাঠ করান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর পরদিন ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে পল্টনের জনাকীর্ণ সমাবেশে ছাত্র-জনতাও শপথ নেয় এসব দাবি আদায়ের সংগ্রামে অটল থাকার। এই কঠোর শপথের ফুলকি থেকেই একাত্তর নামক আগ্নেয়গিরির উৎপত্তি। ১৯৭০ সালের ৭ জুন ৬ দফা দিবস উদযাপনকে একটি ঐতিহাসিক
মাত্রা দেয়ার লক্ষ্যে ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ হাতে নিতে শুরু করল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দিকনির্দেশনাকে অবলম্বন করে তারা নিজেদের মধ্যে কয়েক দফায় বৈঠকও করল। বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগ নেতাদের একটি স্বতন্ত্র পতাকা তৈরির নির্দেশনা দিয়েছিলেন। নির্দেশনা মোতাবেক ছাত্রলীগের নেতারা পতাকা তৈরি করলো। ১৯৭০ সালের ৭ জুন সকাল ৯টায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শহীদ মিনারে জড়ো হয়ে আ স ম আবদুর রব ও শেখ শহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে গগনবিদারী স্লোগানে রাজপথ কাঁপিয়ে এগিয়ে যায় পল্টন ময়দানের দিকে। সেখানেই বঙ্গবন্ধুকে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানানো হয় ওই পতাকা দিয়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাগ্রহে সেটি গ্রহণ করে পাশে দাঁড়ানো বড় ছেলে শেখ কামালের কাছে গচ্ছিত রাখেন। সভা শেষে বঙ্গবন্ধু আ স ম আবদুর রবের হাতে পতাকাটি তুলে দেন। রব হাঁটু গেড়ে পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে তা গ্রহণ করেন। সেদিন ছাত্রনেতাদের হাতে বঙ্গবন্ধু পতাকা টি তুলে দিয়ে মূলত পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অত্যাসন্ন ও অনিবার্য সম্মুখ সময়ের প্রস্তুতি গ্রহণের চূড়ান্ত নির্দেশনা দিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগ নেতা কর্মীরা দলে দলে অংশগ্রহণ করেছে। ১৭০০০ নেতা-কর্মীর শাহাদাৎ বরণের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রচনা করেছে বাংলা ও বাঙালির পরম প্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ১৯৭২-৭৫ কালপর্বে দেশগড়ার সংগ্রাম, ১৯৭৫-৯০ সময়ে সামরিক শাসন বিরোধী সংগ্রাম, ১৯৮৩ সালে শিক্ষা আন্দোলন ও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের দশ দফা রচনায় ছাত্রলীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ১৯৯১-৯৬ সময়ে তত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনে ছাত্রলীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ১৯৯৬-২০০১ সালে দেশগঠন মূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি শিক্ষার অধিকার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে শামসুল হক ও পরবর্তীতে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী কমিশনের সহায়তায় এগিয়ে আসে এবং শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট তৈরিতে সহায়তা করে। ১৯৯৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদী আন্দোলনে ছাত্রলীগ সমর্থন দেয়। এই সময়ে বন্যা পরবর্তী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা অসামান্য অবদান রাখে। বিএনপি জামাতের ৯২ দিনের জালাও পোড়াও আগুন সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সাথে নিয়ে প্রতিবাদ করেছে ছাত্রলীগ। কিন্তু আজ ছাত্রলীগকে অনেক নেতিবাচক সংবাদের শিরোনামে দেখা যায়। তবেও কি কিছুটাও হলেও ছাত্রলীগের সুনামে ভাটা পড়ছে? তবে মনে হয় না, কিছু কৌশলগত কারণে ছাত্রলীগ হেরে যাচ্ছে। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি বিএনপি জামাতের অপপ্রচার ও তাদের দোসরেরা ছাত্রলীগের ভিতরে অনুপ্রবেশ করে ছাত্রলীগকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা বৈকি আর কি? সারা বিশ্বের সফল রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা’র নেতৃত্বে যখন পিতা মুজিবের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ উন্নয়ন ও শান্তির রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। সারা বিশ্বের বিস্ময় সৃষ্টি হয়েছে। স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়তে ছাত্রলীগ যেহেতু শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত ভ্যানগার্ড হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে, তাই শেখ হাসিনাকে বিব্রত করতেই ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমেছে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি। তবে সব অপশক্তির জাল ছিন্ন করে ছাত্রলীগ তার আপন মহিমায় সগৌরবে এগিয়ে যাবে। তাই আজ ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে,১৯৪৮ সাল থেকে আজ পর্যন্ত বাঙালি জাতির শান্তিতে সংগ্রামে দুর্যোগে দূর্বিপাকে ছাত্রলীগ পাশে ছিল, আজো তাই-ই আছে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাই যথার্থই বলেছেন, ছাত্রলীগের ইতিহাস, বাঙালির ইতিহাস। ছাত্রলীগের ইতিহাস বাংলাদেশের ইতিহাস।
লেখক : কলামিস্ট, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সহ সভাপতি