নিজস্ব প্রতিবেদক : ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে রাজধানী উন্নয়ন কর্পোরেশন যেনো রুপান্তরিত হয়েছিল হাসিনা উন্নয়ন কর্পোরেশনে তার চাটুকার ও চ্যালাদের নিজের খেয়াল খুশিমতো বরাদ্দ দিয়েছেন হাজার কোটি টাকা মূল্যের প্লট ও ফ্ল্যাট। যেকারণে গত ১৫ বছরে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ (জাগৃক) থেকে যেসব ব্যক্তি প্লট-ফ্ল্যাট নিয়েছেন, তাদের তালিকা হালনাগাদ করছে সরকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্দেশে এরই মধ্যে রাজউক থেকে সংশ্লিষ্ট বিভাগে চিঠি ইস্যু করা হয়েছে।
এ চিঠির আলোকে গত ১৫ বছরের মধ্যে কে, কখন, কোথায়, কীভাবে, কোন ক্যাটাগরিতে সরকারি প্লট ও ফ্ল্যাট নিয়েছেন তার তালিকা করে সরকারের কাছে দিতে বলা হয়েছে। তালিকা পাওয়ার পর সরকার সিদ্ধান্ত নেবে প্লট থাকবে নাকি বাতিল হবে। জানা গেছে, তালিকায় খোদ শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নামও রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছেন সাবেক স্পিকার, মন্ত্রী, এমপি, মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি, সাংস্কৃতিক কর্মী, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবীর নাম।
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের প্লট দিতে গিয়ে পূর্বাচলে ক্ষতিগ্রস্তরা বঞ্চিত হয়েছেন। সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে রাজউক নিজেও বিপাকে পড়েছে। পাশাপাশি রাজউকের কেউ কেউ বাগিয়ে নিয়েছেন প্লট ও ফ্ল্যাট।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যরা মিলে নিয়েছেন ৬০ কাঠার সরকারি প্লট। রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারের ১৩/এ ধারার ক্ষমতাবলে তাদের প্লট দেওয়া হয়। ২০২২ সালে তারা প্লট বুঝে পান। পরে বিষয়টি রাষ্ট্রীয় অতি গোপনীয় বিষয় হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যরা প্রত্যেকে সর্বোচ্চ ১০ কাঠা আয়তনের প্লট নিয়েছেন।
পূর্বাচলে প্রস্তাবিত কূটনৈতিক জোন ২৭ নম্বর সেক্টরের ২০৩ নম্বর রোডে তার প্লট নম্বর ০০৯। ২০২২ সালের ৩ আগস্ট তার নামে বরাদ্দপত্র ইস্যু করে রাজউক। শেখ হাসিনার বাসভবন ধানমন্ডির ৫৪ সুধা সদনের ঠিকানায় বরাদ্দপত্র পাঠানো হয়। শেখ হাসিনার প্লট বরাদ্দের ফাইলের ওপর বড় ইংরেজি হরফে লেখা রয়েছে ভি-৩, পাতা ১৪১। ফাইলে শেখ হাসিনার স্বাক্ষরযুক্ত আবেদনপত্রের কপি, বরাদ্দপত্র ও জাতীয় পরিচয়পত্রের কপিসহ অন্যান্য কাগজপত্র রয়েছে। হাসিনা ছাড়াও ১০ কাঠা করে প্লট নেন তার ছেলে সজীব আহমেদ ওয়াজেদ (জয়) ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ (পুতুল)। তাদের প্লট নম্বর যথাক্রমে ০১৫ ও ০১৭। জয়ের নামে প্লটের বরাদ্দপত্র জারি করা হয় ২০২২ সালের ২৪ অক্টোবর। পরে ১০ নভেম্বর প্লটের মালিকানাসংক্রান্ত রেজিস্ট্রি সম্পন্ন হয়। একই বছরের ২ নভেম্বর পুতুলের নামেও ১০ কাঠা প্লটের বরাদ্দপত্র ইস্যু করা হয়। এতে এস্টেট ও ভূমি-৩ শাখার তৎকালীন উপপরিচালকের স্বাক্ষর রয়েছে।
শুধু হাসিনা ও তার ছেলেমেয়েই নন, পূর্বাচল প্রকল্পে ১০ কাঠা করে প্লট নেন তার ছোট বোন শেখ রেহানা ও তার ছেলেমেয়ে। তাদের নামেও যথারীতি প্লট বরাদ্দ করা হয় ২৭ নম্বর সেক্টরের ২০৩ নম্বর রোডের একই জায়গায়। সেখানে শেখ রেহানার প্লট নম্বর ০১৩, তার ছেলে রাদোয়ান মুজিব সিদ্দিকের প্লট নম্বর ০১১ ও মেয়ে আজমিনা সিদ্দিকের প্লট নম্বর ০১৯।
