বিশেষ প্রতিবেদক : সরকারি ও সরকার অনুমোদিত বেসরকারি মেরিটাইম প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা নৌপরিবহন অধিদপ্তরের শত শত কন্টিনিউয়াস ডিসচার্জ সাটিফিকেট (সিডিসি সার্টিফিকেট) ধারীরা চাকরি না পাওয়ায় কারণে বছরে প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিয়িনের বেশি ডলার হারাচ্ছে সরকার। অন্যদিকে অযোগ্য প্রাথীদের সিডিসি প্রদান স্থগিত হাইকোর্টের রুলের বিরুদ্ধে জবাব দিয়েছে নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা। সাবেক নৌ মন্ত্রী শাজাহান খান ও সাবেক সংসদ মাগুরার মোঃ সাইফুজ্জামান শেখরের কম পরিশ্রমে অবৈধ টাকা কামানোর অন্যতম খাত ছিল আইন ভঙ্গ করে অযোগ্যদের সি ডি সি প্রদান।
এই কাজে তাদের সহযোগী ছিল নৌপরিবহন অধিদপ্তরের পূর্বের মহাপরিচালক নিজামুল হক, নৌপরিবহন অধিদপ্তরের চীফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার গিয়াস উদ্দিন আহমেদ (মুল নায়ক), নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সহকারি কেমিস্ট ফাওজিয়া (সমন্বক), সাবেক নৌপ্রতিমন্ত্রীর এপিএস বাশার (নিয়ন্ত্রক), টেকনাফের তোফায়েল আহমেদ (দালাল), চট্রগ্রামের মেহেদি (দালাল), আতাউর (দালাল), বি এস সি অদুদ (দালাল), ইউনিয়ন আরিফ (দালাল) প্রমুখ।
পানামা সিডিসি প্রদানের রেট ছিল জন প্রতি ১০ (দশ) লক্ষ এবং স্পেশাল ব্যাচ সিডিসি প্রদানের রেট ছিল জন প্রতি ৮ (আট) লক্ষ টাকা।
পূর্বের মহাপরিচালকের সময় চীফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার গিয়াসের সহযোগিতায় ১২৭ (এক শত সাতাশ) টি পানামা সিডিসি’র বিপরীতে বাংলাদেশী সিডিসি ইস্যু করে মোট ১২ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা অবৈধ আয় করা হয়। বর্তমান মহাপরিচালক মাকসুদ আলম পানামা সিডিসি’র বিপরীতে বাংলাদেশি সিডিসি প্রদান বন্ধ করলেও পূর্বের মহাপরিচালকের উদ্যোগ স্পেশাল ব্যাচ অব্যাহত রেখে দুর্নীতিতে সহযোগিতা করেছেন।
অবৈধ স্পেশাল ব্যাচ ১ এর পাসিং আউট প্রোগ্রামে পূর্বতন নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, নৌ সচিব এবং চীফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার গিয়াস উদ্দিন অংশগ্রহণ করায় দালাল চক্র এটাকে পুজি করে গ্রামের সহজ সরল মানুষদের প্রতারিত করে স্পেশাল ব্যাচ ২ থেকে ১০ পর্যন্ত ২০০০ (দুই হাজার) জনের কাছ থেকে জন প্রতি ৫ (পাচ) লক্ষ টাকা করে ১০০ (এক শত) কোটি টাকা এডভান্স নিয়ে ফেলেছে। বৈষম্যবিরোধী সফল বিপ্লবে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতন হলে শাজাহান খান জেলে এবং মোঃ সাইফুজ্জামান শেখর গোপনে দেশ ছাড়লেও বাকি উদ্যোক্তারা বহাল তবিয়তে তাদের পদে থেকে অবৈধ স্পেশাল ব্যাচকে সিডিসি প্রদানের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন।
নৌপরিবহন অধিদপ্তরের চীফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার গিয়াস উদ্দিন আহমেদ যার পৈত্রিক নিবাস গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলায়। চাকরিও পেয়েছেন বিগত আওয়ামীলীগ আমলে। লিটন রহমান ঢালি’র আপন বোন এবং সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুলের চাচাত বোনের জামাই আর গোপালগঞ্জে বাড়ি এই দুই পরিচয়ে কর্মস্থলে প্রচন্ড প্রভাবশালী হয়ে উঠেন। সেই সাথে লাগামহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে মালিক হন বিপুল বৈভবের।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে চীফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার গিয়াস উদ্দিন মোট ৩২ (বত্রিশটি) খাত থেকে অবৈধ টাকা কামাতেন।নৌপরিবহন অধিদপ্তরে দুর্নীতির দায়ে তার বিরুদ্ধে তদন্তে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ দুদকের তদন্তে প্রমানিত হলেও এবং সিডিসি ইস্যুতে হাইকোর্ট দুদককে তদন্ত করার নির্দেশ দিলেও অজ্ঞাত কারনে দুদক কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না।
নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের চীফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার গিয়াস উদ্দিন নিজের অপকর্ম এবং দুর্নীতি ঢাকতে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব-উপসচিব আমিনুর রহমান ও জাহাজ শাখার উপসচিব আলী আহসান (বর্তমানে যুগ্ম সচিব), নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের সাবেক ও বর্তমান মহাপরিচালক এবংপূর্বের সংসদীয় কমিটির উপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিব ও অধিদপ্তরে মহাপরিচালকের অনুমতি ছাড়া সরকারের বিরুদ্ধে রিট পিটিশন দায়ের করেছেন।
একই সাথে তিনি তার দূর্নীতির সাক্ষী স্পেশাল ব্যাচ ও পানামা সিডিসি ফাইল গায়েব করেছেন। প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে সরকার দূর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স গ্রহণ করলেও কিন্তু নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের শীর্ষ দুর্নীতিবাজ গিয়াস উদ্দিন আহমদ এখনো আড়ালে রয়ে গেছে।
স্পেশাল ব্যাচের মাধ্যমে সিডিসি প্রদানের ঘটনায় বাংলাদেশ সিমেন্স এসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুর রহমান ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করেন।
হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ গত ২৭ মে ২০২৪ তারিখে স্পেশাল ব্যাচের মাধ্যমে প্রশিক্ষন প্রদানকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুলনিশি জারি করে এবং এদের সিডিসি প্রদানে নিষেধাজ্ঞা দেয়।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিডিসি প্রদানের নীতিমালা-২০১৮ এর অনুচ্ছেদ ৪ ও ৮ ভঙ্গ করে প্রি-সী স্পেশাল রেটিং কোর্স নামে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের অনুমোদিত কোনও কোর্স না থাকা সত্ত্বেও অনাবাসিক প্রি-সীর স্পেশাল রেটিং কোর্স ২০২৩ চালু করে সম্পূর্ণ নীতিমালা বহির্ভূতভাবে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে ২০০ জন অযোগ্য প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ ও প্রশিক্ষণ প্রদানের অভিযোগে হাইকোর্ট এই নির্দেশ দেয়।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা লঙ্ঘন করে টাকার বিনিময়ে অদক্ষ ব্যক্তিদেরকে সিডিসি প্রদানের এই উদ্যোগে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের চীফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন মো.গিয়াস উদ্দিন গং এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে এই রীট করা হয়েছে। এমতাবস্থায় ঘটনাটি দ্রত তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (যিনি নিজেও অনেকাংশে দায়ী)কে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় নির্দেশ দিলেও এখন পর্যন্ত তদন্ত শুরুই করতে পারেনি উপপরিচালক রেজিনা বেগমের তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটির প্রধান বার বার এ সংক্রান্ত ফাইল তলব করলেও গিয়াস উদ্দিন আহমদ এখনও তার ক্ষমতার জোর দেখিয়ে ফাইল দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন।
