নিজস্ব প্রতিবেদক : রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ জানিয়েছেন, তিনি জীবনে অনেক পরীক্ষায় ফেল করেছেন, তবে কখনো পাস করার জন্য নকলের মতো অনৈতিক পথ অবলম্বন করেননি। এমনকি পাশের কাউকে জিজ্ঞেসও করেননি। এটা তার জীবনের অহংকার এবং এটা নিয়ে তিনি গর্ববোধ করেন।
শনিবার দুপুরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্য দিচ্ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির আচার্য ও রাষ্ট্রপতি। রাজধানীর গেন্ডারিয়ার ধূপখোলা মাঠে এই সমাবর্তনের আয়োজন করা হয়।
আক্ষেপ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘কিন্তু আজ শুনি শিক্ষকরা ছাত্রদের কাছে নকল সাপ্লাই করে। অনেক জায়গায় শোনা যায় অভিভাবকরা নকল সাপ্লাই করে। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে। এদের কী শাস্তি হতে পারে। মনটা চায় আর কইলাম না… বুইঝ্যা নিয়েন… ।’
পরীক্ষায় নকল প্রবণতা ও অনৈতিক পন্থা অবলম্বনের কারণে দেশ ও জাতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে জানিয়ে এর বিরুদ্ধে সবাইকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে আহ্বান জানান রাষ্ট্রপ্রধান।
নিজের জীবনের স্মৃতিচারণ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আমি ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচন করি। সে নির্বাচনে আমি ছিলাম গোটা পাকিস্তানে সর্বকনিষ্ঠ প্রার্থী। সত্তরের ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলাম। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তানের পার্লামেন্টে যেতে পারিনি।’
আবদুল হামিদ বলেন, ‘রাজনীতির কারণে যথাসময়ে ডিগ্রি পাস করতে পারিনি। ১৯৬৯ সালে ডিগ্রি পাস করি। ৭১ সালে ল’ পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের কারণে তা সম্ভব হয়নি। দেশ স্বাধীনের পর ৭২ সালে ল’ পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়। চার পেপারে পরীক্ষা। তখন সারাদেশের পরীক্ষা হয়েছিল জগন্নাথ কলেজে। আমিও সেই পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলাম।’
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘পরীক্ষা যখন দিতে গেলাম দেখলাম সবাই মোটা মোটা বই দেখে লিখে যাচ্ছে। বই সামনে ছাড়া খুব কমই দেখেছি। আমি তখন বাংলাদেশের গণপরিষদের সদস্য। ভাবলাম, আমি যদি এই কাজটি করি তাহলে কেমন হয়! মাঝে মাঝে সাংবাদিকরাও আসছে। তারা যদি কিছু লেখে! পরে সিদ্ধান্ত নিলাম, কপালে যা আছে হবে কিন্তু বই দেখব না। যা পারি তাই লেখলাম। ফলাফলে চার সাবজেক্টের মধ্যে দুই সাবজেক্টে পাস করি আর দুই সাবজেক্টে ফেল করি। পরে অবশ্য ১৯৭৪ সালে ভালোভাবে পড়াশোনা করে ল’ পরীক্ষা দিয়ে পাস করি।’
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে আবদুল হামিদ বলেন, ‘আমি যদি তখন নকল করতাম আর পত্রিকায় আসতো তাহলে তো আজ তোমরা বলতে, বেটা নকল করে পাস করেছ, এখন বড় বড় কথা বলো।’
ট্রাফিক আইন মেনে চলার আহ্বান
রাষ্ট্রপতি তার বক্তৃতায় ট্রাফিক আইন মেনে চলতে সবার প্রতি আহ্বান জানান। বলেন, ‘প্রায় সাত বছর ধরে জেলখানারই মতোই বঙ্গভবনে আছি। রাস্তায় স্বাধীনভাবে হেঁটে যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে টেলিভিশনে দেখি, ওভারপাস আছে অথচ রিস্ক নিয়ে সমানে নিচ দিয়ে মানুষ পারাপার করছে।’
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘ডিসিপ্লেন না মানলে কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না। তোমাদেরকে অনুরোধ, মানুষকে এ ব্যাপারে বোঝাও। এভাবে যত্রতত্র রাস্তা ক্রস করা ঠিক না। যেখানে ব্যবস্থা নেই সেখানে অন্য কথা। সবাইকে নিজে সচেতন হতে হবে এবং অন্যদেরও সচেতন করতে হবে।’
রাষ্ট্রপতি জানান, বিদেশিরা এসে আমাদের চাল-চলন দেখে হতাশ হয়। এজন্য সবার প্রতি অনুরোধ, বিষয়টি ভেবে দেখবেন।’
রাজনৈতিক জীবনের স্মৃতিচারণ
সমাবর্তনে সভাপতির বক্তৃতায় রাষ্ট্রপতি তার রাজনৈতিক জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। বলেন, ‘তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের সঙ্গে সম্পর্ক অনেক আগে থেকে। আমি একটা ছাত্র সংগঠন করতাম। জেলা সভাপতি ছিলাম। কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজে আমি তখন ভিপি ছিলাম। তখন জগন্নাথে ২৪/২৫ হাজার ছাত্র ছিল। ভিপি ছিলেন রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু। কাজী ফিরোজ রশিদও তখন ছাত্রলীগ করতেন।’
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘জগন্নাথের ছাত্ররা না গেলে ছাত্রলীগের কোনো প্রোগ্রাম পূর্ণাঙ্গ হতো না, জমতো না। আন্দোলন-সংগ্রামে জগন্নাথ কলেজের অবদান কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আমিও পারি না।’
আবদুল হামিদ বলেন, ‘আজ আমি আবদুল হামিদ, রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু, ফিরোজ রশিদ, আজ আমাদের তিনজনের পথ তিন দিকে। রাজু সংসদ সদস্য, তিনি একটা দল করেন। ফিরোজ রশিদও সংসদ সদস্য, তিনি আরেকটা দল করেন। আর আমি কোনো দলেই নাই। আমি সব দলই করি, আবার কোনোটাই করি না। আজ তিনজনের পথ তিন দিকে।’
যথারীতি হাস্যরস
প্রায় প্রতিটি সমাবর্তনেই রাষ্ট্রপতি তার নির্ধারিত বক্তব্যের বাইরে কিছুটা সময় হাস্যরসপূর্ণ বক্তব্য দেন। আজও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
লিখিত বক্তব্য পাঠের শেষ পর্যায়ে বলেন, ‘অনেক কিছু বলার ছিল। বললেই সমস্যার সৃষ্টি হয়। বঙ্গভবন এখান থেকে খুব দূরে নয়। আজ অন্য একটা সমস্যা। বৌ-মা, মানে আমার বড় ছেলের বউ এসেছে আমার সঙ্গে। সে এসেছে না শাশুড়ি পাঠিয়েছে জানি না। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে দুয়েকটা কথা বলে ফেলেছিলাম, যাতে না বলতে পারি সে জন্য হয়ত পাঠিয়েছে। তবে সে জগন্নাথ কলেজ থেকে পাস করেছে। এজন্য সাবেক ছাত্রী হিসেবে এসেছে বলে জানিয়েছে।’
রাষ্ট্রপতি বলেন, মঞ্চে বসে আছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। তিনি ডাক্তার আবার অ্যাডভোকেটও। সমাবর্তনে আমার পাশেই বসেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি আমাকে সাপোর্ট দেবেন বলে মনে হয় না। নারীদের সমর্থন নারীদের দিকেই থাকবে।
রাষ্ট্রপতির এই বক্তব্যে উপস্থিত শিক্ষার্থী ও অতিথিদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে যায়।