একই বিবেচনায় পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প এলাকায় ১০ কাঠার প্লট নিয়েছেন জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ফারজানা ইসলাম। তাদের বরাদ্দের চিঠিতে বলা হয়েছেÑ ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় নির্দেশনা বাস্তবায়নে প্লট দুটি বরাদ্দ দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো।’ ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী নিয়েছেন পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের ২৬নং সেক্টরের ২০১নং রাস্তার ২৮নং প্লট। তাকে ২০২২ সালের ৭ জুন চূড়ান্ত বরাদ্দ দেয় রাজউক।
সরকারি প্লট নেওয়া তালিকায় রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সারহান নাসের তন্ময়, শেখ হেলাল, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ও তার বড় ভাই যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ। তাপস ও পরশের নামে গুলশানে দুটি সরকারি প্লট বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন ও তার স্ত্রীর নামে প্লট থাকায় তিনি তার মেয়ের নামে একটি প্লট নিয়েছেন।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কোটায় প্লট নিয়েছেন রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান আমিন উল্লাহ নূরী, জাগৃকের সাবেক চেয়ারম্যান খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নবীরুল ইসলাম, অতিরিক্ত সচিব ও জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. হামিদুর রহমান খান, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর একান্ত সচিব এএসএম হুমায়ুন কবীর ও রকিবুর রহমান খান। তারা পূর্বাচলে প্লট নিয়েছেন।
সাংবাদিকদের মধ্যে অনেকেই ১৩/এ ধারায় প্লট নিয়েছেন। একাত্তর টিভির সাবেক প্রধান প্রতিবেদক-উপস্থাপক ফারজানা রূপা ঝিলমিলে একটি ৫ কাঠার প্লট নিয়েছেন।
‘মুজিব’ সিনেমায় অভিনয় করে অভিনেতা আরিফিন শুভ পুরস্কার হিসেবে বাগিয়ে নেন ১০ কাঠার প্লট। এ ছাড়া অভিনেত্রী জয়া আহসান ছাড়াও সংস্কৃতি কর্মীদের অনেকেই প্লট নিয়েছেন। তবে আরিফিন শুভর প্লটটি আপাতত স্থগিত করেছে রাজউক। তার প্লটটি বাতিল হতে পারে বলে জানা গেছে।
রাজউকের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশে বিগত ১৫ বছরে সরকারি প্লট ও ফ্ল্যাটপ্রাপ্তদের তালিকা তৈরি করছে রাজউক ও জাগৃক। এরপর যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে ক্যাটাগরি ভিত্তিতে হালনাগাদ তালিকা সম্পূর্ণ করা হবে। অর্থাৎ সাবেক মন্ত্রী, এমপি, সাংবাদিক, সাংষ্কৃতিক কর্মী, শিল্পী, ব্যবসায়ী কে কোন কোটায় কীভাবে প্লট নিয়েছেন তার পৃথক তালিকা হবে। একইভাবে জাগৃকও সরকারি প্লট, ফ্ল্যাট কে কীভাবে নিয়েছেন সেই তালিকা করছে। তালিকাটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচ্চপর্যায়ে উপস্থাপন করবে সংস্থা দুটি। সেখান থেকে যে সিদ্ধান্ত আসবে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
রাজউকের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) মো. ছিদ্দিকুর রহমান সরকার আমাদের সময়কে বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আমরা তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছি। তবে কী পরিমাণ প্লট বাতিল হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। মূলত যেগুলো রেজিস্ট্রেশন হয়নি, এমন শতাধিক প্লটের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এটি বোর্ডসভায় উপস্থাপন করে বরাদ্দ বাতিল করা হবে।
পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের সম্পত্তি শাখার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের সময়কে বলেন, গত ১৫ বছরে এ রকম তালিকা করা হয়নি। অনেক পুরনো তথ্য। তাই সব ফাইল যাচাই-বাছাই করে তালিকা করতে সময় লাগছে। সরকারের উচ্চমহলের চাপ রয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব তালিকা চূড়ান্ত করা হবে।