অপরদিকে গত ৫ ফেব্রুয়ারি সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম এই অবৈধ সিডিসি প্রদানের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করলে হাইকোর্ট নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, নৌ সচিব, নৌ প্রতিমন্ত্রী ও দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানকে তদন্ত করে এর প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ প্রদান করে তবে কর্তৃপক্ষ তদন্তের উদ্যোগ না নিয়ে উল্টো মোহাম্মদ নজরুল ইসলামের সিডিসি স্থগিত করে এবং গিয়াস গং তার বাসায় লোক পাঠিয়ে নানাভাবে ভয় ভীতি প্রদর্শন করেন। রীটে নাবিক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন যে, সরকারি এবং সরকার অনুমোদিত বেসরকারী মেরিটাইম প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান থেকে রেটিং কোর্স উত্তীর্ণ কয়েক হাজার নাবিক চাকরি পাচ্ছে না।
ক্যাপ্টেন মো. গিয়াসউদ্দিন নৌপরিবহন অধিদপ্তরে চীফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার পদে যোগদানের পর দুর্নীতিবাজ শিপিং মাস্টার জাকির হোসেন কে সাথে নিয়ে নীতিমালা পাশ কাটিয়ে জন প্রতি ১০ লাখ টাকা নিয়ে ১২৭ জনকে অবৈধ পন্থায় আরামবাগ প্রেসে ছাপানো নকল পানামা সিডিসি’র অনুকুলে বাংলাদেশি সিডিসি প্রদান করে প্রায় ১২ কোটি ৭০ লক্ষ কোটি টাকা দুর্নীতির আয় করেন।
এসব ভুয়া পানামা সিডিসি প্রাপ্তরা বিভিন্ন শিপিং এজেন্টকে টাকা দিয়ে জাহাজে উঠার পর ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন বন্দরে পালিয়ে যায় এবং এতে জাহাজ মালিকদের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার জরিমানা দেওয়া লাগে ও জাহাজ মালিকরা তাদের জাহাজে বাংলাদেশি নাবিক নেওয়া নিষিদ্ধ করে। কিছু নাবিক জাহাজে চাকুরী করলেও তাদের কাজের মান খারাপ হওয়ায় জাহাজ মালিকরা পরবর্তীতে বাংলাদেশি নাবিক নিষিদ্ধ করে।
এজন্য সরকারি ও অনুমোদনপ্রাপ্ত বেসরকারি মেরিটাইম প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান থেকে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সুযোগ পেয়ে ও প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে সিডিসি প্রাপ্ত যোগ্যরা বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজে চাকুরীর সুযোগ হারাচ্ছে ও প্রতিবছর প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক হারানোর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
সিডিসি প্রদানের নীতিমালা-২০১৮ এর অনুচ্ছেদ ৪ ও ৮ ভঙ্গ করে বিপুল পরিমান আর্থিক দুর্নীতির মাধ্যমে নীতিমালা বহির্ভূতভাবে ২০০ জনের তালিকা চূড়ান্ত করে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের অনুমোদনবিহীন অনাবাসিক প্রি-সীর স্পেশাল রেটিং কোর্স ২০২৩ এর মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু করে। যেই আবেদনের ভিত্তিতে মাধ্যমে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে সেই আবেদনে আবেদনকারীর কোন নাম ঠিকানা নেই তবে তৎকালীন সংসদ সদস্য শাজাহান খান এবং মোঃ সাইফুজ্জামান শেখরের সুপারিশ রয়েছে।
নাবিকদের চাকরির বাজারে সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় বৈষম্যবিরোধী নাবিকেরা আন্দোলন ও নৌপরিবহন অধিদপ্তর কয়েকদিন ঘেরাও করলে মহাপরিচালক স্পেশাল ব্যাচের সিডিসি প্রদান বন্ধ সহ দায়ী চিহ্নিত করে শাস্তি প্রদানের নিশ্চয়তা দিলেও এখনও কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করেন নাই।
এ বিষয়ে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের চীফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার (চলতি দায়িত্ব) ক্যাপ্টেন মো.গিয়াসউদ্দিন আহমেদ বলেন যে, তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। স্পেশাল ব্যাচ প্রশিক্ষণে বর্তমান ও পূর্বতন মহাপরিচালক, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আলী আহসান এবং উপ সচিব আমিনুর রহমানের অনুমোদনের চিঠি রয়েছে।